সুন্দরবনের 'ম্যানগ্রোভ ম্যান' উমাশঙ্কর মণ্ডল, যিনি রোপণ করেছেন সাড়ে ৬ লক্ষ ম্যানগ্রোভ
বর্তমানে গোটা পৃথিবীতে ক্লাইমেট চেঞ্জিং বা জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। বিশ্ব উষ্ণায়ন যার অন্যতম কারণ। মানুষের অসচেতনতা ও পরিবেশের প্রতি দায়িত্বহীনতা আজকে পৃথিবীকে এক ভয়ঙ্কর অবস্থার সম্মুখীন করেছে। মানুষের স্বার্থে নগর গড়তে গিয়ে যথেচ্ছ পরিমাণে অরণ্য ধ্বংস করা হচ্ছে। এমনকি বাস্তুতন্ত্রের ওপরও আঘাত নেমে আসছে। ১৯৯২ সালে বিশ্ব পরিবেশের উন্নয়ন সংরক্ষণ বিষয়ে ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিওতে 'জাতিসংঘের পরিবেশ ও উন্নয়ন সংক্রান্ত সম্মেলন' অনুষ্ঠিত হয়। তাঁরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালের প্রতিপাদ্য হলো 'বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার'। পুরো পৃথিবী জুড়ে বাস্তুতন্ত্র আজ ক্ষতবিক্ষত। বাস্তুতন্ত্র রক্ষায় সকল মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। সমতল থেকে পাহাড়, বিল থেকে বরেন্দ্র, অরণ্য থেকে উপকূল, চর, গ্রাম থেকে শহর সব শ্রেণি-পেশা-বর্গের নাগরিকদের বাস্তুতন্ত্র রক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে।
পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন অঞ্চলের তেমনই এক মানুষ পরিবেশ রক্ষায় প্রাণপণে লড়াই করে চলেছেন। যিনি সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বাঁচাতে ১০ বছর ধরে লড়াই করছেন। যাকে 'ম্যানগ্রোভ ম্যান' নামেই লোকে সবচেয়ে বেশি চেনে। এই মহান ব্যক্তিটি হলেন গোসাবার সাতজেলিয়া দ্বীপের চরঘেরির বাসিন্দা উমাশঙ্কর মণ্ডল। তিনি পেশায় একজন ভূগোলের শিক্ষক। তিনি নদীর জলে ভেসে আসা ম্যানগ্রোভের বীজ সংগ্রহ করে লক্ষাধিক চারাগাছ তৈরি করেছেন। সেই ম্যানগ্রোভ আমফানের তাণ্ডব থেকে অনেক গ্রাম বাঁচিয়েছে, তবে ক্ষয়ক্ষতি সেভাবে এড়ানো যায়নি। সহায়-সম্বল হারিয়ে আকাশের নীচে দিন কাটাচ্ছেন অগণিত মানুষ। সেই সব দুর্গত মানুষদের পাশে দাঁড়াতে ক্রাউড ফান্ডিংয়ের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করছেন উমাশঙ্কর মণ্ডল ওরফে 'ম্যানগ্রোভ ম্যান।'
সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রাম চরঘেরিতে উমাশঙ্কর বাবু ছোটো থেকে বড় হয়েছেন। সুন্দরবনের ব্যাঘ্র এলাকার ঠিক পাশেই তাঁর বাড়ি। কর্মসূত্রে তিনি থাকেন মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুরে। সেখানকার একটি স্কুলে ভূগোলের শিক্ষকতা করেন তিনি। তাঁর স্ত্রীও স্কুলের শিক্ষিকা। বাইরে থাকলেও গ্রামকে ভোলেননি তিনি। সুন্দরবনের বাসিন্দা ও ভূগোলের ছাত্র হিসেবে তিনি বুঝেছিলেন, বাদাবনের মানুষকে বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচাতে পারে একমাত্র ম্যানগ্রোভই।
উমাশঙ্কর মণ্ডলের মতে, "আয়লার পর চরঘেরির আশেপাশে বাইন, গরান প্রভৃতি ম্যানগ্রোভের চারা লাগানোর কাজ শুরু করি। নদীতে অনেক ম্যানগ্রোভের বীজ ভেসে আসে৷ গ্রামের মহিলাদের কাছ থেকে সেটা সংগ্রহ করা হয়। তারপর নদীর পাশে পুঁতে দেওয়া হয়৷ তা থেকেই ম্যানগ্রোভের চারা তৈরি হয়৷ এভাবে গত ১০ বছরে সাড়ে ছ'লক্ষ ম্যানগ্রোভ চারা তৈরি করেছি।"
বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের হাত থেকে সুন্দরবনকে বাঁচাতে এই ম্যানগ্রোভের বড় ভূমিকা রয়েছে। সুন্দরবনে ২৮ টি প্রজাতির ম্যানগ্রোভ গোটা বনাঞ্চল ঘিরে রেখেছে এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রেখেছে। সেই সঙ্গে বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে আসা ঝঞ্ঝার সামনে উঁচু প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায় সুন্দরবনের এই ম্যানগ্রোভ অরণ্য।
উমাশঙ্কর মণ্ডলের নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা পূর্বাশা ইকো হেল্পলাইন সোসাইটি গত বছর শীতে একটি দারুণ উদ্যোগ নিয়েছিল, যে উদ্যোগে বলা হয়েছিল ম্যানগ্রোভ চারা রোপণ করলেই দেওয়া হবে শীতের কম্বল। এই উদ্যোগে সাড়া দিয়েছিলেন বহু মানুষ। যারা ম্যানগ্রোভ রোপণ করেছিল তাদের হাতে কম্বল তুলে দেওয়া হয়েছিল। এই সংস্থা ম্যানগ্রোভ রোপণে মানুষকে নানান ভাবে উৎসাহিত করছে। এমনকি সুন্দরবনবাসীকে চাষাবাদের কাজে সাহায্যও করছে৷
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় দীর্ঘ মেয়াদে কার্বন ডাই-অক্সাইড ধরে রাখার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। কারণ অন্যান্য বনাঞ্চলের তুলনায় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল বেশি মাত্রায় কার্বন শোষণ করতে পারে৷ শুধু কার্বন শোষণই নয়, ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য প্রাকৃতিক সুরক্ষা প্রাচীর হিসেবে কাজ করে থাকে৷ পরিবেশ সংরক্ষণে সোচ্চার আন্দোলনকর্মীরা আশা করছেন ম্যানগ্রোভ বা শ্বাসমূলীয় বনাঞ্চলগুলো বিশ্বজুড়েই প্রাণবৈচিত্র্যের বিশেষ আধার। এই সব বনাঞ্চলের বিশেষ বাস্তুতন্ত্রও অত্যন্ত স্পর্শকাতর।
গত বছর আমফানের পর পূর্বাশা ইকো হেল্পলাইন সোসাইটি সুন্দরবনের গোসাবা ব্লকের চরঘেরি, শান্তিগাছি, পরশমণি, লাক্সবাগান, লাহিড়িপুর গ্রামের আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষের হাতে তুলে দেয় খাদ্যসামগ্রী। এর মধ্যে খানকয়েক বাঘে আক্রান্ত মৃত মৎস্যজীবীর পরিবারও ছিল৷
গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকার ওপর তৈরি পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ সুন্দরবন। বেশিরভাগটাই বাংলাদেশের দিকে। ভারতের দিকে রয়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগনার তেরোটি আর উত্তর ২৪ পরগনার ছটি ব্লক। সেই সুন্দরবন উষ্ণায়নের পাশাপাশি একের পর এক ঘূর্ণিঝড়ে ভারতের মানচিত্র থেকে মুছে যাওয়ার সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে! আর এই আশঙ্কা আরও প্রবল করেছে সদ্য সুপার সাইক্লোন ইয়াস বয়ে যাওয়ার পর।
সুন্দরবনের ফুসফুস ম্যানগ্রোভ। ইয়াসে ক্ষতবিক্ষত সেই ফুসফুস। এখন শ্বাস নিতে কষ্ট হয় গরান, গেওয়া, হেঁতাল, পরশ, সুন্দরীদের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন সুন্দরবনের ভীত নড়ে গিয়েছে। সাধারণত বর্ষাকালে সময়ের নদীর পাড়ের ম্যানগ্রোভের বীজ জলে পড়ে ভাসতে ভাসতে একটা জায়গায় এসে আটকে যায়। সেখানে পলির সঙ্গে প্রাকৃতিক ভাবে ম্যানগ্রোভের জন্ম হয়। আর এটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।
উমাশঙ্কর মন্ডল ও তাঁর গ্রামের মহিলাদের হাতে তৈরি ম্যানগ্রোভ চারা সাতজেলিয়া দ্বীপের গাড়াল নদীর পাশে পরশমনি নামক স্থানে প্রচুর ম্যানগ্রোভ রোপণ করছেন। এখানকার মহিলারা দীর্ঘদিন ম্যানগ্রোভ রোপণের কাজের সাথে যুক্ত।
পাশাপাশি সুন্দরবনের প্রান্তিক গ্রামাঞ্চলেই এখনও অর্ধেকের বেশি মহিলা স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করেন না৷ এবং প্যাড না ব্যবহার করার পিছনে সচেতনতার অভাবের পাশাপাশি রয়েছে আর্থিক সমস্যা৷ তাই উমাশঙ্কর মণ্ডলের সংস্থা এক বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, যেখানে গ্রামের মহিলারা ম্যানগ্রোভ লাগালে তাদের স্যানিটারি ন্যাপকিন বিতরণ করা হচ্ছে।
ঋতুস্রাবের সময় সু-স্বাস্থ্যের জন্যই স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার জরুরি। অথচ মাসের ওই দিনগুলিতে এখনও অনেকে কাপড় ব্যবহার করেন। তা থেকে সংক্রমণ ছড়ানোর আশঙ্কা থাকে। ঋতুস্রাবের সময় ন্যাপকিনের বদলে পরিস্কার কাপড় ব্যবহার করলে পরে সেটাই আবার ধুয়ে ব্যবহার করলে সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে। তাই স্যানিটারি ন্যাপকিনের উপকারিতা সম্পর্কে বিভিন্ন শিবিরে তাঁরা মহিলাদের সচেতন করছেন।
উমাশঙ্কর মন্ডল বলেন, "শুধু ম্যানগ্রোভ রোপণ নয়, পাশাপাশি নারী স্বাস্থ্য সুরক্ষিত হওয়া প্রয়োজন। এটা আমার নিরন্তর প্রচেষ্টা।"
প্রতিবেদন- নিজস্ব সংবাদদাতা
Post a Comment