বাইসাইকেলে বিশ্বভ্রমণ করা এক দুঃসাহসিক বাঙালি রামনাথ বিশ্বাস
সাইকেলে করে বিশ্বযাত্রা করে যে সকল ভূপর্যটক রেকর্ড গড়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম নাম হলো রামনাথ বিশ্বাস। যার সাইকেলে বিশ্ব ভ্রমণের সাথে জড়িয়ে আছে অনেক জানা-অজানা ইতিহাস। এমনিতেই জগতকে জানবার নেশা বাঙালিকে বারংবার তাড়া করে বেড়ায়। কর্নেল সুরেশচন্দ্র বিশ্বাস হোক বা ভূপর্যটক বিমল দে, সবার চোখেই একই নেশা।
বাঙালির ঘরকুনো বলে যে অপবাদ আছে, সেই কথাটি সর্বাংশে মিথ্যা। বরং বাঙালি অনেক ক্ষেত্রে অনেকের চেয়ে সাহসী। তাই বিনে পয়সায় বা স্বল্প পুঁজিতে সাইকেলে ভ্রমণকারী বাঙালির সংখ্যাও নেহাত কম নয়।
দু'চাকার বাহনে ভর করে রামনাথ বিশ্বাস ছুটে গেছেন পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত৷ সেসব অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন একের পর এক বই। বাংলা ভাষায় ভ্রমণ বিষয়ক ৩০ টি বই লেখেন তিনি। তাঁর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো অন্ধকারের আফ্রিকা, আজকের আমেরিকা, জুজুৎসু জাপান, তরুণ তুর্কী, দুরন্ত দক্ষিণ আফ্রিকা, নিগ্রো জাতির নতুন জীবন, প্রশান্ত মহাসাগরে অশান্তি, বেদুইনের দেশে, ভবঘুরের বিশ্বভ্রমণ, ভিয়েতনামের বিদ্রোহী বীর, মরণবিজয়ী চীন, মাও মাওয়ের দেশে, মালয়েশিয়া ভ্রমণ, লাল চীন, বিদ্রোহী বলকান, সর্বস্বাধীন শ্যাম ও হলিউডের আত্মকথা।
সবে তখন বিংশ শতকের শুরু৷ বেশ কয়েক বছর কেটেছে। আর তার মধ্যেই বেঁধে গেলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। দুনিয়াজুড়ে মরণের ডঙ্কা বেজে উঠেছে। মানুষ যেন ধ্বংসলীলাতে উন্মত্ত। ব্রিটিশ কলোনি হওয়ায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিল বাংলাও৷ এরই অংশ হিসেবে তৈরি হলো বাঙালি পল্টন৷ যেখানে নাম লেখালেন রামনাথ বিশ্বাস। চেহারায় রোগা-পটকা থাকার জন্য ব্রিটিশ সেনাদের তাঁকে নিয়ে তাচ্ছিল্যের শেষ নেই। যদিও রামনাম বিশ্বাস সেসবে পাত্তাই দিতেন না, কারণ মনের জোর ও দুর্জয় সাহসের ওপর বিশ্বাস করতেন তিনি।
রামনাথ বিশ্বাসের মতো বহু বাঙালি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মিত্রপক্ষের হয়ে যুদ্ধ করেছিলেন। তাঁদের লক্ষ্য ছিল আধুনিক সমরবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে ওঠা, যাতে বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া যায়৷ বাঙালি পল্টনের হয়ে যুদ্ধ করতে মেসোপটেমিয়া পাড়ি দিলেন রামনাথ বিশ্বাস। কিছুদিন পরই অসুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে আসতে হয়েছিল তাঁকে। কিন্তু তাঁর অদম্য জেদে তিনি আবারও সৈন্যদলে যোগদান করেন। তবে এই যাওয়া অন্য এক দিগন্ত খুলে দিল তাঁর সামনে৷ কিশোর বয়সেই সাইকেল চালাতে শিখেছিলেন তিনি৷ সেই সাইকেলই ধীরে ধীরে তাঁর নেশায় চেপে গেল। সেনাবাহিনীতে কাজের সুবাদে যখন সিঙ্গাপুরে এলেন, তখন সেই নেশা যেন আবারও পেয়ে বসল তাঁকে। ঠিক করলেন, সাইকেলে করেই বিশ্বভ্রমণ করবেন। অ্যাডভেঞ্চার!
১৯৩১ সালের ৭ ই জুলাই সাইকেলের প্যাডেল ঘুরিয়ে সিঙ্গাপুরের কুইন স্ট্রিট থেকে রওনা দিলেন বিশ্ব ভ্রমণে। তাঁর যাত্রায় সম্বল বলতে দুটো চাদর, এক জোড়া চটি আর সাইকেল মেরামতের এক বাক্স সরঞ্জাম। এই নিয়েই সাইকেলে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন দেশের পর দেশ। দক্ষিণ ও পূর্ব প্রায় সব দেশই তিনি ঘুরে ফেললেন৷ তবে এখানেই থেমে রইল না যাত্রা। ১৯৩৪ এবং ১৯৩৬ সালে আরও দুবার সাইকেলে বের হন তিনি রাস্তায়। আফগানিস্তান, সিরিয়া, লেবানন হয়ে প্রায় গোটা ইউরোপ এবং শেষমেশ আফ্রিকা আর আমেরিকা-- রামনাথ বিশ্বাসের কাছে হার মেনেছিল সর্বপ্রকার প্রতিকূলতা।
সাইকেলে ৫৩ হাজার, পায়ে হেঁটে ৭ হাজার, রেলগাড়িতে ২ হাজার এবং জাহাজে ২৫ হাজার, সব মিলিয়ে ৮৭ হাজার মাইল ভ্রমণ করা এই মানুষটি ছিলেন আপাদমস্তক অসাম্প্রদায়িক, মুক্তমনা, সর্বভুক, ভীষণ সাহসী ও নির্লোভী।
তাঁর বিচিত্র সব ভ্রমণের গল্পের জন্য অপেক্ষা করে থাকতো বাঙালি পাঠকসমাজ। তাঁর গুণমুগ্ধ ভক্ত ছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও। ১৯৩৮-৪০ পর্যন্ত ভ্রমণ করেন তিনি। প্রথমে কলকাতা থেকে মুম্বাই গিয়ে জাহাজে কেনিয়ার মোম্বাসো দিয়ে যাত্রা শুরু করেন। এরপর আফ্রিকার কেনিয়া, উগান্ডা, তানজানিয়া, জানজিবার, মালাউই, মোজাম্বিক, জিম্বাবুয়ে হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা; সেখান থেকে জাহাজে আবার যুক্তরাষ্ট্রে; আবার বন্দী থাকার পর শেষে অনুমতি পেয়ে পশ্চিম থেকে পূর্ব সমগ্র দেশ চষে ফেলে শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কালো ছায়ার মধ্যে জাহাজে করে দেশে ফেরেন। তাঁর শেষ জীবনটা কলকাতায় কাটে।
তথ্যসূত্র- প্রথম আলো, প্রহর, বঙ্গদর্শন।
প্রতিবেদন- সুমিত দে
Post a Comment