ক্যানসার বিনাশে যুগান্তকারী গবেষণা, পথ দেখাচ্ছেন বাংলার গবেষক মোশারফ হোসেন
মারণব্যাধি ক্যানসারকে ধ্বংস করার জন্য গোটা বিশ্বজুড়ে নানান গবেষণা হচ্ছে। ক্যানসার হলো এমন একটি অসুখ যা থেকে সুস্থ হওয়ার কোনো উপায় নেই। ক্যানসার রোগকে নির্মুল করার পন্থা বের হলে বহু মানুষ দীর্ঘায়ু হবেন। ক্যানসারের ওষুধ আবিষ্কার হলে তা হবে এক যুগান্তকারী আবিষ্কার। পশ্চিমবঙ্গের দিনহাটা বিধানসভার এক প্রত্যন্ত গ্রামের তরুণ গবেষক মোশারফ হোসেন, যার দু-চোখে শুধুই ক্যানসার জয়ের স্বপ্ন।
মোশারফ হোসেন ক্যানসারের ওষুধ তৈরির জন্য বিস্তর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। সেই পথে তিনি সফলতার সঙ্গে এগিয়ে চলেছেন। ক্যানসারের আধুনিক গবেষণার ওপর ভিত্তি করে তাঁর গবেষণাপত্র ইতিমধ্যেই দেশের পেটেন্ট কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে। মোশারফ বাবু বর্তমানে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউজিসির মানবসম্পদ উন্নয়ন বিভাগের সহকারী ডিরেক্টর পদে কর্মরত।
সম্প্রতি মোশারফ হোসেনের এক গবেষণা সাড়া ফেলে দিয়েছে। কী সেই গবেষণা? আসুন জেনে নেওয়া যাক। তাঁর গবেষণাগারে আবিষ্কৃত সিন্থেটিক উপাদান ক্যানসারের কোষকে মেরে ফেলতে সক্ষম। তিনি এই উপাদান দুই ধরণের ইঁদুরের শরীরে প্রয়োগ করে দেখেছেন উপাদানটি ক্যানসারের কোষকে ১০০ শতাংশ মেরে ফেলছে। ফলে কোষের মৃত্যুর কারণে ক্যানসারের দ্রুত বিস্তারের সম্ভাবনার দিন এখন শেষ।
তাঁর সিন্থেটিক উপাদানটি নিয়ে পেটেন্টের প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। এবার ধাপে ধাপে প্রথমে গিনিপিগ, বাঁদরের ওপর ট্রায়াল চালানো হবে যা সফল হওয়ার পর সর্বশেষে মানুষের শরীরে উপাদানটির ট্রায়াল চালানো হবে। গিনিপিগের ওপর ট্রায়াল চালানোর অনুমতি থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের যা পরিকাঠামো তাতে এই মুহূর্তে পরবর্তী ধাপের ট্রায়াল চালানো মোটেও সম্ভব নয়। তবে গবেষণায় সাফল্যের সম্ভাবনা বুঝে বেশ কয়েকটি নামী ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থা আগ্রহ দেখিয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন৷ ট্রায়াল সফল হলে তাঁর আবিষ্কার ব্যবসায়িক ভাবে ওষুধ হিসাবে বাজারে আসতে পারে।
সিন্থেটিক ড্রাগ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তিনি এমন কিছু উপাদান খুঁজে পান যেগুলি মানবদেহের কোষকে নিধন করতে পারে। তখনই ক্যানসার কোষ নিধনের বিষয়টি তাঁর মাথায় আসে। সাধারণ কোষ ও ক্যানসার কোষ দুই ধরণের কোষের ওপর সেই উপাদানগুলি প্রয়োগের ফলে দেখা যায়, উপাদানগুলি দুই ধরণের কোষকে ৯০ শতাংশের বেশি নিধন করছে। তবে সেগুলির মধ্যে নির্দিষ্ট একটি উপাদান শুধুমাত্র ক্যানসার কোষকেই ৭০ শতাংশের বেশি নিধন করতে সক্ষম। তিনি দেখেছেন উপাদানটি প্রয়োগ করলে শরীরে কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও হচ্ছে না। তখন সেই উপাদানটি নিয়ে ধাপে ধাপে গবেষণার এগিয়ে যাওয়া শুরু।
মানবদেহে উপাদানটি প্রয়োগ করা যায় কিনা সেই বিষয়েও তিনি গবেষণা করেছেন। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজির ল্যাবরেটরিতেই ঐ বিষয়ে পরীক্ষা ও পর্যালোচনা করা হয়। বায়োটেকনোলজি ও বোটানি বিভাগের একদল অধ্যাপক ও গবেষক এ কাজে তাঁকে সাহায্য করেছেন। তিনি স্তন, ফুসফুস, জরায়ু ও লিভার ক্যানসার কোষের ওপর উপাদানের প্রয়োগ ও পর্যালোচনা করেন। সবশেষে দেখা গেছে মানবদেহে উপাদানটি প্রয়োগ করা যেতে পারে।
মোশারফ হোসেনের এই গবেষণা সম্পন্ন হয়েছে মোট পাঁচটি ধাপে। প্রথম ধাপ ইনভিট্রো, দ্বিতীয় ধাপ ফ্লুওরেসেন্স, তৃতীয় ধাপ মর্ফোলজিক্যাল অ্যাসেসমেন্ট, চতুর্থ ধাপ ইনসিলিকো স্টাডিজ ও শেষ ধাপ ইনভিভো স্টাডিজ৷ ইনভিট্রো স্টাডিজে উপাদানটি মানবদেহে কতটা কার্যকর সেই বিষয়ে পরীক্ষা ও পর্যালোচনা করা হয়। ফ্লুওরেসেন্স ও মর্ফোলজিক্যাল অ্যাসেসমেন্টে দেখা হয় উপাদানটি কোষের ভেতরে প্রবেশ করে ঠিকমতো কাজ করছে কিনা এবং এতে সাধারণ কোষের কোনো ক্ষতি হচ্ছে কিনা। এই পরীক্ষার ফলাফল হিসেবে দেখা যায় কোষটি কেবল ক্যানসার কোষে ঢুকে তাকে দ্রুত প্রতিহত করছে ও তার জায়গায় নতুন কোষের জন্ম হচ্ছে। আর সাধারণ কোষের কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। এরপর ইনসিলিকো স্টাডিজে দেখা হয় উপাদানটি মানবদেহের erbB2 নামক প্রোটিনের সঙ্গে কতটা সংযোগ ঘটাচ্ছে। এই ধাপটির ফলাফল হিসেবে দেখা গেছে উপাদানটি মানবদেহের erbB2 নামক প্রোটিনের সঙ্গে দারুণভাবে সংযোগ ঘটাচ্ছে। অতএব মানুষের শরীরে উপাদানটি বেশ কার্যকর হবে৷
শেষ ধাপ অর্থাৎ ইনভিভো স্টাডিজে ইঁদুরের দেহে কৃত্রিমভাবে ক্যানসারের সৃষ্টি করে উপাদানটির ফাইনাল ডোজ প্রয়োগ করার পর সফলভাবে ক্যানসার ধ্বংস করছে সিন্থেটিক উপাদানটি। সুতরাং, মোশারফ হোসেনের গবেষণা পরীক্ষামূলক ভাবে মানবদেহে সফল হলে ক্যানসারের ওষুধের আবিষ্কর্তা হিসেবে উঠে আসবে তাঁর নাম।
প্রতিবেদন- সুমিত দে
Post a Comment