প্রাক জন্ম-সার্ধশতবর্ষ স্মরণে অতুলপ্রসাদ সেন
প্রতিবছর 'অমর একুশে' অর্থাৎ একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের দিন আমরা একটি বিখ্যাত গান গেয়ে থাকি সে গানটি হল "মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা!" আমাদের মাতৃভাষা বাংলার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এই গানটি গাওয়ার পাশাপাশি অনেকেই তাঁদের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টে হোক বা পোস্টারেই হোক গানের এই প্রথম উদ্ধৃতিটি তুলে ধরেন। আসলে পূর্ব-পাকিস্তানের বাংলা ভাষা আন্দোলনের ঊষালগ্ন থেকেই এই গানটি আন্দোলনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে, ঠিক তেমনি জড়িয়ে রয়েছে আমাদের অর্থাৎ বাঙালিদের মাতৃভাষা বাংলা-ভাষার প্রতি ভালোবাসার শিকড়ে। শুধু ভাষা আন্দোলন নয়, সে দেশে মুক্তিযুদ্ধের সাথেও জড়িয়ে রয়েছে এই দেশাত্মবোধক গানটি। আচ্ছা, এই বিখ্যাত গানটির রচয়িতা কে? এ তো অনেকেরই জানা। তবুও, সবাই হয়তো বলতে পারবেন না কিন্তু অনেকেই অবশ্যই বলবেন যে, "এই বিখ্যাত গানটির রচয়িতা হলেন অতুলপ্রসাদ সেন"।
অতুলপ্রসাদ সেন জন্মগ্রহণ করেন ১৮৭১ সালের ২০ শে অক্টোবর ঢাকায় তার মাতুলালয়ে। তৎকালীন যুগে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করার একটা রেওয়াজ ছিল। যাইহোক, তাঁর পরিবার ছিল কায়স্থ আর তিনি ছিলেন বাবা রামপ্রসাদ সেন ও মা হেমন্ত শশীর জ্যেষ্ঠ সন্তান। তাঁদের আদি নিবাস ছিল বর্তমান বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার মগর গ্রামে। বাল্যকালেই তিনি পিতৃহারা হন। তাঁকে প্রতিপালিত করেন মাতামহ কালীনারায়ণ গুপ্ত। এই কালীনারায়ণ গুপ্ত ছিলেন একজন বিশিষ্ট সুকণ্ঠ গায়ক, নানান ভক্তিসঙ্গীতের রচয়িতা। মাতামহ কালীনারায়ণের আশ্রয়ে থেকে প্রতিপালিত হবার ফলে অতুলপ্রসাদের মধ্যেও এই সমস্ত গুণগুলি চলে আসে। পরবর্তীকালে যে বিখ্যাত গায়ক অতুলপ্রসাদকে আমরা পাই তার জন্য কালীনারায়ণ গুপ্তের প্রভাব ছিল— এ কথা নির্দ্বিধায় স্বীকার করা যায় ৷ ১৮৯০ সালে তিনি প্রবেশিকা পাশ করে কিছুদিনের জন্য কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াশোনা করলেও ওই বছরের নভেম্বর মাসে তিনি আইন পড়তে ইংল্যান্ডে যান। সেখান থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করে ১৮৯৪ সালে বাংলায় ফিরে আসেন।
কলকাতা ও রংপুরে কিছু সময়ের জন্য আইন ব্যবসা করে উত্তর ভারতের লখনউ শহরে চলে যান। আস্তে আস্তে আইন ব্যবসায়ী হিসেবে তিনি সেখানে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। এতটাই বিখ্যাত যে, তিনি সেখানকার শ্রেষ্ঠ ব্যবহারজীবী হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভও করেন। এমনকি আউধ বার অ্যাসোসিয়েশন এবং আউধ বার কাউন্সিলের সভাপতি হয়ে ওঠেন। তিনি জীবিতকালেই এতটাই কিংবদন্তি হয়ে উঠেছিলেন যে তিনি যেখানে বসবাস করতেন সেখানকার রাস্তার নাম তাঁর নামানুসারে করা হয়েছিল৷
বাঙালির কাছে অতুলপ্রসাদের পরিচয় একজন বিখ্যাত গায়ক, সঙ্গীতজ্ঞ ও সুরকার হিসেবে। তাঁর গানের সংখ্যা প্রায় দু'শো কি তার বেশি আর এই সমস্ত গানগুলিকে মূলত তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়৷ তা হল স্বদেশী সঙ্গীত, ভক্তিগীতি ও প্রেমের সঙ্গীত। আমরা শুরুতে যে "মোদের গরব, মোদের আশা আ মরি বাংলা ভাষা!" গানটার কথা বলছিলাম সেই গানটি হল মূলত স্বদেশী সঙ্গীত। তিনি ব্যক্তিগত জীবনে যে সমস্ত বেদনা পেয়েছেন তাই যেন ফুটে উঠেছে তাঁর সকল শ্রেণীর সঙ্গীতে। হিন্দুস্থানী গানের সুর ও ঢং, বাউল ও কীর্তন গানের সুর ও ঢং ইত্যাদি মিশিয়ে তিনি বাংলা গানের এক বিশেষ সঙ্গীতরীতির প্রচলন করেন। তিনি বাংলা গানে ঠুংরি ধারাও প্রচলন করেন। শুধু তাই নয়, তিনি প্রথম বাংলা গজল লিখেছিলেন। 'মোদের গরব' ছাড়াও তাঁর আরও কিছু বিখ্যাত গানগুলি হল 'উঠ গো ভারত-লক্ষ্মী', 'বলো বলো বলো সবে শতবীণা বেণু রবে', 'হও ধরমেতে ধীর হও করমেতে বীর', 'তোমারি যতনে তোমারি উদ্যানে', 'আমার হাত ধরে তুমি', 'কে আবার বাজায় বাঁশি', 'বঁধূ এমন বাদলে তুমি কোথা', 'মিছে তুই ভাবিস মন', 'সবারে বাস রে ভালো', 'বঁধুয়া নিঁদ নাহি আঁখিপাতে', 'একা মোর গানের তরী', 'ক্রন্দসী পথচারিণী' ইত্যাদি। তাঁর সমস্ত গানগুলি সংকলিত হয়েছে 'কয়েকটি গান' ও 'গীতিপুঞ্জ' গীতগ্রন্থে৷ তাঁর সমস্ত গানের স্বরলিপি প্রকাশিত হয়েছে 'কাকলি' নামক গ্রন্থমালায়। তিনি ২১২ টা কবিতা লিখেছেন যার মধ্যে কয়েকটা গানেও রূপান্তরিত করা হয়েছে। অন্যান্য লেখা এমনকি ভ্রমণ-কাহিনীও তিনি লিখেছেন৷
গায়ক মানুষ অতুলপ্রসাদের মনটাও ছিল উদার। তিনি যা অর্থ উপার্জন করতেন তার বেশিরভাগই তিনি স্থানীয় জনসাধারণের সেবায় ব্যয় করতেন। তাঁর গ্রন্থস্বত্ব এমনকি আবাসগৃহও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্য দান করে গেছেন। এভাবে গানের পাশাপাশি সামাজিকমূলক কাজও তিনি করে গেছেন। 'প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন' যখন প্রতিষ্ঠিত হয় তখন তিনি হন সেখানকার অন্যতম প্রধান। সম্মেলনের মুখপত্র 'উত্তরা'-র অন্যতম সম্পাদক হন তিনি। শুধু তাই নয়, তিনি ওই সম্মেলনের কানপুর ও গোরখপুর অধিবেশনের সভাপতিও ছিলেন। রাজনৈতিক মানসিকতায় তিনি প্রথমে কংগ্রেসী থাকলেও পরে লিবারেলপন্থী হয়ে ওঠেন৷
১৯৩৪ সালের ২৬ শে আগস্ট উত্তর ভারতের লখনউ-তে বাংলারই এই মহান কৃতি সন্তানের মৃত্যু হয়। এ বছর অক্টোবরে তাঁর জন্মের সার্ধশতবর্ষ বা বলা যায় ১৫০ তম জন্মবার্ষিকী পালিত হবে। হয়তো, তাঁর জীবন, গান, কবিতা সহ সমস্ত লেখা এবং অন্যান্য কাজ নিয়ে আরও চর্চা হবে, আরও জানা যাবে ও বোঝা যাবে অতুলপ্রসাদ সেনকে।
প্রতিবেদন- ইন্দ্রনীল মজুমদার
Post a Comment