বাংলার ঐতিহ্য জামাই ষষ্ঠীর ইতিহাস ও পুরাকথা
'যম-জামাই-ভাগনা তিন নয় আপনা'। প্রবাদে যাই বলুক বাংলায় কিন্তু জামাই আদরে কোনও খামতি নেই। আর সেই জামাই আদরের বিশেষ দিন - জামাই ষষ্ঠী। জৈষ্ঠ্য মাসের শুক্ল পক্ষের ষষ্ঠীতে আয়োজন হয় এই পরবের। বাংলা জুড়ে জামাইগণ সস্ত্রীক হাজির শ্বশুরবাড়ির দরজায়। জৈষ্ঠ্য মাসের ভ্যাপসা গরমে বাংলার চিরায়ত হাতপাখার মিষ্টতার সাথে যেন এর তুলনা। শ্যালিকার রসিকতা, শ্বশুরের আয়োজন আর মাতৃসমা শাশুড়ির মঙ্গলকামনায় রাখা ব্রত। নতুন হাতপাখার হাওয়া, পাঁচ রকমের ফল, মিষ্টান্ন, ১০৮ টি দুর্ব্বা। পেটপুজোতে বাঙালির বাহারি আহার তো আছেই। ইলিশ মাছ, খাসির মাংস, মিষ্টি দই। নতুন জামা-কাপড় প্রাপ্তি তো আছেই। বিনিময়ে অবশ্য শ্বশুর-শ্বাশুড়িরও প্রাপ্তি ঘটে।
'হিন্দুর আচার-অনুষ্ঠান' বইটিতে প্রখ্যাত লেখক চিন্তাহরণ চক্রবর্তী লিখেছেন, কোনও ধর্মানুষ্ঠানের সঙ্গে এর প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই। এটি মূলতঃ লোকাচার। বাংলা জুড়ে মেয়েরা বিভিন্ন ব্রত পালন করতো, তার মধ্যে একটি অরণ্য ষষ্ঠী। এই ব্রত রাখা হয় সন্তানের মঙ্গল কামনায়। সন্তানের মা তো বটেই, সন্তানবতী মহিলারাও এই ব্রত পালন করতেন। লোকায়ত ধর্ম গবেষক আশুতোষ ভট্টাচার্যের মতে, ষষ্ঠী হলেন প্রসূতি এবং শিশুর রক্ষয়িত্রী।
জামাই ষষ্ঠী খাঁটি বাঙালি উৎসব হলেও, মা ষষ্ঠী কিন্তু কেবলমাত্র বাঙালির দেবী নন। বায়ু পুরাণে তাঁকে ৪৯ টি দেবীর অন্যতমা বলা হয়েছে। যাজ্ঞবল্কস্মৃতি অনুসারে শিব ও উমার সন্তান স্কন্দের পালিকা মাতা হলেন ষষ্ঠী। পদ্মপুরাণে তিনিই আবার স্কন্দের পত্নী। নৃতত্ত্ব ও ইতিহাসের গবেষক সুধীর রঞ্জন দাস এই অভিভাবক দেবীর জনজাতীয় উৎস নিয়ে বিস্তর গবেষণা রেখে গেছেন। হরপ্পাতেও প্রাগৈতিহাসিক এমন দেবীমূর্তি পাওয়া গেছে, যা দেখে নৃতত্ত্ববিদরা মনে করেছেন, সিন্ধু সভ্যতাতেও মা ষষ্ঠীর মতোন কোনও দেবীর অস্তিত্ব ছিল। এই প্রাচীনত্ব সত্যি হলে তা বিস্ময় তো বটেই। এটা ধরে নেওয়া অন্যায় নয়, সেই অনার্য দেবী ষষ্ঠীই কালক্রমে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অন্য দেবীর সাথে অঙ্গীভূত হয়ে যান। তবে এই পুজো ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অঙ্গীভূত হয়েও লোকায়ত ধর্মের স্বাতন্ত্র ধরে রেখেছে। দেবী ষষ্ঠী বাংলার মঙ্গলকাব্যেও স্থান করে নিয়েছেন। ষষ্ঠী পুজোর জনপ্রিয়তা মূলতঃ পূর্ববঙ্গে এবং পূর্ববঙ্গীয়দের মধ্যে বেশি। তবে পশ্চিমবঙ্গীয় পরিবারেও এর প্রচলন নেহাত কম নয়। মায়ের বাহন বিড়াল। কোলে এক বা একাধিক শিশু। শুধু বাংলায় না, বিহার এবং উড়িষ্যাতেও এই পুজোর প্রচলন আছে। বিহারে শিশু জন্মের ষষ্ঠদিনে ছ’ঠী মাতার যে পুজো করা হয়, সেই মাতাই মা ষষ্ঠী। উড়িষ্যাতে সন্তান জন্মের ষষ্ঠ এবং একবিংশ দিনে ষষ্ঠী পুজো করা হয়।
লোককাহিনী অনুসারে, এক বধূ নিজে খাবার চুরি করে খেয়ে পোষা বিড়ালের নামে দোষ দিত। সেই বিড়াল ছিল মা ষষ্ঠীর বাহন। সেই বিড়াল মা ষষ্ঠীর কাছে নালিশ করত। একদিন এক জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠীতে তার শ্বাশুড়ি ব্রত পালনের জন্য পায়েস, মিষ্টি রান্না করেছিলেন। তিনি স্নানে যাবার আগে বউকে সেগুলো দেখতে বলে গেলেন। বউ খাবার দেখে লোভ সামলাতে পারলেন না। সব একটু একটু করে খেয়ে বিড়ালটার নামে দোষ দেওয়ার জন্য একটু দই নিয়ে বিড়ালটার মুখে লাগিয়ে দিল। শাশুড়ি এলে বউ যথারীতি বিড়ালটার নামে দোষ চাপিয়ে বিড়ালটাকেই দু’চার ঘা মেরে দিল।
মনের দুঃখে সেই বিড়ালটা কেঁদে কেঁদে মা ষষ্ঠীকে জানালে, মা এর প্রতিকার করার আশ্বাস দিলেন। কয়েকমাস পর বউয়ের সন্তান হলে একদিন সকালে সে ঘুম ভেঙে দেখল ছেলে তার কাছে নেই। আর কখনোই ছেলের খোঁজ পাওয়া গেল না। এভাবে পর পর সাত সাতটি সন্তান নিখোঁজ হয়ে গেল। পাড়ার লোকেরা তখন তাকেই এর জন্য দায়ী করলো। অপবাদ সহ্য করতে না পেরে বনে এসে বউ মা ষষ্ঠীর নাম করে কাঁদতে লাগল। মা ষষ্ঠীর দয়া হলে তাঁর কৃপায় বউ সাত সন্তান ফিরে পেল। সবাই মা ষষ্ঠীর পুজো করলেন। সন্তানেরা বড় হলে তাদের বিয়ে হল। তখন বউ জামাইদের ডেকে জামাই ষষ্ঠী শুরু করল। এভাবে ব্রতের প্রচার হল।
আগেকার দিনে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার পর মেয়ের মা-বাবা যখন তখন মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে যেতে পারতেন না। কোথাও কোথাও মেয়ের প্রথম সন্তান না হলে তার শ্বশুর বাড়ি যাওয়ারই রেওয়াজ ছিল না। অরণ্য ষষ্ঠী তিথিতে মেয়ে-জামাইয়ের মঙ্গল কামনায় ব্রত পালন খানিকটা মেয়েকে দেখার তাগিদেই শুরু হয়। 'জামি' শব্দের অর্থ সধবা নারী বা কুলবধূ। বহুবচনে জাময়ঃ। আগে রীতি ছিল জ্যৈষ্ঠমাসের শুক্ল পক্ষের ষষ্ঠীতে বনে গিয়ে মা বিন্ধ্যবাসিনী ষষ্ঠীর উপাসনা করে তাকে তুষ্ট করে সধবা স্ত্রীরা সন্তান লাভ করতেন। কালক্রমে জামাই আপ্যায়ন-এর প্রথা জুড়ে যাওয়াতেই হয়তো ‘জাময়ঃ ষষ্ঠী’ থেকে ‘জামাই ষষ্ঠী’ নাম এল। এও একপ্রকার পুরুষতান্ত্রিকতা বৈকি। তবে, ‘বারো মাসে তেরো পার্ব্বন’ বাঙালির জীবনে এই সুযোগে যদি উৎসব মুখরতা নেমে আসে তো মন্দ কি? এতে মেয়ে-জামাই ও খুশি, শ্বশুর-শাশুড়িও খুশি, আবার বাজার গরম থাকায় দোকানদারের মুখেও হাসি ফুটে ওঠে।
প্রতিবেদন- অর্ক বন্দ্যোপাধ্যায়
লেখক পরিচিতি :- অর্ক বন্দ্যোপাধ্যায় পেশায় অধ্যাপক, নেশায় সাহিত্যসেবী। মেক্যানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর অধ্যাপনার অবসরে চলে কবিতা, গল্প আর প্রবন্ধ লেখা। তাঁর প্রকাশিত কবিতার বইগুলি 'সলতে', 'আমাদের পঞ্চম'কার সাধন ও 'পিওনি ফুলের বিপরীতে'।
Post a Comment