সুন্দরবনের বিপর্যস্ত এলাকার সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াল 'হে নূতন'
ঘূর্ণিঝড় ইয়াস চলে যাওয়ার পরও তার প্রভাব অনেকটাই রয়েছে। ইয়াসের প্রভাবে দক্ষিণবঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চল বিপুল ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। বেশ কয়েকটি অঞ্চলে বাঁধ ভেঙে নোনা জলের তলায় চলে গেছে বহু জায়গা। অসংখ্য মানুষের বাসস্থান জলমগ্ন। প্রায় গোটা সুন্দরবন ক্ষতিগ্রস্ত। বেশ কিছু জায়গাতে ঠিকঠাক ভাবে ত্রাণ শিবিরও বানানো হয়নি। বিভিন্ন স্থানে লবণাক্ত জল ঢোকায় পানীয় জলের অবস্থা শোচনীয়। দেখা দিয়েছে খাবার ও ওষুধের অভাব। ঝড়ের ফলে তেমন কোনো ক্ষতি না হলেও সমস্ত ক্ষতিটা হয়েছে বন্যার ফলে।
সুন্দরবনের অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়াতে এগিয়ে এসেছে 'হে নূতন' সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী। এই সংস্থার সদস্য-সদস্যারা তাঁদের সামর্থ্যানুযায়ী বানভাসি মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে চলেছে। গত ২৮ শে মে তাঁরা পৌঁছে গিয়েছিল কুলতলী থানার অন্তর্গত শ্যামনগর আদিবাসী পাড়ায়, যেখানে গোটা এলাকা ভয়ানক ক্ষতিগ্রস্ত৷ পেটকুলচাঁদ ব্রিজের কাছ থেকে প্রায় সাড়ে ৩ কিমি রাস্তা পেরিয়ে যেতে হয়েছিল তাঁদের, যে রাস্তার বেশিরভাগ অংশ জলে টইটুম্বুর। কিছু জায়গায় জল নেমেছে ঠিকই তবে এলাকার বেশিরভাগ জায়গায় তখনও জলের খরস্রোত দেখা গেল। রাস্তার বেশ কিছু অংশ পুরোপুরি কর্দমাক্ত। বাঁধ ভেঙে লবণাক্ত জল ঢুকে পড়েছে চাষের জমিতে।
স্থানীয় মানুষদের সাথে কথা বলে তাঁরা জানতে পারেন, ঐ জমিতে আগামী ৫ থেকে ৬ বছর আর চাষাবাদ সম্ভব নয়। সর্বত্র ভেসে রয়েছে মরা মাছ যা ততক্ষণে পচতে শুরু করেছে। লবণাক্ত জলের কারণে গোটা এলাকার মানুষ প্রবল জলকষ্টের সম্মুখীন। সব মিলিয়ে এলাকার দুর্গত মানুষের বক্তব্য, আয়লার পর এত বড়ো ক্ষতি এই প্রথম। আমফানে ঘরবাড়ি ভাঙলেও জলোচ্ছ্বাসের এমন দাপট ছিল না।
হে নূতন ঐ এলাকায় পৌঁছে গিয়েছিল ২০০ জনের শুকনো খাবার, পানীয় জল, জিওলিন ও শিশুদের জন্য প্যাকেটজাত গুঁড়ো দুধ নিয়ে৷ অল্প কয়েক জায়গায় সরকারি সাহায্য বাদ দিলে বেশিরভাগ অংশের মানুষের কাছে তখনও খুব বেশি কিছু পৌঁছোয়নি।
'হে নূতন' সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর মতে, "মানুষ ঠিক কীভাবে রয়েছেন, চোখে না দেখলে অনুভব করা যাবে না। আমরা জল দেওয়ার সাথে সাথে জিওলিন দিয়েছি, যাতে ওখানকার মানুষ জিওলিন ব্যবহার করে আশেপাশে থাকা মিঠে জলকে পানের উপযোগী করে কিছুটা তেষ্টা মেটাতে সক্ষম হন। কয়েকজন তো এই সামগ্রী নিতে এসেছিলেন সাঁতার কেটে, আবার ওগুলো নিয়ে সাঁতার কেটেই ফিরলেন তাঁরা। ভাত খেতে চাইছেন ওঁরা, কিন্তু রান্না করার মতো পরিস্থিতি নেই কোথাও।"
এরপর ৩১শে মে হে নূতন পৌঁছে গিয়েছিল রায়দীঘি বিধানসভার জটার-দেউল আদিবাসী পাড়া ও কালীতলা অঞ্চলে। রায়দীঘি কলেজ পেরিয়ে প্রায় ৯ থেকে ১০ কিলোমিটার ভেতরে কাঁচা-পাকা রাস্তা দিয়ে নদী পার্শ্ববর্তী ঐ অঞ্চলগুলোতে তাঁরা পৌঁছে দেখতে পান বানভাসী ঐ এলাকায় জল তখন নেমে গেলেও পূর্ববর্তী অবস্থা কল্পনা করাটা কঠিন ছিল না, যদিও কিছু কিছু জায়গায় তখনও জল নামেনি। কিছু ইটের রাস্তার ওপর তখনও পড়ে আছে উঁচু মাটির স্তর, জলে ডোবা রাস্তায় মাটি ফেলে চলাচলের চেষ্টা করেছিল গ্রামবাসীরা যা পূর্ববর্তী অবস্থা কিছুটা হলেও ব্যক্ত করে। এখানকার অবস্থা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হলেও অন্যান্য এলাকাগুলোর মতো এখানেও চাষের জমির হাল বেহাল। এখানে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে হয় চিংড়ি মাছের চাষ, সেক্ষেত্রেও বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে এলাকার মানুষদের।
ইতিমধ্যে কিছু সংস্থা তাদের সাধ্যমত ত্রাণ নিয়ে পৌঁছালেও তা পর্যাপ্ত ছিল না বলে দাবি কিছু মানুষের। এমতাবস্থায় হে নূতন ঐ এলাকায় পৌঁছে গিয়েছিল ২০০ জনের শুকনো খাবার নিয়ে৷ যার মধ্যে ছিল চিঁড়ে, বাতাসা, মুড়ি, ছাতু, বিস্কুট ইত্যাদি।
সরকারের কাছে ত্রাণসামগ্রীর চেয়েও এইসব ক্ষতিগ্রস্থ এলাকার মানুষদের বড় যে দাবী তা হল, টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করুক সরকার; যাতে এমন অবস্থা আর কখনও না হয়। শুধু ভাঙা বাঁধ যেন তেন প্রকারে মেরামত করলে দীর্ঘকালীন এই সমস্যা মিটবে না। শুধু ঐ দুটি এলাকা নয়, গোটা সুন্দরবনের অবস্থা একই। দুর্বল বাঁধের যে পরিস্থিতি তা হে নূতনের সদস্যদের চোখ এড়ায়নি, তাতে পাকাপোক্ত বাঁধ না বানালে প্রত্যেক ঘূর্ণিঝড় এভাবেই বিপর্যস্ত করবে সুন্দরবন সংলগ্ন অঞ্চলগুলোকে।
এখনও হে নূতন তাঁদের সাধ্যমতো পৌঁছে যাবে বিপর্যয়পূর্ণ অঞ্চলগুলোতে। বহু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ বিশেষভাবে সহায়তা করেছে এই সংস্থাকে। তাঁদের এই মানবিক উদ্যোগে অসংখ্য মানুষ তাঁদের সাধুবাদ জানিয়েছেন।
প্রতিবেদন- নিজস্ব সংবাদদাতা
Post a Comment