মাতৃভাষাতেই সিনেমা বানিয়েও আন্তর্জাতিক পরিচালক হওয়া সম্ভব বলে মনে করতেন ঋতুপর্ণ ঘোষ
'আমার চলচ্চিত্র জীবন শুধু নয়, ব্যক্তি হিসেবে আমার বর্তমান অবস্থানের উপর কলকাতার বিশাল প্রভাব আছে’। একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন স্বনামধন্য বাঙালি পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ। আজ ৩০শে মে। তাঁর চলে যাওয়ার দিন। 'বিরস বৃন্দাবন/নিরস উপবন/যতেক ব্রজের বালা/বেদনা নিধুর'। সত্যজিত-ঋত্বিকদের পরবর্তী কালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি পরিচালক, যার পর্দার মায়াজালে আমরা মৃদু হেসেছি কখনো, কখনো বিস্ময়ে চোখ বিস্ফারিত করেছি, আবার কখনো রুমাল টেনে নিয়েছি চোখের জল ঢাকতে সেই তাকেই আমরা হারালাম। দেখতে দেখতে আটটা বছর পেরিয়ে গেল। অথচ, তাঁর চলে যাওয়ার সেই বৃষ্টি ভেজা দিনটা আজও স্মৃতিতে ভাসে।
বাংলা ও বাঙালিয়ানা আশৈশব তাঁকে গড়ে তুলেছে। 'বাংলা ভাষা নিয়ে অহংকার করতে শিখিয়েছে রবীন্দ্রনাথ, সুকুমার, শিবরাম, মুজতবা আলি। সত্যজিত প্রথম শিখিয়েছে ক্যামেরা দিয়ে গল্প বলা যায়। চাইলে কবিতাও'। তাঁর প্রতিটি শিল্পকর্মে তাই নিখাদ বাঙালিয়ানা। বোরোলিনের বিখ্যাত সেই স্লোগান, 'বঙ্গ জীবনের অঙ্গ' মনে পড়ে? তাঁরই সৃষ্টি। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে তৈরী ছবি 'হীরের আংটি' (১৯৯২) দিয়ে পথচলা শুরু। গ্রাম বাংলার জমিদার বাড়ির দুর্গাপুজো। শরতের শিশিরে ভেজা বাংলা উঠে এসেছে পর্দায়। হাবুল, তার ছোটকাকা, আমেরিকার থেকে আসা কাকা, কাকিমার সাথে খুড়তুতো বোন তিন্নি, সব মিলিয়ে বাংলার চিরাচরিত একান্নবর্তী পরিবারের চিত্রনাট্য। কিন্তু, প্রথম ছবিতেই হোঁচট খেতে হল তাঁকে। ডিস্ট্রিবিউটারের অভাবে ছবি মুক্তি পেল না। ১৯৯৪ তে পরের ছবি উনিশে এপ্রিলে মন জয় করে নিলেন বাঙালির। এলো দুটো জাতীয় পুরষ্কার। শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে নিজে পুরষ্কার পেলেন, পুরষ্কার এনে দিলেন দেবশ্রী রায়কে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে। এরপর দহন (১৯৯৭), বাড়িওয়ালি (১৯৯৯), অসুখ (১৯৯৯), উৎসব (২০০০)। সবকটি ছবিই এনে দিয়েছে এক বা একাধিক জাতীয় পুরষ্কার। ২০০২ সালে বানালেন 'তিতলি'। কলকাতার অন্দরমহল ছেড়ে তার ছবি বেরিয়ে এলো কুয়াশা ঢাকা দার্জিলিং এর পাহাড়ি পথের আঁকে বাঁকে। কোনও পুরষ্কার এলো না বটে, কিন্তু মিঠুন-অপর্ণা সেন জুটিকে এক নতুন আঙ্গিকে পেল বাঙালি। অপর্ণা সেনের মেয়ে কঙ্কনার পর্দায় প্রথম মুখ দেখানো। মা মেয়ের সম্পর্কের এক নতুন গল্প। আর সেই সাথে দর্শকেরা ভাবতে বাধ্য হল, কবিতার ব্যবহার এভাবেও করা যায় ছবিতে! এর পরপর শুভ মহরত (২০০৩), 'চোখের বালি' (২০০৩) দুটি ছবিতেই জাতীয় পুরষ্কার আবার। ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবিতে পুরষ্কারের সংখ্যা গুনতে গেলে শেষ হবে না। বরঞ্চ কোন কোন ছবিতে পুরষ্কার আসে নি সেটা গোনাই সহজ। ২০০৪ সালে বানালেন প্রথম হিন্দি ছবি 'রেনকোট'। যথারীতি আবারও জাতীয় পুরষ্কার। ২০০৭ এ বানালেন প্রথম ইংরেজি ছবি 'দ্য লাস্ট লিয়র'। পেলেন ইংরেজি ভাষায় শ্রেষ্ঠ ছবির জাতীয় পুরস্কার। এর পরের ছবিগুলো,
২০০৮- খেলা
২০০৮- সব চরিত্র কাল্পনিক (জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত শ্রেষ্ঠ বাংলা সিনেমা)
২০১০- আবহমান (জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত শ্রেষ্ঠ পরিচালক, বাংলা ভাষায় শ্রেষ্ঠ ছবির জাতীয় পুরস্কার, শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর জাতীয় পুরস্কার)
২০১০- নৌকাডুবি
২০১২- সানগ্লাস
২০১২- চিত্রাঙ্গদা (বিশেষ জুরি পুরস্কার, অভিনেতা ঋতুপর্ণ ঘোষ)
ঋতুপর্ণের ছবিগুলোর ঝুলিতে ১২টি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। এছাড়া বার্লিন, লোকার্নো, শিকাগো, বুসান, বোম্বে প্রভৃতি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব থেকে একাধিক আন্তর্জাতিক পুরস্কারসহ অসংখ্য সম্মান পেয়েছেন এই বাঙালি পরিচালক। ঋতুপর্ণ একাধারে পরিচালক, কবি, গীতিকার, লেখক, চিত্রনাট্যকার। করেছেন সম্পাদনাও। ঋতুপর্ণ ঘোষ প্রথম অভিনয় করেন হিমাংশু পারিজা পরিচালিত ওড়িয়া ছবি 'কথা দেইথিল্লি মা কু' (২০০৩) তে। এছাড়া সঞ্জয় নাগের 'মেমোরিজ ইন মার্চ' (২০১০) এবং কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের 'আরেকটি প্রেমের গল্প' (২০১১) ছবিতে অভিনয় করেন। এ ছাড়া তাঁর পরিচালিত ও জীবদ্দশায় মুক্তিপ্রাপ্ত সর্বশেষ ছবি 'চিত্রাঙ্গদা' (২০১২) তেও তিনি অভিনয় করেন।
বাংলা সিনেমার সমালোচকরা এক বাক্যে তাঁকে সত্যজিত-ঋত্বিক-মৃণাল সেনের উত্তরসূরী বলে মেনে নিয়েছেন। তবে স্বয়ং ঋতুপর্ণ নিজের মাথার ওপর এই উত্তরসূরী হবার চাপটা রাখতে চাননি। তাঁর নিজের কথায়, "বিশ্ব সিনেমার ইতিহাসে যদি ৫০০ জন পরিচালকের নাম লেখা হয়, তাতে আমি আসব না। তা হলে কেন আমি আমার যা ইচ্ছে তাই করব না। তা হলে আমি কেন ঝুঁকি নেব না।" তিনটি ভাষায় ছবি বানিয়েও ঋতুপর্ণ বাংলা ভাষাতেই তাঁর স্বাচ্ছন্দের কথা স্বীকার করে নিয়েছেন, "মাতৃভাষায় সিনেমা নির্মাণ করেও আন্তর্জাতিক পরিচালক হওয়া সম্ভব। আমি বাংলায় খুব সাচ্ছ্যন্দ বোধ করি। নতুন প্রজন্মের অনেকেই তাদের মাতৃভাষার মূল হারিয়ে ফেলতে বসেছে। কিন্তু আমার অবস্থা সেরকম নয়, আমার বাংলার মূল খুব শক্ত।"
ঋতুপর্ণের জীবনে বিতর্কের সংখ্যাও কম ছিল না। একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে 'ঘোষ এন্ড কোম্পানি' নামে একটি টক শো-তে সঞ্চালক মীর ওরফে মীর আফসার আলি-র সাথে তাঁর সাক্ষাৎকার যথেষ্ট বিতর্ক সৃষ্টি করে। পুরুষ হয়েও নারীর পোশাকে সাজিয়ে রাখতে ভালোবাসতেন নিজেকে। এ ব্যাপারে তাঁর বক্তব্য, "আমার সাজ পোশাকটাই যদি আমার এক্সিসটেন্স হয়। আমার আমিটা হয়। তা হলে একটু মুশকিল। আমার বরাবরই মনে হয়েছে, আমার সাজপোশাক যাই করি না, একটাই তো জীবন। আমি পুনর্জন্মে বিশ্বাস করি না। আমার যে ভাবে জীবনটাকে সেলিব্রেট করতে ইচ্ছে হয় করি। আবার যখন ইচ্ছে হয় করি না।" একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও এ সমাজ 'মেয়েলি পুরুষ'দের আলাদা চোখে দেখতে ভালোবাসে। তাদের নিয়ে ব্যঙ্গ করতে ভালোবাসে। ঋতুপর্ণ ঘোষ কোথাও গিয়ে তাদের একটা প্রতিবাদের ভাষা হয়ে দাঁড়ালেন। শেষ জীবনে শারীরিক ভাবেও নারী হয়ে উঠতে চেষ্টা করেছিলেন তিনি।
একটি সাক্ষাৎকারে তিনি নিজেই বলেন, "কোনও পুরুষের মধ্যে একটু ফেমিনিন ব্যাপার থাকলে তাকে 'লেডিজ' বলা হত। ওইটুকুই। সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশনের সঙ্গে ইক্যুয়েট করা হত না। তার পরে ধরে নেওয়া হল যাদের মধ্যে একটু কমনীয়, নারী সুলভ ব্যাপার আছে তারা সবাই 'গে'। এটা কিন্তু একটা অ্যাসাম্পশন। কেউ বলে দেয়নি যে, ও 'গে'। একটা ব্যবহার হঠাৎ করে সেক্সুয়ালিটির মার্কার হয়ে গেল। আমি অনেক বার বলেছি, লেডিজ বলছ কেন? প্লুরাল কোরো না। লেডি বলো। এই ভাবে আমি কমব্যাট করতাম ওটার সঙ্গে। তার পরে শহর একটা ফেজ পেল। সেই ফেজটার নাম ঋতুপর্ণ। আমার কিন্তু সেটার জন্য আলাদা করে অপমানিত লাগে না। আমি কিছু কথা বলেছি, যেগুলো আমাদের দেশের যৌনতা বিচারের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে কতগুলো স্টেটমেন্ট।" আসলে একজন শিল্পী কখনোই নারী বা পুরুষ নন। একজন শিল্পী শুধুমাত্র শিল্পীই।
ঋতুপর্ণ ঘোষ জীবনের শেষ এক দশক ধরে ডায়াবেটিসে এবং আধ দশক ধরে প্যানক্রিয়াটাইটিস রোগে ভুগছিলেন। অনিদ্রা রোগ তো ছিলই। সে জন্য তিনি নিয়মিত ঘুমের ওষুধ খেতেন। ডাক্তারদের রিপোর্ট অনুযায়ী, অ্যাবডোমিনোপ্ল্যাস্টি ও ব্রেস্ট ইমপ্ল্যান্টের পর প্রয়োজনীয় হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি করাতে গিয়ে তাঁর শারীরিক অসুস্থতা বেড়ে যায়। অবশেষে ২০১৩ সালের ৩০ মে কলকাতার বাড়িতেই হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে ঋতুপর্ণ ঘোষের মৃত্যু হয়।
তিনি বলতেন, "দর্শকরা আমার ব্যাপারে খুব প্রোটেকটিভ। তারা আমাকে খুব ভালবাসে। কিন্তু দে কান্ট ডিল উইথ মি অলসো।"
প্রতিবেদন- অর্ক বন্দ্যোপাধ্যায়
Post a Comment