Header Ads

কোনো মহিলার নামে ভারতের প্রথম রেল স্টেশন স্থাপন হয়েছিল এই বাংলাতেই


নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সেজদা সুরেশচন্দ্র বসুর কন্যা বিপ্লবী বেলা বসুর সঙ্গে অতীতে পরিচয় যদি না থাকে তবে জেনে রাখুন হাওড়া-বর্ধমান কর্ড লাইনে তাঁর নামেই আছে একটা রেলস্টেশন৷

নেতাজি সুভাষচন্দ্রের ভাইঝি বিপ্লবী বেলা বসুর(মিত্র) আরও একটি পরিচয় আছে অনেকের কাছে হয়তো বিষয়টি অজানা— তিনি রাজ্য মন্ত্রীসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র মহাশয়ের মা৷

চলুন আমরা বরং আজাদ হিন্দ ফৌজের সিক্রেট সার্ভিসের গল্প শুনি৷


ব্রিটিশ পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে সিক্স-এ বিপিন পাল রোডের বাড়িটির ছাদে বসানো হয়েছিল বেশ শক্তিশালী এক ট্রান্সমিটার৷ সেই ট্রান্সমিটারের সাহায্যে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর কাছে পাঠানো হচ্ছে দেশের খবর, ইংরেজদের গতিবিধি৷ আজাদ হিন্দ ফৌজের সিক্রেট সার্ভিসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন চার সুভাষ অনুগামী৷ সেখানেই চলছে নেতাজি সুভাষচন্দ্রের আইএনএ,র সিক্রেট সার্ভিসের কাজ৷

ইতিহাসের স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটির পাশে থাকতেন আর এক দিকপাল প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র মজুমদার৷

ব্রিটিশ পুলিশ গোয়েন্দাদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে দিব্যি গোপনে সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন চার সুভাষ অনুগামী৷ আইএনএ,র সিক্রেট সার্ভিসের সাথে জড়িয়ে ছিলেন বিপ্লবী বেলা মিত্র স্বয়ং৷ ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সর্বদাই কাজ করেছেন পর্দার আড়ালে থেকেই৷

বেলা মিত্র সম্পর্কে নতুন করে অনেকের জানার না থাকলেও যারা জানেন না, তারা এই দাপুটে সাহসী নারীর সাথে একটু পরিচয় করে নিন৷

বিপ্লবী হরিদাস মিত্রের সঙ্গে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন৷নিজে ছিলেন ছিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজের গুপ্তচর বিভাগের সদস্য৷ তবে স্বামী এবং নিজের পরিচয়ে বিখ্যাত হওয়ার পাশাপাশি আরও বড় পরিচয় আছে বেলা বসুর৷ নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সেজদা সুরেশচন্দ্র বসুর ছোট মেয়ে বেলা বসু, যার ভাল নাম ওমিতা বসু। কোদালিয়ার বাড়িতে ১৯২০ সালে তিনি প্রথম পৃথিবীর আলো দেখেন৷

যার কাকা স্বয়ং নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, সেই পরিবারের বিপ্লবী আন্দোলনের ঐতিহ্য নিয়ে আলোচনার ধৃষ্টতা আমাদের মানায় না৷ 

কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে এলেন সুভাষচন্দ্র বসু৷ সেখানেও কাকার সঙ্গে ভাইঝি৷ নেতাজির আইএনএ ভারতের দিকে পা বাড়াবার আগেই আজাদ হিন্দ ফৌজের ছোট ছোট দলকে গোপনে ভারতে পাঠানো হচ্ছিল, আসল লক্ষ্য ছিল আজাদ হিন্দ বাহিনী ভারতের মাটিতে পা দিলে দেশেও ইংরেজদের বিরুদ্ধে একই সাথে যুদ্ধ শুরু করবে এই দলগুলি৷ 

সুভাষ চন্দ্র বসু এবং মহাত্মা গান্ধীর অম্ল মধুর সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলে নিরন্তর৷ সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই, মহাত্মা গান্ধীর ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সুরের প্রতি বিশ্বাস হারিয়েই সুভাষচন্দ্র বসুর কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে আসা৷ কিন্তু খুব ইন্টারেস্টিং বিষয় ৪ জন সুভাষ অনুগামীর ফাঁসি রদ হয়েছিল মহাত্মা গান্ধীর চিঠিতে৷ সত্যি বলতে কি সেটা কোনও গল্পকথা নয় খাঁটি বাস্তব৷
সেই গল্প হয়তো সুভাষ-গান্ধীর ব্যক্তিগত সম্পর্কে নতুন করে আলোকপাত করবে না!

কিন্তু এই সত্যকে অস্বীকার করা যাবে না, সুভাষ অনুগামী চার বিপ্লবীর ফাঁসির আদেশ হওয়া সত্বেও সেই আদেশ রদ হয়েছিল মহাত্মা গান্ধীর চিঠিতেই৷ তাদেরই চারজনের একজন ছিলেন বিপ্লবী জ্যোতিষচন্দ্র বসু৷ তাঁর অপ্রকাশিত পাণ্ডুুলিপির উপর ভিত্তি করেই বই লিখেছেন পল্লব মিত্র৷

ব্রিটিশ পুলিশের চোখ এড়িয়ে আজাদ হিন্দ ফৌজের সিক্রেট সার্ভিসের কাজ চলছে গোপনে, তবে শেষপর্যন্ত পুলিশের হাতে ধরা পড়লেন চার সুভাষ অনুগামী৷ স্বামী ব্রিটিশ পুলিশের হাতে ধরা পড়লেও বেলা মিত্র তখনও আজাদ হিন্দ ফৌজের গোপন বাহিনীর জন্য কাজকর্ম করে যাচ্ছেন সমান দক্ষতায়৷

অর্থের অভাবে নিজের সব অলঙ্কার তিনি বিক্রি করে দিয়েছেন, কিন্তু আজাদ হিন্দ ফৌজের জন্য নিজের দায়িত্ব থেকে কখনও নিজেকে সরিয়ে নেন নি৷ বরাবর পাদপ্রদীপের আলোর নীচে থেকেছেন, নীরবে নিজের কাজ করতেন৷

ডাঃ পবিত্রমোহন রায়, অমৃক সিং গিল, হরিদাস মিত্র ও জ্যোতিষ বসু— চারজনের ফাঁসির আদেশ দেন ব্রিটিশ বিচারপতি ওরমেরোড। ১৯৪৫ সালের মে মাসে শুরু হয় সামরিক বিচার। ৩০ দিনের মধ্যেই গোটা প্রক্রিয়া শেষ করা হয়।

স্বামীর প্রাণ বাাঁচাতে গান্ধীজির সঙ্গে দেখা করার সিদ্ধান্ত নেন বেলা মিত্র৷ বিপ্লবী জ্যোতিষচন্দ্রের বাবা রঞ্জনবিলাস বসুও ছুটে এলেন কলকাতায় তাঁর কাছে, একই আবেদন নিয়ে  দু’জনেই ধরলেন গান্ধীজিকে৷ একজন বিপ্লবীর বাবা, অন্যজন নিজে বিপ্লবী আবার বিপ্লবীর সহধর্মিণী৷ দেখাও হল গান্ধীর সঙ্গে৷

গান্ধীজি তাঁদের বলেছিলেন তিনি ইংরেজদের কেউ নন, তাঁর কথা কি আর ব্রিটিশরা শুনবে! কিন্তু নাছোড়বান্দা বেলা মিত্র ও রঞ্জনবিলাস বসু৷ শেষ পর্যন্ত তত্‍কালীন ভাইসরয়কে পর পর চিঠি লিখলেন গান্ধীজি৷ অবশেষে ১৯৪৬-র মার্চে  আজাদ হিন্দ বাহিনীর সিক্রেট সার্ভিসের চার বিপ্লবীর ফাঁসির আদেশই রদ করে ব্রিটিশ সরকার৷ সে বছরই গান্ধীজির নোয়াখালির পদযাত্রায় অংশ নেন জ্যোতিষচন্দ্র ও তাঁর স্ত্রী পূরবী৷ অন্যদিকে হরিদাস মিত্র পরে রাজ্য বিধানসভার ডেপুটি স্পীকার হন৷ তবে বেলা মিত্র কখনও সক্রিয় সংসদীয় রাজনীতিতে আসেন নি৷

দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও 'ঝাঁসির রানি' নামে সেবাদল গঠন করে জনহিতকর কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকেন তিনি। তাঁর কাজের অন্যতম ছিল পূর্ববঙ্গ থেকে আগত উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা। এই সময় বালির কাছে তিনি অভয়নগরে ক্যাম্প তৈরি করে থাকতে শুরু করেন। অক্লান্ত পরিশ্রমে তাঁর স্বাস্থ ভেঙে পড়ে ও তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। অবশেষে ১৯৫২ সালে এই সাহসী নারী আকাশের তারা হয়ে চলে যান না ফেরার দেশে৷

ভারত সরকার তাঁর কৃতিত্বকে অস্বীকার করেনি, ভারতীয় রেল ভুলে যায়নি বিপ্লবী বেলা বসুর নাম৷ হাওড়া-বর্ধমান কর্ড শাখার বেলানগর রেলস্টেশনটি বেলা মিত্রের নামেই রাখা হয়৷ সেই স্টেশন উদ্বোধন করেছিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজের বেলা মিত্রের সহযোগী শাওনওয়াজ খান৷

তথ্যঋণ ও কৃতজ্ঞতা- এই সময় পত্রিকা, আনন্দবাজার পত্রিকা৷

প্রতিবেদন- অরুণাভ সেন

  

No comments