আমেরিকার প্রথম সফল বাঙালি বুদ্ধিজীবী ছিলেন ধন গোপাল মুখোপাধ্যায়
ধন গোপাল মুখোপাধ্যায় তাঁর বাচ্চাদের বই "গে নেক: দ্য স্টোরি অফ এ পিজন" - এর জন্য আমেরিকান লাইব্রেরি অ্যাসোসিয়েশনের নিউবেরি পদক অর্জন করেন। এই বইটির মূল চরিত্র হলো গায়ক নেক, যিনি তাঁর সঙ্গী হীরাকে নিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় দূত পায়রার দায়িত্ব পালন করেছিলেন। পায়রার বিচার ও দুঃসাহসিকতার মধ্যে ধন গোপাল মুখোপাধ্যায় মনুষ্য ও প্রাণীর মধ্যকার সম্পর্ক, যুদ্ধের নিরর্থকতা এবং এর স্থায়ী প্রভাবকে তুলে ধরেন এই বইতে।
ধন গোপাল মুখোপাধ্যায় হলেন প্রথম লেখক যিনি নিউবেরি পদক জিতেছিলেন, যদিও তিনি সাফল্যটি উপভোগ করতে পারেন নি। তিনি তাঁর প্রকাশক ইপি ডটনের সাথে ১৯২২ সাল থেকে প্রতিবছর নন-ফিকশন ও ফিকশন রচনা লিখতে চুক্তি করেছিলেন, যে চুক্তিটি ছিল কারও অর্জনের জন্য যথেষ্ট শ্রমের ফসল।
ধন গোপাল মুখোপাধ্যায়ের প্রথম গ্রন্থ 'রজনী' (এটি একটি কাব্য) ও দ্বিতীয়টি একটি নাটক যার নাম 'লায়লা মজনু'। তাঁর যে গ্রন্থটি পাশ্চাত্যে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে তা হলো 'এন সন অফ মাদার ইন্ডিয়া আনসার্স'। ধনগোপালের আরও যে গ্রন্থগুলি অত্যধিক জনপ্রিয়তা অর্জন করে ও যেগুলির মাধ্যমে পাশ্চাত্যের মনীষীরা ভারতবর্ষের ঐশ্বর্যে আকৃষ্ট হয়ে ভারতকে জানতে আগ্রহী হন সেগুলি হলো 'দ্য ফেস অফ সাইলেন্স', 'মাই ব্রাদার্স ফেস', 'কাস্ট এন্ড আউটকাস্ট' ও 'ভিজিট ইন্ডিয়া উইথ মি'৷
শিশু সাহিত্যেও ধন গোপাল মুখোপাধ্যায়ের দারুণ অবদান ছিল। তাঁর রচিত জনপ্রিয় শিশুগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য 'Kari the Elephant', 'Jungle Beasts and Men', 'Ghond', 'The Hunter', 'Hari', 'The Jungle Lad' ও 'The Chief of the Herd' প্রভৃতি।
ধনগোপাল মুখোপাধ্যায়ের পরিচয় তিনি কেবল লেখক ও শিশু সাহিত্যকই নন, তিনি ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রচারক। তাঁকে বলা হয় আমেরিকার প্রথম সফল বাঙালি তথা ভারতীয় বুদ্ধিজীবী। তিনি জীবনের বেশিরভাগ সময় সংগাম করে কাটিয়েছেন। ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধেও তিনি লড়াই করেছেন। একই সঙ্গে ধর্মীয় গোঁড়ামি প্রতিরোধেও তিনি মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন।
১৮৯০ সালের ৬ ই জুলাই কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন ধন গোপাল মুখোপাধ্যায়। তিনি তাঁর শৈশবকাল ও কৈশোরের দিনগুলি কেমন ছিল তা তিনি তাঁর আত্মজীবনী 'কাস্ট এন্ড আউটকাস্ট' এর প্রথম অংশে তুলে ধরেন। সেকেলে পূর্বপুরুষদের নিয়ম অনুযায়ী ব্রাহ্মণ পরিবারের ছেলেদের কঠোর রীতি ছিল এক বছরের জন্য সন্ন্যাসী জীবন পালন করা ও তিনি তাঁর তপস্বী হওয়ার অভিজ্ঞতার বিবরণের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি প্রথাগত হিন্দু সমাজের ভূমিকা, তাঁদের পিছিয়ে পড়ার ধারণা ও কঠোর নিয়মের জাল কেটে তিনি সন্ন্যাসী জীবন ত্যাগ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার জন্য চলে যান।
তিনি স্বপ্ন দেখতেন স্বাধীন ভারতের। তাই তিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের জন্য একটি গুপ্ত সমিতি তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। যে কারণে ১৯০৮ সালে তিনি এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার নাম করে জাপানে পাড়ি জমান। জাপানে কিছুকাল বসবাসের পর তিনি চলে যান সোজা মার্কিন মুলুকে। সেখানে গিয়েই তাঁর মানসিকতার পরিবর্তন ঘটে। আমেরিকাতে তিনি প্যাট নামে এক মার্কিন তরুণীকে বিবাহ করে স্থায়ীভাবে আমেরিকার নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন।
আমেরিকায় প্রতিষ্ঠা অর্জনে তাঁকে কঠোর থেকে কঠোরতর পরিশ্রম করতে হয়েছিল। অনেক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক সাহিত্যে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর অগ্রজ যদুগোপালের পরামর্শে তিনি সাহিত্যচর্চার মধ্য দিয়ে আমেরিকাবাসীদের দৃষ্টি ভারতের প্রতি আকৃষ্ট করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি তাঁর সমস্ত সাহিত্যকর্মই ইংরেজি ভাষাতেই লিখেছেন।
প্রতিবেদন- সুমিত দে
Post a Comment