চলে গেলেন বাংলার কিংবদন্তি ভাওয়াইয়া শিল্পী ধনেশ্বর রায়
উত্তরবঙ্গের ভাওয়াইয়া সঙ্গীতের বিশিষ্ট গীতিকার, সুরকার ও গায়ক ছিলেন শ্রী ধনেশ্বর রায়। 'বৈদেশা বন্ধুরে', 'একবার উত্তর বাংলা আসিয়া যান', 'হামার জাগা খান দেখিয়া যান', 'আজি গাড়িয়াল বন্ধু মোর হারেয়া গেইসে রে', 'বন্ধু বড়ো ধন', 'ও কি ও মোর গাড়িয়াল ফিরিয়ারে আইসো'র মতো একাধিক বিখ্যাত গানের স্রষ্টা ছিলেন তিনি। উত্তরবঙ্গ উৎসবের থিম সং -ও তাঁরই লেখা। লোকশিল্পে অবদানের জন্য তিনি সম্মানিত হয়েছেন 'বঙ্গরত্ন' সম্মানে।
তাঁর গানে ছিল মাটির সুর৷ জন্মভূমির প্রতি আমাদের যে একটা শিকড়ের টান রয়েছে তা তাঁর গানে ফুটে উঠতো। তিনি বাংলাকে যে কী দারুণ ভাবে ভালোবাসতেন তা তাঁর গান শুনলেই বোঝা যায়। তাঁর 'একবার উত্তর বাংলা আসিয়া যান' গানটি যেমন গোটা বাংলার কাছে বাংলার উত্তরের কথা তুলে ধরে। তিনি মাটির গান, শিকড়ের গান ও সম্পর্কের গানকেই নিজের গানের প্রধান বিষয় হিসেবে বেছে নিতেন। বৃদ্ধ বয়সেও একরাশ মুগ্ধতা লুকিয়ে ছিল তাঁর গানে।
ধনেশ্বর রায়ের জীবনে দারিদ্র্যতা ছিল নিত্য সঙ্গী। বৃদ্ধকালেও চরম অভাবে দিন কাটছিল তাঁর। ফালাকাটা শহর থেকে ১৮ কিমি দূরে জটেশ্বর ১ পঞ্চায়েতের আলিনগর গ্রামে একটি টিলের চালা দেওয়া তিন কুটরির বাড়িতে তিনি সপরিবারে থাকতেন। সারা জীবনে পাঁচশো গান লিখেছেন। তাঁর গানে বারংবার ফিরে এসেছে উত্তর বাংলার প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য, মানুষজনের সুখ-দুঃখের কথা।
বেশ কয়েক বছর ধরে অসুস্থ ছিলেন তিনি। গত বুধবার অসুস্থ বোধ করায় তাঁকে ফালাকাটার জটেশ্বর স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাঁকে ভর্তিও করানো হয় পরে। কিছুটা সুস্থ হয়ে বাড়িও ফিরে আসেন তিনি। শুক্রবার আবার হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েন ধনেশ্বরবাবু৷ সোয়াব টেস্টের তাঁর করোনা রিপোর্ট নেগেটিভ পাওয়া যায়।
শুক্রবারই সোয়াব টেস্টের পর তাঁকে ফালাকাটা সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। সেখান থেকে তাঁকে রেফার করা হয় উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে। শনিবার গভীর রাতে শিলিগুড়ি নিয়ে যাওয়ার পথে অ্যাম্বুলেন্সেই তাঁর মৃত্যু হয়৷ মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর। তাঁর মৃত্যুতে শোকাহত সাংস্কৃতিক মহল। তাঁর মৃত্যুতে ভাওয়াইয়া সঙ্গীত জগতের একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হলো।
তাঁর পরিবার সূত্রে জানা গেছে বার্ধক্যজনিত কয়েকটি কারণে কিছুদিন ধরে তিনি একেবারেই খাবার খেতে পারছিলেন না। খাবার খেতে প্রচণ্ড সমস্যা হচ্ছিল তাঁর। এর ফলে আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। উত্তরবঙ্গ তথা গোটা বাংলার ভাওয়াইয়া জগতের স্বনামধন্য শিল্পীর অসুস্থতার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর সমগ্র শিল্পী মহল ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ছিল। সকলে মিলে হাজার চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারলেন না তাঁকে। জীবনদীপ নিভে গেল শিল্পী ধনেশ্বর রায়ের।
প্রয়াত শিল্পীর পুত্র জানান, "রাত আড়াইটা নাগাদ বাবার মৃত্যু হয় তিস্তা সেতুর কাছে। ফালাকাটায় আইসিইউ না থাকায় প্রথমে আলিপুরদুয়ারে জেলা হাসপাতালে রেফার করা হয়। সেখানে জায়গা না থাকায় শিলিগুড়ি রেফার করা হয়৷ কিন্তু অর্ধেক রাস্তা যেতে না যেতেই বাবার মৃত্যু হয়।"
ধনেশ্বর রায়ের প্রয়াণের খবর ছড়িয়ে পড়তেই এদিন শিল্পীর বাড়িতে তাঁর বহু ছাত্রছাত্রী, অনুরাগী তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। তবে করোনার জন্য অনেকেই ধনেশ্বরবাবুকে শেষ দেখাও দেখতে পাননি।
প্রতিবেদন- সুমিত দে
Post a Comment