চলচ্চিত্রের আলোকে চিদানন্দ দাশগুপ্ত, এক বিস্মৃতপ্রায় নাম
যদি বলি অপর্ণা সেনকে চেনেন? সিনেমাপ্রেমী বাঙালি একযোগে উত্তর দেবেন, মিস ক্যালকাটা, 1976 বা মেমসাহেব কে চিনবো না তা কি হয়! কিন্তু যদি বলি চিদানন্দ দাশগুপ্তকে চেনেন? এই সিনেমাপ্রেমী বাঙালির অনেককেই গালের দাড়ি চুলকে গুগল বাবার শরণাপন্ন হতে হবে। কিংবা যদি বলি জীবনানন্দ দাশকে চেনেন বা সত্যজিৎ রায়কে চেনেন? আপনাদের উত্তর কী হবে তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু ওই যে চিদানন্দ বাবুর সঙ্গে এদের আবার কী সম্পর্ক! কী ফাঁপরে পড়লেন তো! আসুন জেনে নেওয়া যাক, খ্যাতির আড়ালে থাকা ভারতীয় তথা বাংলা চলচ্চিত্রে বিশেষ অবদান রাখা এই বিশেষ মানুষটি সম্পর্কে। চলুন তাহলে একদম গোড়া থেকে শুরু করা যাক।
সবার পরিচিত অভিনেত্রী ও চিত্র পরিচালক অপর্ণা সেনের বাবা হলেন এই চিদানন্দ দাশগুপ্ত। আবার অপর্ণা দেবীর মা অর্থাৎ চিদানন্দ দাশগুপ্তের স্ত্রী সুপ্রিয়া দেবী হলেন কবি জীবনানন্দ দাশের দাদা ব্রহ্মানন্দ দাশগুপ্তের কন্যা। এবার আসি সত্যজিৎ রায়ের কথায়। সত্যজিৎ এবং চিদানন্দ ছিলেন অন্তরঙ্গ বন্ধু।১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের উত্তাল সময়ের পটভূমিতে লেখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'ঘরে বাইরে' উপন্যাস অবলম্বনে সত্যজিৎ রায় তৈরি করেছিলেন একই নামের ছবি। প্রধান চরিত্রে ছিলেন ভিক্টর ব্যানার্জী, স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সত্যজিত রায় পরিচালিত এই ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৮৪ সালে। কিন্তু তারও প্রায় চার দশক আগে ঘরে বাইরে উপন্যাস অবলম্বনে ছবি করার কথা ভেবেছিলেন সত্যজিৎ। সেটা ১৯৪৭ সাল। সত্যজিৎ ও তাঁর বন্ধু চিদানন্দ দাশগুপ্ত মিলে তৈরি করলেন ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি। সঙ্গে ছিলেন বংশী চন্দ্রগুপ্ত ও আর পি গুপ্ত। কলকাতায় আন্তর্জাতিক ছবি, বিশেষ করে ইউরোপীয় নিয়ো-রিয়ালিস্ট সিনেমা দেখার পীঠস্থান হয়ে ওঠে এই সংস্থা। বাংলা ছবির বহু বিশিষ্ট পরিচালকই ছিলেন এই সংগঠনের সদস্য।প্রসঙ্গক্রমে জানিয়ে রাখি, নিখিলেশ-বিমলা-সন্দীপের গল্পকে বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে নিয়ে এসে অপর্ণা সেন তৈরি করেছেন 'ঘরে বাইরে আজ'। বাংলাদেশে ব্লগার খুন, গৌরী লংকেশ হত্যা, কাশ্মীরে সাংবাদিকদের প্রশাসন বিরোধী সন্দেহে থানায় তুলে নিয়ে আসা, ক্রমবর্ধমান উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি, 'মুসলমানরা পাকিস্তানে যাক', ইত্যাদি ঘটনায় চোখ সয়ে যাওয়া আমাদের অপর্ণা সেন আরো একবার বৃন্দা, নিখিলেশ আর সন্দীপের জটিল রসায়নের মধ্য দিয়ে তুলে ধরতে চেয়েছেন এই ছবির মাধ্যমে। যাক, যে কথা বলছিলাম, পরে ১৯৫৯ সত্যজিৎ রায় ও চিদানন্দ বাবু মিলে তৈরি করেন 'ফেডারেশন অফ ফিল্ম সোসাইটিজ অফ ইন্ডিয়া'। এটি বর্তমানে 'ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অফ ফিল্ম সোসাইটি'র সঙ্গে যুক্ত।
আরো এক প্রথিতযশা বাঙালি বিজ্ঞানী প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবীশের সঙ্গে জড়িয়ে আছে চিদানন্দ দাশগুপ্তের নাম। হাজারীবাগের বিখ্যাত হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক মন্মথ দাশগুপ্তের জ্যৈষ্ঠপুত্র চিদানন্দ ১৯৪০ সালে 'ভারত ছাড়ো' আন্দোলনের সময় হাজারীবাগ সেন্ট কলম্বিয়া কলেজের অধ্যাপনা ছেড়ে পাকাপাকি ভাবে চলে আসেন কলকাতায়। কলকাতার ইন্ডিয়ান স্টাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটে প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবীশের সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরে সিটি কলেজে অধ্যাপক হিসেবেও যোগ দেন।
তবে শুধু এইসব বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের নামের সঙ্গে তাঁর নাম জড়িয়ে আছে বলে তাঁকে নিয়ে আলোচনা করছি এমনটা নয়, তাঁর নিজস্ব প্রতিভাগুণে সাহিত্য, চলচ্চিত্রের বিভিন্ন বিভাগে বিপুল অবদানের জন্য তিনি আপন স্বাতন্ত্র্যে সমুজ্জল। ঊননব্বই বছরের যাপিত জীবনে তিনি দুই হাজারের বেশি সিনেমা বিষয়ক প্রবন্ধ লিখেছেন। ১৯৫৭ সালে তিনি এবং সত্যজিৎ রায় 'ত্রৈমাসিক ইন্ডিয়ান ফিল্ম' পত্রিকা চালু করেন। ব্রিটিশ ম্যাগাজিন 'সাইট এন্ড সাউন্ড' এর আর্কাইভে তাঁর চলচ্চিত্র বিষয়ক প্রবন্ধগুলি সংরক্ষিত হয়েছে। ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়ার সুবাদে সত্যজিতের সিনেমা সম্পর্কে বিশদ তথ্যের ভিত্তিতে ১৯৮০ সালে লিখেছেন 'দা সিনেমা অফ সত্যজিৎ রায়' বইটি। ২০০৪ সালে তাঁর সিনেমা সংক্রান্ত কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ওসিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে তাঁকে 'লাইফটাইম এচিভমেন্ট' সম্মানে সম্মানিত করা হয়। শুধু তাই নয় পরিচালক হিসেবে মোট সাতটি সিনেমা বানিয়েছেন চিদানন্দ দাশগুপ্ত। আমোদিনী, বিলেত ফেরত, জরুরত কি পুত্রী ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজ।
তবে শুধুমাত্র চলচ্চিত্র পরিচালক, চলচ্চিত্র সমালোচক বা চলচ্চিত্র গবেষক হিসেবে নয় ইংরেজি অনুবাদ সাহিত্যেও তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তিনি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা সাফল্যের সঙ্গে অনুবাদ করেছেন। তাঁর অনুদিত জীবনানন্দের 'বনলতা সেন' কবিতার শেষ কটা লাইন এইরকম....
The raven wipes the smell of warm sun
From its wings; the world's noises die.
And in the light of fireflies the manuscript
Prepares to weave the fables of night;
Every bird is home, every river reached the ocean.
Darkness remains; and time for Banalata Sen.
২০১১ সালে আজকের দিনে কলকাতায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। প্রয়াণ দিবসে স্মরণ করি ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতের মহীরুহ চিদানন্দ দাশগুপ্তকে।
প্রতিবেদন- সুকমল মাইতি
Post a Comment