Header Ads

চিত্রকলার কারুকার্যে জঙ্গলমহলের খোয়াবগাঁ যেন রূপকথার দেশ


শালের জঙ্গলঘেরা লালমাটি বেষ্টিত এক অপরূপ গ্রাম হলো 'খোয়াবগাঁ'। চিত্রকলার ক্যানভাসে ভেসে আছে এই গ্রাম। ঝাড়গ্রামের মধ্যে অবস্থান এ গ্রামের। কোনো এক স্বপ্নের জাদুকর যেন তুলির টানে ভরিয়ে তুলেছে গ্রামের শান্তির নীড়গুলোর দেওয়াল। শিল্পের মোহমায়ায় সকল আপনভোলা মানুষ একবার হলেও বাধ্য এখানকার মাটিতে চরণ ঠেকাতে। রূপকথার রঙে রাঙানো আস্ত একটা গ্রাম৷ এই গ্রামের আসল নাম হলো লালবাজার। কলকাতার লালবাজারের সঙ্গে এর নাম গুলিয়ে ফেললে মস্ত বড়ো ভুল হবে৷ 


ঝাড়গ্রাম স্টেশন থেকে মাত্র ৪ কিমি পথ অতিক্রম করলেই চোখে পড়বে 'খোয়াবগাঁ'। শালবীথির আড়ালে লোধা সম্প্রদায়দের ছোট্ট গ্রাম হলো লালবাজার। যেখানে সারিবদ্ধ ভাবে নানাবিধ চিত্রের সমাহারে টিনের চাল যুক্ত কুঁড়েঘর শান্তিতে বিরাজমান। রং-তুলির ছোঁয়াতে হঠাৎ করেই একদা ভরে ওঠে লালবাজার গ্রাম। লালবাজার নামটির সাথে পুলিশি গন্ধের মিল আছে বলে গ্রামবাসীদের কথামতো বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক শিবাজী বন্দোপাধ্যায় এই গ্রামের নাম পাল্টে রাখেন 'খোয়াবগাঁ'। 

চিত্রময় এই 'খোয়াবগাঁ' তে ঢুঁ মারলে আপনার চোখ জুড়িয়ে যাবে রং আর রেখাচিত্রের বাহারে৷ চোখের পাতায় ধরা দেবে প্রতিটি মাটির বাড়ির দেওয়াল চিত্র, নকশা ও আল্পনা। লোধা জনগোষ্ঠীর জীবনের নানান মুহূর্ত, লোকগাথা, পরম্পরা ও গল্প ফুটে উঠেছে মাটির বাড়ির দেওয়ালে দেওয়ালে। লোধা সম্প্রদায় সমন্বিত এই ছোট্ট জনপদটির রূপ পরিবর্তনের পিছনে অবদান রয়েছে 'চালচিত্র অ্যাকাডেমি' নামের এক অলাভজনক সংস্থার। চালচিত্র অ্যাকাডেমির কর্ণধার মৃনাল মণ্ডলের ভাবনাতে তৈরি হয়েছে 'খোয়াবগাঁ'। স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে নিয়ে 'চালচিত্র অ্যাকাডেমি' নিজেদের মতো করে ছবিছাবাতে ভরিয়ে দেয় বাড়ির দেওয়ালগুলো। কোনো রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী প্রচারের জন্য তারা দেওয়ালগুলো ব্যবহার করতে দেননি।


এখানে দিনমজুরির অবসরে চিত্র অঙ্কন করেন ষষ্ঠী আহির, গোবিন্দ আহির ও ভূপতি মল্লিকরা। বনের শুকনো গাছের শিকড়-বাকল দিয়ে তারা বানিয়ে ফেলেন কুটুম-কাটাম। তাঁদের সন্তান-সন্ততিরাও মাটির বাড়ির দেওয়ালের ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলে ফুল, লতাপাতা৷ ভ্রমণপ্রিয় রসবেত্তা বাঙালির এখন নতুন ঠিকানা এই 'খোয়াবগাঁ'। আজ থেকে বছর তিনেক আগে এখানকার মানুষ কর্মসংস্থানের তেমনভাবে সুযোগ পেতেন না। দিনমজুর, পাতা সংগ্রহ ও পাতা বিক্রি করে সংসার চলতো লালবাজার গ্রামের বেশিরভাগ মানুষদের। 'চালচিত্র অ্যাকাডেমি'র হাত ধরে আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে এই গ্রামের।

অসহায় ভাবে দিনকাটানো মানুষগুলোর আকল পড়ে যাওয়া হাতগুলো এখন মনের আনন্দে শিল্পকর্ম তৈরি করে৷ 'খোয়াবগাঁ' এখন শিল্পের আঁতুড়ঘর। কোনোরকম সরকারি সাহায্য ব্যতীত গ্রাম বদলের কাজে চালচিত্র অ্যাকাডেমির পাশে দাঁড়িয়েছেন দেশ-বিদেশের নামী শিল্পীরা। 

'চালচিত্র অ্যাকাডেমি'র কর্ণধার মৃণাল মণ্ডল লিটারেসি প্যারাডাইসের প্রতিনিধিকে জানান "বর্তমানে এখানে দেওয়াল আঁকার কাজ ও বিভিন্ন ওয়ার্কশপ চলছে। কিছুদিন আগে এখানে বাটিকের ওয়ার্কশপ হলো। তারপর স্ট্যান্ড ক্র্যাফটিং এর একটা ওয়ার্কশপ হলো, মাইন এর একটা ওয়ার্কশপ হলো। এরপর গালা পুতুলের একটা ওয়ার্কশপ হবে। এভাবে প্রতিনিয়ত ওয়ার্কশপ তো চলছেই। দেওয়ালে এখন নতুন করে আঁকার কাজ চলছে। গ্রামের পঁচিশ জনের মতো বাচ্চা তাদের মধ্যে পনেরো থেকে ষোলোজন শিশু তারা সবাই দেওয়ালে আঁকাআঁকির কাজ করে। ওরা কখনো নিজের থেকেও দেওয়ালে ছবি আঁকে। আবার যেসব বাইরের শিল্পীরা এখানে কাজ করছেন তাদের নির্দেশমতোও ওরা ছবি আঁকে। আর বিভিন্ন জায়গা থেকে শিল্পীদের আনাগোনা তো লেগেই আছে৷" 


জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত পরিচালক প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য 'খোয়াবগাঁ'র কথা শুনেছেন৷ করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তিনি এখানে আসবেন। 'খোয়াবগাঁ' নিয়ে তাঁর কাজ করারও ইচ্ছে আছে৷ গতবছর  দক্ষিণেশ্বরের একটা দুর্গাপুজোর থিম হিসেবে 'খোয়াবগাঁ'র কথা উঠে এসেছিল। মৃণালবাবুরা চান আরো বেশি বেশি করে শিল্পরসিক ও গুণগ্রাহীরা খোয়াবগাঁয়ের উত্তরণের সঙ্গী হোক। ভবিষ্যতে শিল্পের গ্রাম হিসেবে গোটা বাংলাকে পথ দেখাবে জঙ্গলমহলের 'খোয়াবগাঁ'। বিন্দুকে সিন্ধু করে তোলার অসীম ক্ষমতা একমাত্র শিল্পের মাঝেই বিদ্যমান৷ 'খোয়াবগাঁ'র মধ্য দিয়ে লালবাজার গ্রামের মানুষজন শিক্ষার মূল্য ধীরে ধীরে আয়ত্ত করে ফেলছেন৷ মৃণালবাবু দশম শ্রেণির ছাত্রী পূজা আহির ও একাদশ শ্রেণির ছাত্রী দীপা আহিরকে আর্ট কলেজের ভর্তির প্রবেশিকা পরীক্ষার জন্য তৈরি করছেন। মৃণালবাবুদের মতো ব্যক্তিদের ছায়াতলে এসে ওখানকার লোধা সম্প্রদায়ের মানুষদের সম্মান বহুগুণ বেড়ে গেছে। 

প্রতিবেদন- সুমিত দে  


No comments