Header Ads

কেন আমার গুরু নচিকেতা?


"একদিন সব নিভে যাবে তবু  থেকে যাবে সময়, অপেক্ষারা দিনে রাতে জানায় সংশয় পাহারা তুমি দিয়েই আছো বাংলাকে কবে থেকে শুধু মন ছায় ফেলে অব্যয় তুমি আসবে বলে।" 


বসে থাকা রাত দিন একাকার করে উৎসবের মতোই তারাদের গান আমাকে দিয়েছে অসীম আকাশ। মনে আছে পুরানো বাড়ির ছাদে কতো রাত জেগে বসে থাকতাম, শব্দের জন্য। কখন যে ভোর হতো, বাড়ির শিউলি তার সুবাসিত ছন্দে আমাকে আমারই হাতে তুলে দিতো শব্দ। উজানের গান। আজানের গান। বিখ্যাত সময়ে আমি জন্মাইনি তাই বিখ্যাত হওয়ার ভয়ও আমার নেই। আছে শুধু এই  সময়ের সব কিছুকে ধরে রাখার ইচ্ছে নিজের মতো করে আনকোরা শব্দে চোখের ঝাঁপসা তারায়। 

থমকে থাকিনি কোনো দিন। সেই স্কুলজীবন থেকেই তো "এই বেশ ভালো আছি"... একার থেকেও বড়, সব্বার হয়ে বাঁচা... একার থেকেও দামি অন্যের মুখে একটুকরো হাসি ফেরানো। বাবা শিখিয়েছিলো, ঠিক সময় কথা বলার দাম একটাকা আর চুপ করে থাকার দাম দুটাকা... সেই দু'টাকাই সম্বল আজও আমার। লেখার আর পড়ার অভ্যেস তৈরী করেছিলো মা। বাংলা গান বা গানের সাবলীলতা একপক্ষ নিয়েই এগোচ্ছিলো কিন্তু এক মুখ দাঁড়ি একটা রোগা পাতলা লোক সব যেন  ওলোটপালোট করে দিলো।  রাতের পর  রাত  টেপ রেকর্ডারের শুনছি সময়ের গান... 'চল যাবো তোকে নিয়ে', 'তালাদের গান', 'মাদারীর গান', 'নীলাঞ্জনা', 'স্বাধীনতা', 'পৌলোমী', 'প্রেসমেকার' কতো কতো গান... এক একটা পরমাণু বোমা। বুঝতে পারছি বাংলা গান স্বাধীনতা পাচ্ছে। ধাপার মাঠের উপর এক কিশোরকে আকাশ চেনাচ্ছেন, যিনি... তিনি নচিকেতা ছাড়া আর কেই বা হতে পারে??  মনে আছে হাওড়ার শরৎসদনে তখন মাসে প্রায়ই শো হতো নচিকেতার। সব কটা শো হাউসফুল। একটাও শো মিস করিনি কোনো দিন। সাথী আমি আর আমার মা। ফ্রন্ট রো.. প্রতিবার.. সেবার শুভমিতাদি আর নচিকেতা একসাথে। আমি কোনো রকমে ভীড় ঠেলে গ্রীনরুমে গেছি যদি একটা অটোগ্রাফ পাওয়া যায়। যাইহোক গিয়ে পৌঁছলাম.. এবং যথারীতি টেনশনে পেন আর ডাইরি নিয়ে যেতেই ভুলে গেছি। সেদিন আমি একটি হোয়াইট ডেনিম জিনস পরেছিলাম। এখনও মনে আছে আমি আমার ওই সাদা ডেনিমে নচিদার অটোগ্রাফ নিয়েছিলাম এবং উনি যখন মঞ্চে এলেন প্রথমে আমাকে সামনে দেখে একটা স্নেহের চুম্বন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন। এই যাত্রা শুরু আরোও আন্তরিক ভাবে এই মানুষটার সাথে। ওই প্যান্টটা আজও আমার রাখা আছে যত্নে। আর ধুইনি কোনো দিন পরিও নি আর।

তারপর সামনাসামনি বলতে ওই শো দেখা আর ভিতরে ভিতরে পথ চলা... 

প্রায় কুড়ি বছরের বেশি সময় কেটে গেছে এইতো গত রাতের ঘটনা একটা নতুন গান লিখেছি। সুমন কে দিয়ে সুর করিয়েছি, ঠিক করলাম রেকর্ড করবো। মৈনাকদা আররেঞ্জমেন্ট করছে। রাতে দমদম ফিরছি একসাথেই ট্রেনে। হঠাৎ বলে উঠলো, অভিজিৎ এই গানের জাস্টিফিকেশন যদি কেউ করতে পারে তবে সে একমাত্র নচিকেতা। শুনলাম এবং  আরো একটা ভাবনা নিয়ে ফিরলাম। মনে আছে ঠিক পরের দিন মানে শুক্রবার সন্ধ্যে তখন ছয়টা বাজে প্রায় পৌনে একঘন্টা ধরে দাদাকে ফোন করার চেষ্টা করে গেছি। কতবার যে ডায়াল করে ফোন কেটেছি তা কেবল আমিই জানি। কিন্তু সাহসে কুলায়নি শেষমেষ বুকে বল নিয়ে ফোন করেই ফেললাম এবং ওপারে আমার ঈশ্বরের আওয়াজ শুনলাম, "হ্যাঁ কে?" বললাম, দাদা আমি একটা অন্যায় কাজ করে ফেলেছি তোমার জন্য একটা গান লিখে ফেলেছি যদি শোনো. কথা কেড়ে নিয়ে বললো, বেশ করেছিস। রাত নয়টা নাগাদ  ফোন করতে বললো... কেনো না দাদা স্মার্ট ফোন ব্যবহার করেন না সর্বোপরি এই ফোন ব্যাপারটাই খুব বিরক্তিকর দাদার কাছে। যে মানুষ তা সময়ের থেকেও স্মার্ট তার কি আর স্মার্ট ফোনের দরকার পড়তে পারে? নচিকেতা নিজেই একটা ট্ৰেণ্ড.. যায় হোক করলাম ফোন তখন আমার ফোনে চার্জ মাত্র নয় পার্সেন্ট। একজনের নাম্বারে গানটা পাঠাতে বললেন এবং পাঠালাম ঠিক নয়টা কুড়ি  মিনিটে ওই দিক থেকে রিপ্লাই এলো এবং একটা প্রশান্তির স্বরে বললেন, এই গান উনিই গাইবেন পরের দিনই যেতে বললেন। ব্যাস আমার ফোন টাও সুইচ অফ হয়ে গেলো। ব্যাটারি শেষ। ওই মুহুর্তটা সারা জীবন আমার কাছে থেকে যাবে। মৈনাক দা বলেছিলো তুই কি করে আপ্রোচ করলি দাদা কে?? আমি এতো বছর ওই মানুষটার সাথে ছিলাম, আমি কিন্তু পারিনি। কিভাবে বা কোন সাহসে আজও কথা বলি আমি জানি না। তবে উনি মানুষ চেনেন বোঝেন কার নাব্যতা বা ভালোবাসা, সততা কতোটা। নচিদা যতটা কঠিন তার থেকেও একটা নরম নদী তার ভিতরে বহমান। সেই দিন সারা রাত আমি ঘুমাতে পারিনি এক মহাজাগতিক আনন্দে। নচিদা বলে সব কিছুই প্রিফিক্সিড। তৈরী হলো "বেঁচে থাক" অন্তত আমার জীবনের সেরা গান। সে গল্প আরেক দিন বলবো।  মনে আছে দাদা এই গানটা প্রায় তিনমাস পর গেয়েছিলো। সে সময়ে অতিরিক্ত শো এর কারণে তাড়াহুড়ো করতে চাননি। এমনই মানুষ তিনি। শুনেছিলাম বলেছিলেন নাকি এতো যত্ন নিয়ে বানানো এই গান উনি কিভাবে আনজাস্টিফাই করবেন? সে এক দারুণ অভিজ্ঞতা আমার জীবনে। আসলে নচিকেতা এমনই একজন মানুষ যারা সব্বাই তার বাইরেটা বিচার করেন। আমি তার সংস্পর্শে এসে যা পেয়েছি তা অমূল্য আমার কাছে। আমি যখন সিক্সে পড়ি সত্যজিৎ রায় আমাকে আমার জন্মদিনে ওনার সই করা বই উপহার দিয়েছিলেন আর বড় বেলায় নচিকেতা'র মতো মানুষের সংস্পর্শ  পেয়েছি। এজীবন পূর্ণ আমার। অনেক গুলো কাজ তারপর করছি নচিদার সাথে।ওনার কাছে বকা খাওয়া মানে আমার জীবনবোধ শুধরে যাওয়া। পন্ডিত মল্লার ঘোষ কেও যুক্ত করতে পেরেছি নচিকেতা ঘরানার সাথে এ আমার পরম স্বপ্ন পূরণ। খুব সাধারণ আর শব্দ কর্মী আমি এই বিশাল বটছায়া আমাকে প্রতিদিন ছায়া শ্বাস বায়ু দিচ্ছে.... দেয়।

আমি আমার আয়নাকে আজ বলতে পারি, আমার কেউ না থাকুক আমার নচিকেতা আছে।

আমি বাংলায় বসে আমার সৌভাগ্য হয়েছে কুনাল গাঞ্জাওয়ালা, জুবিন গর্গ শিল্পীদের সাথে কাজ করার। সেই গান পরে রিলিজও হবে। কিন্তু সারা ভারতবর্ষের সমস্ত শিল্পী একদিকে আর নচিকেতা চক্রবর্তী একদিকে থাকবেন। উনি নিজেই বিশ্বচরাচর আমার কাছে। ওনার দর্শনই ওনার জ্ঞান, অভিব্যক্তি.. আমার কাছে নচিকেতা গায়ক নন একজন দার্শনিক।

তাই তাঁকে আমি আমার একমাত্র গুরু বলে মানি 
কারণ একটাই, উনি যোগ্য, গুরু হওয়ার। 

প্রতিবেদন- অভিজিৎ পাল 

No comments