Header Ads

সাহসী বাঙালি বণিকদের বিশ্বব্যাপী প্রভাবই বঙ্গোপসাগরকে বঙ্গের নামে করে তুলেছিল


বঙ্গ ও বাঙালির কতটা প্রভাব ছিল তা বঙ্গোপসাগরের নাম দেখেই অনেকটা আন্দাজ করা যায়। বঙ্গোপসাগরের তীরে কলিঙ্গ, ব্রহ্মদেশ, কাঞ্চিপূরম এরকম বহু জায়গাই অবস্থিত তা সত্বেও বাংলার নামেই হয়েছে বঙ্গোপসাগরের নাম যা থেকে অনেকটাই পরিষ্কার যে বাংলার প্রভাব ঐ সব জায়গাগুলির চেয়ে অনেক বেশি ছিল। যেমন আরবের প্রভাবের জন্য হয়েছে আরবসাগর বা চীনের প্রভাবের জন্য চীন সাগর একইভাবে বাংলার নামে বঙ্গোপসাগর।

স্বাভাবিক ভাবেই এখন প্রশ্ন জাগতে পারে যে বঙ্গ ও বাঙালির প্রভাব কত পুরানো?

বঙ্গ ও বাঙালির প্রভাব কত পুরানো এখন সেটাই বোঝার চেষ্টা করবো। মঙ্গলকাব্যের মধ্যে সবচেয়ে পুরানো কাব্য হল মনসামঙ্গল যা পঞ্চদশ শতকের দিকে লেখা হয়েছিল। এই কাব্যে গাঁঙুড়ের জলে বেহুলা ও লখীন্দরের কাহিনী পাওয়া যায়, বিখ্যাত বণিক চাঁদ সদাগরের সপ্তডিঙা ডুবে যাওয়ার কাহিনী পাওয়া যায়। সুতরাং মনসামঙ্গল যখন রচিত হচ্ছে সেই পঞ্চদশ শতকের আগের থেকেই যে বাঙালি বণিকদের প্রভাব ছিল তার একটা অনুমান পাওয়া যায়। চন্ডীমঙ্গল কাব্যে কবি মুকুন্দরাম লিখেছেন- 'সপ্তগ্রাম থেকে বণিকেরা কোথায় না যায়?' সুতরাং বাঙালির বণিকরা যে সারা বিশ্বেই যেত তা বলাই বাহুল্য।  

তাছাড়া সুশীল চৌধুরীর 'ফ্রম প্রস্পারিটি টু ডিক্লাইন' বইতে মিরজাফরের রাজত্বকালে অর্থাৎ ১৭৬০ এর দিকে মেদিনীপুরে ৩০০০ খানা লবণের কারখানার উল্লেখ পাওয়া যায় যা সারা বিশ্বে রপ্তানী করা হত। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে এসব কারখানা একদিনে গড়ে ওঠেনি তাই বাংলার প্রভাব এতেও অনেকটা পরিষ্কার হয়।

তাছাড়া চতুর্দশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে বাংলায় আগত মরক্কোর পর্যটক ইবন বতুতা তার কিতাবুর রেহালায়' সোনারগাঁওয়ে তৈরি সুতি বস্ত্রের বিশেষ প্রশংসা করেন। আকবরের সভাসদ আবুল ফজল তাছাড়া পঞ্চদশ শতকে আগত চীনের পর্যটকরাও মসলিনের প্রশংসা করেছেন। সুতরাং বাংলার বাণিজ্য যে ছশো থেকে সাতশো বছরের পুরানো এ বিষয়ে খুব একটা সন্দেহ নেই।

তাছাড়া শেরশাহ (রাজত্বকাল ১৫৪০-১৫৪৫) জিটি রোড নির্মাণ করেন যা বাংলাদেশের সোনারগাঁও পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল সুতরাং বাংলার সাথে উত্তর ভারতীয় শাসকদের যোগাযোগ স্থাপনের কারণ সহজেই অনুমেয়।

চীনের পরিব্রাজক হিউ এন সাং ৬২৯ খ্রীস্টাব্দে ভারতে আসেন। ওনার বিবরণে তাম্ব্রলিপ্ত বন্দরের উল্লেখ পাওয়া যায়। ওনার বিবরণ অনুযায়ী- ‘সমতট থেকে পশ্চিম দিকে ৯০০ লি পথ পাড়ি দেয়ার পর এসে পৌঁছলাম তান মো লি তি বা তাম্রলিপ্তি রাজ্যে। রাজ্যটি আকারে ১৫০০ লির মতো। রাজধানীর আয়তন ১০ লি। নিয়মিত চাষবাস চলে। প্রচুর ফল ও ফুলের ছড়াছড়ি এখানে। এখানে দশটির মতো সংঘারাম আছে, হাজার খানেক ভিক্ষুর বাস। দেবমন্দির আছে পঞ্চাশটির মতো। নানা সম্প্রদায়ের লোকেরা এখানে মিলেমিশে বাস করছে। দেশটির উপকূল ভাগ একটি সমুদ্র খাঁড়ি দিয়ে বেষ্টিত। জল ও ভূমি যেন একে অপরকে আলিঙ্গন করছে এখানে। প্রচুর দামী দামী জিনিস এবং রত্নসামগ্রী এখান থেকে সংগৃহীত হয়। এজন্য এলাকার অধিবাসীরা বেশ ধনী।'

সুতরাং 'দামী দামী জিনিস এবং রত্নসামগ্রী এখান থেকে সংগৃহীত হয়' এ থেকে মোটামুটিভাবে ধারণা করাই যায় বাঙালির বাণিজ্য তখনও ছিল।

বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তৃতির ইতিহাস দেখলে দেখা যায় একাদশ শতকে অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। তিনি ১০১১ সালে শতাধিক শিষ্যের সাথে মালয়ের (ইন্দোনেশিয়া) সুবর্ণদ্বীপ (সুমাত্রা দ্বীপ) গমন করেন এবং ধর্মপালের কাছে বারো বছর ধরে বৌদ্ধধর্মের অধ্যয়ন করেন এবং সেখান থেকে ফিরে এসে বিক্রমশিলা মহাবিহারে অধ্যাপনা করেন। সুতরাং এটা পরিষ্কার যে বাংলার সাথে নিশ্চই অন্য দেশেরও খুব ভালো যোগাযোগ ছিল।

অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতকে পাল সাম্রাজ্যের সাথে আরব, তিব্বতের সাথে বাংলার সুসম্পর্ক ছিল। পাল যুগে মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে বাংলার ব্যবসা বৃদ্ধি পায় ফলে এই সময়েই বাংলায় ইসলামের আগমন ঘটেছিল। পাল প্রত্নস্থলগুলিতে আব্বাসীয় মুদ্রা পাওয়া গিয়েছে। তাছাড়া আরব ইতিহাসবিদদের রচিত নথিপত্রেও পাল সাম্রাজ্যের সঙ্গে তাদের দেশের বাণিজ্যিক ও বৌদ্ধিক যোগাযোগের উল্লেখ পাওয়া যায়। বাগদাদের আব্বাসীয় খিলাফতের সঙ্গে তাদের সুসম্পর্ক বজায় ছিল।ইরাকের বাগদাদের বিখ্যাত গ্রন্থাগার বাইতুল হিকমাহ এই যুগেই ভারতীয় সভ্যতার গাণিতিক ও জ্যোতির্বিজ্ঞান-সংক্রান্ত কীর্তিগুলির সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল। সুতরাং বাংলার বাণিজ্যিক যোগাযোগ প্রায় বারোশো বছরের পুরানো তা নিশ্চিত।

বাংলার বণিকদের চেয়েও বেশি প্রভাব ছিল এমন দাবী কেবলমাত্র চোল রাজাদের পক্ষেই হয়তো করা সম্ভব কারণ ওনারা ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১২৭৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন এবং বঙ্গোপসাগরকে চোল হ্রদে পরিণত করেছিলেন তাদের নৌবাহিনীর ক্ষমতার জোরে। কিন্তু আরব, ইউরোপ, চীনে চোলদের বাণিজ্য ছিলনা যার ফলে বাঙালি ব্যবসায়ীদের প্রভাব যে তাদের চেয়ে বেশি ছিল তা বলাই বাহুল্য। বঙ্গোপসাগরকে হয়তো তখনই বহির্বিশ্বে বঙ্গোপসাগর হিসেবে জেনেই গিয়েছিল নইলে হয়তো চোল উপসাগর নামেই পরিচিত হতো।

যদিও বাঙালির যে সমুদ্রপথে খ্রিস্টপূর্বাব্দ তিনশো শতকের আগেও বহির্বিশ্বে যোগাযোগ ছিল তারও প্রমাণ দেওয়া যায় রাজকুমার বিজয়ের সিংহের শ্রীলঙ্কা দখলের ইতিহাস থেকে। বিজয় সিংহ ছিলেন বাংলার রাজা সিংহবাহুর পুত্র। যিনি বাংলা থেকে নির্বাসিত হলে বঙ্গদেশ থেকে সাতটি জাহাজ নিয়ে লঙ্কাদ্বীপে পাড়ি দেন এবং সেখানে রাজত্ব স্থাপন করেন খ্রিস্টপূর্বাব্দ ৫৪৩ সালে। সুতরাং বাংলার সাথে জল পথে যোগাযোগ যে অন্য প্রদেশের সাথে ছিল এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। হয়তো আরো নথি কালের নিয়মে হারিয়ে গেছে। প্রায় ২৫০০ বছর ধরে যে বাংলার মানুষ নৌপথে সারা বিশ্বের সাথে যোগাযোগ ছিল তাদের দ্বারাই এ সাগরের নাম বঙ্গোপসাগর নামে ছড়িয়ে পড়েছিল।

তথ্যসূত্র- হিউয়েন সাঙ ভ্রমণকাহিনী, ভাষান্তর; খুররম হোসাইন, শব্দগুচ্ছ, ঢাকা, ২০০৩, পৃ. ৮৯; From Prosperity to Decline- Sushil Choudhuri; Raj Kumar (২০০৩) Essays on Ancient India। Discovery Publishing House. 

No comments