Header Ads

স্মৃতির সারণিতে থেকে যাওয়া হাওড়ার অত্যন্ত প্রিয় যান মার্টিন রেল


সৃষ্টি মানেই তো একদিন সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। আজকে বাংলায় যা আছে কালকে হয়তো তা থাকবে না। কত কিছু চলে যাবে আবার কত কিছুই না ফিরে আসবে। পুরানো বস্তু হারিয়ে গেলে মানুষের অন্তরে তা স্মৃতি হয়ে ডায়েরির পাতাতে থেকে যায়। প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে সকল প্রকার সৃষ্টি ধ্বংস হয়ে যাবে। তবুও মানুষের চেষ্টা যদি সেই সৃষ্টিকে অনন্তকাল ধরে টিকিয়ে রাখা যায়। সৃষ্টি ও ধ্বংসের লীলাখেলা কখনো থামবার নয়। থাক সে জটিল তত্ত্ব। এইসব তত্ত্ব ফেলে চলুন একটু বাংলার প্রাচীন জনজীবনে ফিরে যাওয়া যাক। 


একদা আমাদের বাংলার গর্ব ছিল মার্টিন রেল, যাকে বাংলার ঘরোয়া রেলও বলা চলে। হাওড়াবাসীদের প্রাণ ছিল এই ট্রেন। হাওড়া শহর থেকে শিয়াখালা রুটে হাওড়া জেলাতে চলতো মার্টিন রেল।  কলকাতা নগরীর অভ্যন্তরস্থ ও পারিপার্শ্বিক অনুন্নত অঞ্চলগুলোর যোগাযোগ ব্যবস্থাকে উন্নত করে তুলতে প্রচলন ঘটে মার্টিন রেলের। জগৎ বিখ্যাত ইঞ্জিনিয়ার ও  বাঙালি শিল্পপতি স্যার রাজেন মুখার্জি ছিলেন মার্টিন রেলের মালিক। তখনকার সময়ে হাওড়াতে মার্টিন রেলপথই ছিল প্রধান পথ। এক কামরা বোঝাই করে বাদুড়ঝোলা অবস্থায় যাত্রীরা শিয়াখালা অভিমুখে রওনা হতো। 

বহুকাল আগেকার কথা। শোনা যায়, হাওড়ার তেলকল ঘাট থেকে মার্টিন রেলের যাত্রা শুরু হয়, যার নাম হাওড়াঘাট (তেলকল ঘাট) স্টেশন৷ আজ থেকে ৪০ বছর পূর্বে লিলুয়ার দিক থেকে হাওড়া স্টেশনগামী টিকিয়াপাড়া বা সাঁতরাগাছির দিক থেকে হাওড়া স্টেশনগামী ব্রডগেজ রেল এলে, ডানপাশে প্রাচীরের ওপাশে 'হাওড়া ময়দান' লেখা মার্টিন রেলের টার্মিনাস স্টেশনের হলুদ বোর্ডটি দেখা যেত। ঐ রেলপথের উল্লেখযোগ্য স্টেশনগুলো হলো -- বলুহাটি, চন্ডীতলা জংশন, মশাট। তার মধ্যে স্টেশন ছিল --- যেমন কুমীরঘোড়া, কলাছড়া, কৃষ্ণরামপুর, জঙ্গলপাড়া। মশাটের পর সূচিয়া। লোকে বলত ছুঁচে। শেষ স্টেশন শিয়াখালা।

এই হাওড়া-শিয়াখালা শাখা ছাড়াও হাওড়া-আমতা শাখা লাইন ছিল। হাওড়া ঘাট থেকে এসে কদমতলা-তে জংশন। ওখানেই শিয়াখালা শাখার সঙ্গে বিভাজন। পুনরায় যার প্রশাখা বিভাজন চন্ডীতলায়। কদমতলা জংশন থেকে আমতাগামী লাইনটি বড়গাছিয়া এসে সেখান থেকে ১৬ মাইল দূরে চাঁপাডাঙার পথে চলে যায় আরও একটি প্রশাখা। এই প্রশাখায় জগৎবল্লভপুর এবং ইচ্ছানগরী উল্লেখযোগ্য স্টেশন। আর আমতার পথে চলতে মাকড়দহ, ডোমজুরের পরেই এই বড়গাছিয়া জংশন ছিল। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি জায়গা মুন্সিরহাট স্টেশন। এই সব স্থানগুলোতে এখন কলকাতার ট্রাম কোম্পানি সিটিসি র বাস চলাচল করছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে একসময়ে হাওড়া তেলকল ঘাট বা হাওড়া ময়দান থেকে মার্টিন রেল যোগাযোগ রেখেছিল চারপ্রান্তে চারটি জনপদের সঙ্গে ---- আমতা, চাঁপাডাঙা, শিয়াখালা ও জনাই।  

দীনেন গুপ্তের ছবি 'নতুন পাতা' ও অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের ছবি 'ধন্যি মেয়ে'র শ্যুটিং হয়েছিল এই মার্টিন রেলে। আমতার প্রত্যন্ত  গ্রামে তৈরি মাদুর দুটো কামরাতে বোঝাই করে মার্টিন রেল কলকাতা রওনা দিত। দাশনগর যে শেফিল্ড আখ্যা পেয়েছিল তার প্রধান সূত্র আমতা ও মার্টিন রেল। শনিবারে বাড়ি গিয়ে আবার সোমবারে সব কাজের লোকে জায়গায় ফিরত৷ লোকে টিকিট কম কাটত তাই কোম্পানি মার্টিন রেলে ভেন্ডার কামরা বেশি দিত। 

হাওড়াবাসীর কাছে এই ট্রেন ছিল আপনজনের মতো। কারও বাড়ির পাশ দিয়ে, কারও বাগানের ভেতর, কারও পুকুর পাড় এবং দামোদর ও সরস্বতী নদীর পাড় ঘেসে ইঞ্জিনের কালো ধোঁয়া ছেড়ে এগিয়ে চলতো মার্টিন রেল। এই ট্রেনে চড়ার মজাই ছিল আলাদা। ১৯৭১ সালে পাকাপাকিভাবে বন্ধ হয়ে যায় মার্টিন রেল। এই ট্রেন বহন করেছিল দেশ স্বাধীন ও বঙ্গভঙ্গের গল্প। বাংলার নিজস্ব বেসরকারি ট্রেন ছিল মার্টিন রেল। যার প্রধান কারণ হিসেবে দায়ী করা হয় আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা, মার্টিন রেল সম্প্রসারণের অভাব, ও যাত্রী সংখ্যা প্রভূত হারে কমে যাওয়া। অতীতের বাংলার মার্টিন রেলের দারুণ অভিজ্ঞতার কথা আজও সেই সময়ের বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের মুখে শোনা যায়। সেই গল্পগুলো যেন আজকে রূপকথা। 

তথ্যসূত্র- আমাদের ছোটো রেল (রমেশ দাস) 

প্রতিবেদন- সুমিত দে

1 comment:

  1. রমেশ বাবুর বই থেকে এই ট্রেন সম্পর্কে জানতে পারি

    ReplyDelete