হাওড়ার হারিয়ে যাওয়া প্রাচীন অস্থায়ী বন্দর বেতড় নিয়ে কিছু কথা
হাওড়ার ইতিহাস কলকাতার ইতিহাসের থেকেও প্রাচীন। হাওড়ার বিভিন্ন অঞ্চলের সাথে জড়িয়ে আছে নানান ঐতিহ্য। আধুনিক কলকাতা শহর গড়ে ওঠে প্রধানত সুতানুটি, গোবিন্দপুর ও কলিকাতা গ্রাম তিনটিকে কেন্দ্র করে। অথচ এই তিনটি গ্রামের বাইরেও কলকাতায় ও হুগলি নদীর অপর পাড়ে হাওড়ায় মোট চারটি বর্ধিঞ্চু অঞ্চলের অস্তিত্ব ছিল। যেগুলি হল চিৎপুর, সালকিয়া, কালীঘাট ও বেতড়। অধুনা বাংলার প্রধান অন্যতম বাণিজ্যবন্দর ছিল বেতড়। অতীতে শিবপুর সংলগ্ন অঞ্চলকে বলা হতো বেতড়।
বেতড় ছিল এক অস্থায়ী বন্দর। মোগলরা আসার পূর্বেই এখানে পণ্যবোঝাই জাহাজের মাল খালাস হতো৷ সেই সময় হাওড়া ও হুগলি ছিল বর্ধমান রাজার অধীনস্থ। ১৭৯৫ সালে তৈরি হয় হুগলি জেলা। এর আরো পরে ১৮৪৩ সালে হাওড়া জেলার মর্যাদা পায়। এরপর ১৯৩৮ সালে হাওড়া পূর্ণাঙ্গ জেলার মর্যাদা পায়। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ায় হাওড়াতে জাহাজ নির্মাণও হতো। শুধু বাণিজ্যই নয়, টোল, সংস্কৃতিচর্চা, সঙ্গীতচর্চা, পূজার্চনা ইত্যাদি কাজেও হাওড়ার খ্যাতির কথা জানা যায়। একসময় শিল্প-বাণিজ্য সমৃদ্ধ হাওড়া পরিচিত ছিল ভারতের ম্যাঞ্চেস্টার নামে।
বেতড় বলতে এখন বোঝায় বাকসারার অন্তর্গত একটি ভূভাগ। শিবপুরের সানা পাড়ার দক্ষিণে শালিমারের নিকট জি.টি রোড ও আন্দুল রোডের সংযোগস্থলে বেতাইচণ্ডীর মন্দির। চাঁদ সদাকর বাণিজ্য যাত্রার পথে নেমে বেতাইচণ্ডীর পুজো করেছিলেন। এইসব দেখে ষোড়শ শতাব্দীর বেতড় বন্দরের কোনো ধারণাই করা যায় না। এ প্রসঙ্গে ১৩৪১ বঙ্গাব্দের সাহিত্য পরিষদ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রবন্ধে কালিদাস দত্তের মন্তব্য--- "গোবিন্দপুরে মহারাজা লক্ষ্মণ সেনের যে তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হইয়াছে তা দ্বারা তিনি বর্ধমান ভুক্তির অন্তর্গত বেতড্ড-চতুরকের অধীন বিড্ডর শাসন নামে একখানি গ্রাম ব্যাসদেব শর্মা নামক এক জনৈক ব্রাহ্মণকে দান করিয়াছিলেন। উহাতে প্রদত্ত ভূমির নিম্ন-লিখিতরূপ চতুঃসীমা দেওয়া আছে -- দক্ষিণে লেংঘদেব মণ্ডপী সীমা উত্তর -- ধর্মনগরী সীমা, পূর্ব- জাহ্নবী সীমা এবং পশ্চিম ডালিম্ব-ক্ষেত্র সীমা। এই চতুঃসীমা হইতে বুঝা যায় যে বর্ধমান ভুক্তির অন্তর্গত বেতড্ড-চতুরক নামক বিভাগটি পূর্বদিকে জাহ্নবী বা ভাগীরথী নদী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। উক্ত বেতড্ড-চতুরক বর্তমান হাওড়া জিলার অন্তর্গত বেতড় নামক স্থান এবং উহারই নামানুসারে ঐ চতুরক প্রসিদ্ধ হইয়াছিল।"
ষোড়শ শতাব্দীতে সরস্বতী-দামোদরের মিলিত জলস্রোত বেতড়ের কাছে গঙ্গায় পতিত হয়ে নদীর গভীরতা বাড়িয়ে দিত৷ পর্তুগীজদের বড় বড় সমুদ্রগামী জাহাজগুলি এখানে এসেই নোঙর করত। এখান থেকে মাল খালাস করে ছোট ছোট জলযানে ভর্তি করে সেগুলি সপ্তগ্রাম বন্দরে নিয়ে যেত এবং সেখান থেকে মাল এনে বড় বড় জাহাজে ভর্তি করা হতো। জায়গাটি আগে বেতবনে ঘেরা ছিল বলে সংস্কৃতে বেত্রধারা নামকরণ হয়েছিল -- যার অপভ্রংশ বেতড়।
১৪৯৫ খ্রিস্টাব্দে বিপ্রদাস পিপলাই রচিত 'মনসা বিজয়' কাব্যে এর বর্ণনা আছে-
'ডাহিনে কোতরং কামারহাটি বামে।
পূবেতে আড়িয়াদহ ঘুসুরি পশ্চিমে।।
তাহার পূর্বকূল বাহি এড়ায় কলিকাতা।
বেতড়ে চাপায় ডিঙ্গা চাঁদ মহারথা।'
এর পরে ১৬ শতকের মাঝামাঝি কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী লিখলেন 'চণ্ডীমঙ্গল' কাব্যে-
'ত্বরায় বাহিয়া তরী তিলেক না রয়।
চিৎপুর শালিখা সে এড়াইয়া যায়।।
কলিকাতা এড়াইল বেনিয়ার বালা।
বেতড়েতে উত্তরিল অবসান বেলা।।
বেতড়ে চণ্ডীপূজা কৈল সাবধানে।
সমস্ত গ্রামখানা সাধু এড়াইল বামে।।'
বেতড় শুধু বাণিজ্যিস্থলই নয়, ধর্মস্থলও। সম্ভবতঃ পালবংশীয় বৌদ্ধ নরপতিগণের রাজত্বের শেষভাগে বেতড়ে শক্তি উপাসনার এই উপপীঠ আবিষ্কৃত হয়ে গঙ্গা-সরস্বতী সঙ্গমকে তীর্থস্থানে পরিণত করেছিল। সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে সরস্বতী নদী থেকে রূপনারায়ণ ও আদিগঙ্গার মুখ পৃথক হয়ে যাওয়ার ফলে অতীতের নামকরা বাণিজ্য বন্দর বেতড় অবলুপ্ত হয়ে যায়।
তথ্যসূত্র - হাওড়া জেলার ইতিহাস (অচল ভট্টাচার্য), বাংলার চালচিত্র, হাওড়া জেলার পুরাকীর্তি (অমিয় কুমার বন্দোপাধ্যায়)।
প্রতিবেদন- সুমিত দে
Post a Comment