মদনমোহন ভৌমিককে সরকারি স্বীকৃতি স্বরূপ দেওয়া হোক প্রাপ্য সম্মান, দাবী তাঁর পরিবারের
বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার ঢাকা জেলার সভাপতি পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন দেশনায়ক সুভাষচন্দ্র বসু। তাঁর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ছিলেন বিপ্লবী মদনমোহন ভৌমিক। আমরা অনেকেই জানি না এই মহান বিপ্লবীকে। আন্দামান সেলুলার জেলে তাঁকে নির্মমভাবে অত্যাচার করা হতো। বরিশাল ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত হিসেবে আন্দামানে দশ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে তাঁকে দণ্ডিত করা হয়েছিল।
১৯০৫ সালে বিপ্লবী মদনমোহন ভৌমিক অনুশীলন দলে যোগ দেন। ১৯১৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন তিনি চতুর্থ বর্ষের ছাত্র ছিলেন তখন বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার কারণে তাঁর কারাবাস হয়। যদিও পুলিশ প্রমাণের অভাবে মামলা তুলে নেয়। পুলিশ মামলা তুলে নেওয়ার পর তিনি নাটোরের নিকট হাঁপানিয়া গ্রামে আত্মগোপন করেন। হাঁপানিয়া গ্রামে ছিল অনুশীলন দলের একটি গোপন ডেরা। এই সময়কালে তিনি সেখানকার একটি স্কুলে সাময়িক শিক্ষকতা করতেন৷
পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর বারদির বাড়িতে মদনমোহন ভৌমিক আত্মগোপন করেছিলেন। মদনমোহন ভৌমিকের হাতে সর্বদা অস্ত্র থাকতো। দরকার পড়লে তিনি অস্ত্রটি লুকিয়ে রাখতেন। কোনো কারণে পুলিশ সেই অস্ত্র রাখার কথা জানতে পেরে যায়, তাই সেই বাড়িতে এসে চিরুনী তল্লাশি চালাতে থাকে। পুলিশ তল্লাশি চালানোর সময় জ্যোতি বসুর মা হেমলতা বসু অস্ত্রটিকে নিজের শাড়ির মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলেন। অথচ বিপ্লবী মদনমোহন ভৌমিকের এমনই দুর্ভাগ্য যে ১৯১৪ সালে পুলিশ অসুস্থ অবস্থায় তাঁকে গ্রেপ্তার করে। এরপর আন্দামানে টানা দশ বছর ব্রিটিশদের অকথ্য অত্যাচার কাটিয়ে তিনি মুক্তি পান। জেল থেকে মুক্তি পাবার পরও তিনি বিপ্লবের সাথে যুক্ত থাকেন। দেশভাগের পর তিনি রাজনৈতিক জীবন থেকে অবসর নেন।
মদনমোহন ভৌমিকের পরিবার বর্তমানে দুর্গাপুরের বাসিন্দা। মদনমোহন ভৌমিকের পরিবার তাঁর প্রকৃত সম্মানের সরকারি স্বীকৃতির দাবী জানাচ্ছেন। মদনমোহন ভৌমিকের প্রপৌত্র দেবরাজ ভৌমিক লিটারেসি প্যারাডাইসকে জানান "১৯২৮ সালে চিত্তরঞ্জন দাশের অনুপ্রেরণায় নেতাজীকে সভাপতি করে একটি সশস্ত্র বিপ্লবী দল গঠিত হয়েছিল। যে দলের কাজ ছিল অত্যাচারী ব্রিটিশ প্রশাসকদের খুন করা এবং অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে যে পূর্ণ স্বরাজ অর্জন করা সম্ভব হচ্ছিল না সেটা উপলব্ধি করে সংহিংস আন্দোলনের পথে নামা। সেই দলটির নাম হলো বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স। অবিভক্ত বাংলা মানে পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলাভিত্তিক বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্সের কিছু কমিটি তৈরি করা হয় এবং তার সভাপতি নির্বাচনও করা হয়। চট্টগ্রামের যুগ্ম সভাপতি ছিলেন মাস্টারদা সূর্য সেন ও অম্বিকা চক্রবর্তী। আর ঢাকা জেলার যুগ্ম সভাপতি ছিলেন মদনমোহন ভৌমিক ও জ্ঞান মজুমদার।
১৯১৪ সালে বরিশাল ষড়যন্ত্র মামলায় আন্দামান সেলুলার জেলে ১০ বছরের জন্য তাঁকে কারাবাসে পাঠানো হয়। এখান থেকে মুক্তি পাওয়ার পরও তিনি একাধিক রাজনৈতিক কার্যকলাপে লিপ্ত হয়ে আবারো ধরা পড়েন। তারপর তাঁকে আলিপুর সংশোধনাগারে ৫ বছরের জন্য কারাদণ্ডিত করা হয়।
এই মদনমোহন ভৌমিকের আমি প্রপৌত্র। মানে আমার ঠাকুরদার নিজের কাকা ছিলেন মদনমোহন ভৌমিক। তিনি অবিবাহিত ছিলেন। তাই এনার কোনো সন্তানসন্ততি নেই। সেই সূত্রে আমরাই এনার রক্ত সম্পর্কীয় বংশধর। মানে আমার দাদুর বাবারা ছিলেন দুই ভাই। আমার দাদুর বাবার নিজের ভাই ছিলেন মদনমোহন ভৌমিক। ওনার জন্ম ১৮৮৪ সালে৷ ১৯৫৯ সালে স্বাধীনতার ঠিক বারো বছর পর ১৮৮৪ সালে ঢাকার ডুমনিতে যেখানে তাঁর জন্ম হয়েছিল সেই গ্রামেই তাঁর মৃত্যু হয়। জ্যোতি বসু যখন মুখ্যমন্ত্রী পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তখন পুরানো রাইটার্সে বিভিন্ন মনীষীদের সাথে তাঁরও রাখা ছিল। এখন জানিনা রাইটার্স থেকে মহাকরণ নবান্নে উঠে যাওয়ার পরও ওনার ছবিটা আছে কিনা। আমার দাদু কালিপদ ভৌমিক দেখে এসেছিলেন যে রাইটার্সে তাঁর ছবি ছিল।
স্বাধীনতা সংগ্রামী পরিবারের সদস্য হয়েও আমরা কোনো সরকারি অনুদান পাইনি। আমাদের মূলত দাবী, জওহরলাল নেহেরু যিনি নেতাজীর পুরো ব্যাকগ্রাউন্ডটাকে হাপিস করে দিয়েছিলেন নিজের গদির স্বার্থে। বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার বলুন, আজাদ হিন্দ ফৌজ বলুন এগুলো তো নেতাজীর সাফল্যের নেপথ্যে ছিল। নেতাজী যদি ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হতেন তাহলে এনারা কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার বিভিন্ন মন্ত্রকে মন্ত্রী হয়ে থাকতেন। যেহেতু ষড়যন্ত্র করে নেতাজীকে হাপিস করে দেওয়া হয়। সেহেতু তাঁকে পালাতে বাধ্য করা হয় এ দেশ ছেড়ে। জওহরলাল নেহেরুর চক্রান্তের জন্য এনারা যোগ্য স্বীকৃতি পাননি। সেই জায়গাতেই আমার লড়াই। এনাকে প্রাপ্য সম্মান দেওয়া হোক সরকারি ভাবে, রাজ্য সরকার হোক বা কেন্দ্র সরকার সেটা তাঁকে দেওয়া হোক। তাঁর পরিবারের বংশধর হিসেবে আমাদের সংরক্ষণের আওতায় আনা হোক।"
সরকারের কাছে বিপ্লবী মদনমোহন ভৌমিকের পরিবারের মতো এমন দাবী তোলা নতুন কোনো বিষয় নয়, বহু স্বাধীনতা সংগ্রামী আজও এদেশে প্রাপ্য সম্মান পাননি৷ স্বাধীনতার এতো বছর পরেও এদেশে স্বাধীনতার সঠিক মূল্যায়ন হয়নি।
প্রতিবেদন- সুমিত দে
Post a Comment