Header Ads

কফি হাউসের ঐতিহ্য কী হারিয়ে যাচ্ছে?


"কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই, আজ আর নেই। কোথায় হারিয়ে গেল সোনালি বিকেলগুলো সেই আজ আর নেই।" এই গানটি আজকের কফি হাউসের অবস্থার সাথে অনেকটাই মিলে যায়। কলেজ স্ট্রিটের এক প্রখ্যাত ঐতিহাসিক স্থান হলো কফি হাউস। কবি, সাহিত্যিক, অধ্যাপক, লেখক, শিল্পী, ছাত্র-ছাত্রী ও স্বনামধন্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সকলের জন্য আড্ডার উপযুক্ত স্থল ছিল কফি হাউস। কে আসেন নি এখানে? বিশ্ববরেণ্য পরিচালক সত্যজিৎ রায়, মৃনাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, দেশনায়ক নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন, জনপ্রিয় কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, কিংবদন্তি সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সকলেরই পদচিহ্ন জড়িয়ে রয়েছে কফি হাউসের সাথে।  


প্রতিষ্ঠার সময়কাল থেকেই কফি হাউসে জমজমাট আড্ডা জমতো। এক কাপ কফি খেতে বিকেলবেলার দিকে লোকেরা ভিড় জমাতেন কফি হাউসে। কফি খেতে খেতে কেউ কেউ বাংলা কবিতা নিয়ে চর্চা করতেন, কেউ টেবিলে বসে বই পড়তেন, কেউ সিনেমার স্ক্রিপ্ট নিয়ে আলোচনা করতেন, কেউ রাজনৈতিক চর্চা করতেন, কেউ গানের আসর জমাতেন, কেউ জীবনের উত্থান-পতনের গল্প করতেন, কেউ নাটক নিয়ে  আলোচনা করতেন, কেউ কেউ চলচ্চিত্র বিশ্লেষণ করতেন। সেকেলে কফি হাউসে পা রাখলেই মনে হতো কফি হাউস যেন বিদ্বজনদের আঁতুড়ঘর। সময়ের স্রোতে আড্ডার এক তীর্থক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে এই কফি হাউস। 

সঙ্গীতশিল্পী মান্না দের 'কফি হাউসের আড্ডাটা' গানের চরণগুলির মধ্যেই প্রমাণ পাওয়া যায় যে কফি হাউসের আড্ডাগুলো কতটা স্বর্ণময় ছিল। যেমন "কবি কবি চেহারা কাঁধেতে ঝোলানো ব্যাগ, একটা কবিতা তার হলো না কোথাও ছাপা, মুছে যাবে অমলের নামটা, পেলনা সে প্রতিভার দামটা"। 

কফি হাউসের সেই আড্ডাগুলো আজকে ম্লান হয়ে গেছে। কফি হাউসের পেয়ালাগুলো সেকেলের মতোই ভরে থাকে। চেয়ার-টেবিলও লোকেদের ভিড়ে গমগম করে। কফি হাউসে নানান চরিত্রের আসা-যাওয়া চলতেই থাকে। কফি হাউসের আসবাবপত্রের কোনো পরিবর্তন হয়নি। কত কত ঘটনারও সাক্ষ্য বহন করে চলেছে কফি হাউস। কিন্তু বইপড়া, সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে আড্ডা, কবিতা নিয়ে আলোচনা এগুলো আজকাল কফি হাউসে লক্ষ্য করা যায় না। এমনকি বাংলা ভাষার অস্তিত্বও যেন মুছে যেতে শুরু করছে কফি হাউসে যা যথেষ্ট চিন্তার বিষয়। 

গণমাধ্যমের যুগে ছোটো থেকে বড়ো সব বয়সের মানুষই কেবল ব্যস্ত স্মার্টফোনে। এর সাথে ওর সাথে চ্যাটিং, ভিডিও কলিং, গেম খেলা, ফেসবুকে ও হোয়াটসঅ্যাপে স্ট্যাটাস দেখা, ইন্সটাগ্রামে ফটো আপলোড করা এসবের মধ্যেই বর্তমান সময়ের লোকেদের দিন কেটে যায়। আজকে কফি হাউসে ঢুকে প্রতিটি লোককে একটু নজর দিয়ে দেখলে দেখা যায়, একশো জনের মধ্যে নব্বই জনই স্মার্টফোন নিয়ে ব্যস্ত। আড্ডা চলছে বটে। তবে সেই আড্ডাতে কথা কম স্মার্টফোনে নজর বেশি। কফি হাউসের রঙিন আড্ডাটা কোথাও না কোথাও গিয়ে সত্যি সত্যিই যেন হারিয়ে গেছে। জাপান, জার্মানি বা রাশিয়াতে থাকা কফি হাউসের মতো হলগুলিতে এই ঘটনা কিন্তু ঘটছে না এই স্মার্টফোনের যুগেও। যে কারণেই হয়তো উন্নত দেশের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাও বিভিন্ন অ্যাপস বা গেমস বানিয়ে চলেছে আর আমাদের মতো পিছিয়ে পড়া দেশগুলোর ছেলেমেয়েরা সেই গেমগুলি খেলে সময় নষ্ট করছে। 

কফি হাউসে এখন তো খুব কম লোককেই বই পড়তে আসতে দেখা যায়। এখন আর লোকে আড্ডা দিতে খুব একটা এখানে আসেন না। কফি খেতে ও একটু মুখরোচক খাবার খেতেই বেশিরভাগ লোক এখন এখানে আসেন। আর দু'একজন একটু সময় কাটাতে কফি হাউসে বসেন। কেউ কেউ আড্ডা দিতে এলেও স্মার্টফোনের মধ্যেই হারিয়ে যান। 

স্মার্টফোনকে সঠিক কাজে আমরা কেউই ব্যবহার করতে পারি না বলেই জীবন থেকে আমাদের সেরা মুহূর্তগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। একে অন্যের সাথে আমরা স্মার্টফোনের জন্য মেলামেশা করতে ভুলে যাচ্ছি। পরিবারের লোকেদের সাথে সময় কাটাতে ভুলে যাচ্ছি। আড্ডা দিতেও ভুলে যাচ্ছি। স্মার্টফোনের যে একেবারেই প্রয়োজন নেই এটা বলাও ভুল। স্মার্টফোন ব্যবহার করা অবশ্যই দরকার আছে তবে সারাক্ষণ স্মার্টফোন ব্যবহার করা থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে। কফি হাউসের যে আড্ডাগুলো হারিয়ে গেছে আমরা চাইলেই তা ফিরিয়ে আনতে পারি কিন্তু সেই চেষ্টা আর কজনই বা করছে৷ বাবা-মা থেকে সরকার, শিক্ষক সমস্ত শ্রেণীর মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে ও সচেতন হতে হবে এবং আমাদের বাংলার হৃৎগৌরব ফিরিয়ে আনতে হবে।  

প্রতিবেদন- সুমিত দে

No comments