Header Ads

যেভাবে নামকরণ হয় হাওড়া জেলার


পশ্চিমবঙ্গের একটি গুরুত্বপূর্ণ  জেলা হলো হাওড়া। হুগলী নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত এই জেলা গ্রামীণ ও শহর দুইভাগে বিভক্ত। হাওড়া জেলার নামকরণের পিছনে কোনো ঐতিহাসিক প্রামাণ্য নথি না থাকলেও নানান যুক্তি ও জনশ্রুতির সংমিশ্রণে তৈরি হয়েছে বেশ কিছু আনুমানিক ধারণা। হাওড়া নামকরণের পিছনে নানা জনের নানান মত রয়েছে। কোন মতটা সত্যি  তা স্পষ্ট করে বলা বেশ কঠিন। 


জনশ্রুতি হোক বা নানা যুক্তি হাওড়া জেলার মানুষ তথা রাজ্যের মানুষদের অবশ্যই জানতে ইচ্ছে করে যে হাওড়া নামটা এলো কোথা থেকে? হাওড়া নামকরণের পিছনে নানা জনের যে নানা যুক্তি ও জনশ্রুতি রয়েছে সেগুলোর বিষয়ে একটু নজর রাখা যাক। 

ডাঃ নীহাররঞ্জন রায়ের মতে, 'হাওড়া' কথাটির শেষে 'ড়া' শব্দটি দ্রাবিড় ভাষার চিহ্ন, যে ভাষায় 'হাওড়' শব্দের অর্থ জলা জায়গা। হাওড়া জেলার একাংশ একসময় দলিলপত্রে পরগণা বোরো বলে উল্লিখিত হতো। বোরো শব্দের অর্থ জলমগ্ন জায়গা। মালীপাঁচঘড়ার নিকট একটি বৃহৎ কর্দমাক্ত অঞ্চলটির সাধারণ অভিধেয় ছিল 'হাওড়'। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে শুধু হাওড়া শহরের অন্তর্গত ৮ পূর্ণ ১ এর ২ বর্গ মাইল এলাকায় খানা ডোবার সংখ্যা ছিল ১৮০০ টি। বাংলায় আর্যবসতি  বিস্তারের পূর্বে যে আদিম অধিবাসীদের সন্ধান পাওয়া যায়, তার মধ্যে দ্রাবিড় জাতির লোকেরাই হয়তো এ অঞ্চলে ছিল সংখ্যা গরিষ্ঠ এবং অসংখ্য খাল, বিল, দহ, ডোবা ও জলা জায়গার অস্তিত্ব হেতু দেশটির নামকরণ করেছিলেন হাওড়া। 

প্রখ্যাত ভাষাবিদ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর The Origin and Development of the Bengali Language গ্রন্থে বাংলা শব্দের 'ড়া' প্রত্যয়টি সম্পর্কে বিশদভাবে আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছেন এটি অস্ট্রিক ভাষা গোষ্ঠীর শব্দ। 'ড়া' প্রত্যয়টির উৎপত্তি 'ওড়াক' শব্দ থেকে হতে পারে -- যার অর্থ বাড়ী। জলা জায়গার বাড়ী অর্থে হাওড়া। অর্থাৎ হাওড়+ড়া= হাওড়া। কোল ভাষা গোষ্ঠীতে 'আড়া' শব্দের অর্থ বাঁধের পাড়। পুকুরের আড়া মানে পুকুরের পাড়-- জল ঘিরে রাখার জন্য উঁচু ডাঙ্গা বা বাঁধ। শ্রীসুহৃদ কুমার ভৌমিকের উক্ত মত সমর্থন করে শ্রীতারাপদ সাঁতরা সিদ্ধান্ত করেছেন হারিয়া নয় অঞ্চলটির নাম ছিল হাড়িয়াড়া -- হাড়ি বা হাঁড়ি+আড়া-- যার অপভ্রংশ হাওড়া। 

ভাষাতাত্ত্বিক সুকুমার সেনের মতে, 'হাওড়া' শব্দটি ধ্বন্যাত্মক শব্দ থেকে ব্যুৎপন্ন হয়েছে; এর অর্থ "যেখানে কেবল জল-কাদা।" হাওড়া জেলার নামকরণ করা হয়েছে জেলার জেলাসদরের নামে।

হাওড়া নামকরণের পিছনের কারণ হিসেবে কেউ কেউ মনে করেন 'হাওড়া' শব্দটির অর্থ "যে নিচু বা অবনত অঞ্চলে বর্ষার জল সঞ্চিত হয়।" হাওড়ার ভূমিরূপ এই জাতীয় ছিল বলে অঞ্চলটির এইরূপ নামকরণ হয়। 

আবার অনেকে এটাও বলে থাকেন যে অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে ঔরঙ্গজেবের প্রপৌত্র ফারুকশিয়ার যখন দিল্লীর বাদশা এবং দেওয়ান মহম্মদ হাদী যখন ঔরঙ্গজেব প্রদত্ত মুর্শিদকুলী খাঁ উপাধি নিয়ে বাংলায় নবাবী করছেন তখন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী গঙ্গানদীর পূর্বতীরের তেত্রিশটি গ্রামের সঙ্গে পশ্চিম তীরের উপরোক্ত পাঁচটি গ্রামের লীজের জন্য বাদশাহ সমীপে আর্জি পেশ করেন। কোম্পানির কাউন্সিলের বইয়ে গ্রাম পাঁচটির নামের বানান লেখা আছে -- Salica, Harrirah, Cassundeah, Ramkrisnapur এবং Battor.

বার্ষিক খাজনা ১৪৫০ টাকার বিনিময়ে বাদশাহী ফরমান পাওয়া গেলেও বাংলা মুল্লুকের দণ্ডমুণ্ডের কর্ত্তা মুর্শিদকুলী খাঁর নির্দেশে জমিদারেরা ইংরাজদের গ্রাম পাঁচটির অধিকার দিতে অস্বীকার করায় বাদশাহী ফরমান অনুযায়ী লীজ কার্যকর হয়নি। বাদশাহের পক্ষেও কোনো ব্যবস্থা অবলম্বন করা সম্ভব হয়নি। কারণ ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর থেকেই বাংলা নামে মাত্রই দিল্লীর আনুগত্য স্বীকার করতো, কার্যত সর্ববিষয়েই স্বাধীন ছিল। এই ঘটনার অনেকদিন পর মীরকাশিম বাংলার নবাব হয়ে যখন বর্ধমান, মেদিনীপুর, চট্টগ্রাম জেলার রাজস্ব আদায়ের ভার  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে ছেড়ে দেন, তখন হাওড়া বর্ধমান জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল বলে ব্রিটিশ এলাকায় পরিণত হয়। এই সময় হারিয়া নামটি বিকৃত বিদেশি উচ্চারণে হাওড়া'য় পরিণত হতে পারে, যেমন বর্ধমান হয় 'বার্ডওয়ান'।

তথ্যসূত্র- হাওড়া জেলার ইতিহাস (অচল ভট্টাচার্য)

প্রতিবেদন- সুমিত দে  

No comments