Header Ads

বিষ্ণুপুর ঘরানার ঐতিহ্যময় টেরাকোটা নির্মিত 'বোঙা হাতি'


'বোঙা হাতি', আপনার বাড়িতে নিয়ে আসতে পারে বিষ্ণুপুরের ছোঁয়া। বাংলার সাথে পোড়ামাটির সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। বাংলাতে মসজিদ ও মন্দিরগুলি থেকে শুরু করে নানাবিধ নির্মাণশৈলী  অপ্রত্যাশিতভাবে পোড়ামাটিতেই তৈরি হয়েছিল। পোড়া মাটির ব্যবহার ধীরে ধীরে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং এমনকি প্রতিদিনের ব্যবহারিক নিবন্ধগুলিতে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলার এক অসামান্য উল্লেখযোগ্য সৃষ্টির উদাহরণ হলো 'বোঙা হাতি'। 


বাঁকুড়ার সুপ্রাচীন টেরাকোটা শিল্পের ঐতিহ্য এই বাংলা তথা ভারতের প্রখ্যাত প্রাচীন সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলি থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল না। পোড়ামাটির মূর্তি ও মৃৎপাত্রের ভগ্ন অংশ থেকে আমরা প্রাচীন রাঢ় বাঁকুড়ার লোক ধর্ম সম্বন্ধে অনেক কিছু জানতে পারি। বাঁকুড়া শহর থেকে ৩৪ মাইল দূরে তালডাংরা থানার অন্তর্গত পাঁচমুড়া গ্রাম। এখানকার তৈরি ৩০০ শিল্পীদের তৈরী পোড়ামাটির বোঙা হাতি তথা ভারতীয় সংস্কৃতির আইকন। 

এক নজরকাড়া আলঙ্কারিক পোড়ামাটির হাতির পিছনে একটি আকর্ষণীয় ইতিহাস লুকিয়ে আছে। মল্ল রাজাদের শাসনকালে বিষ্ণুপুর মল্লভূম রাজ্যের অংশ ছিল, যা শিল্প ও কারুকার্যের প্রাণকেন্দ্র ছিল এবং এখনও রয়েছে। মল্লভূমের রাজকীয় আস্তাবলগুলি ঘোড়া এবং হাতি দ্বারা পরিপূর্ণ ছিল, যা কেবল পরিবহণের পদ্ধতি হিসাবেই ব্যবহৃত হত না, বরং শক্তি, প্রভাব এবং মর্যাদার প্রতীক হিসাবেও ব্যবহৃত হতো। যার হাতি-ঘোড়ার সংখ্যা যত বেশি, তিনি তত বেশি ক্ষমতাশালী শাসক। হাতি ও ঘোড়াগুলি রাজরাজারা রাজকীয় অলঙ্কারে সজ্জিত করতো। যা নিবিড়ভাবে 'বোঙা হাতি' মূর্তির বিস্তারিত নকশার প্রতিলিপি ছিল। 

কেন 'বোঙা'? এর নেপথ্য কাহিনীটি হলো মল্লভূমের সাঁওতাল সম্প্রদায় যারা পোড়ামাটির শিল্পকে লালন করেছিল এবং তাদের নৈপুণ্যটি যাহেরের সান্থাল দেবতা সিং বোঙাকে উৎসর্গ করেছিল। জনশ্রুতি রয়েছে যে এই সময়কালে, সেখানে চাঁদ রায় নামে একজন জমিদার থাকতেন, যিনি গ্রামবাসীদের কাছে একজন অলৌকিক ডাক্তার হিসাবে প্রশংসিত হয়েছিলেন। তাঁর উদার সেবার বিনিময়ে, গ্রামবাসীরা তাদের ভালবাসা, শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার প্রতীক হিসাবে তাকে পোড়ামাটির প্রাণীর মূর্তি উপহার দিয়েছিল। 

সুখপূর্ণ বিষয়টি হলো বহু শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী লোকশিল্প আজও সময়ের পরীক্ষায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। আজও, বিষ্ণুপুরের কাদামাটির শিল্পটি তার মহিমা এবং সূক্ষ্মতার জন্য বিশ্বজুড়ে ব্যাপক জনপ্রিয়।

বোঙা হাতি অভিনব ফর্মটি হলো হাতির স্থির মূর্তি, শুঁড় নামানো। পেটে মাথায় এক চ্যাপ্টা গড়ন। আটপৌরে ঘরনায় ফুটিয়ে তোলা হয় অভিনব হাতির অবয়ব। লোকশিল্পে বোঙা হাতির জন্ম একেবারে আঞ্চলিক প্রকৃতির অকৃপণ ঐশ্বর্যের বাতাবরণের সেন্দরা গ্রামের মাটিতে। তেমনই আদিম আরণ্য শিল্পকলার স্মৃতিবাহী। 'বোঙা হাতি' মূর্তির সঙ্গে টোটেম স্মৃতি জড়িয়ে আছে। গ্রামের নির্জন গাছের তলায় অনাদিকাল থেকে পড়ে থাকা পাথরের নুড়ির সাথে অথবা লৌকিক দেবদেবীর মানত পূরণ করার জন্য গড়াম থানে এই 'বোঙা হাতি'কে উৎসর্গ করা হয়। 

গ্রামের সীমানার রক্ষাকর্তা বা প্রহরি 'বোঙা হাতি'। নবোপলীয় যুগের কৃষি ফসল রক্ষা যে ঐন্দ্রজালিক প্রক্রিয়ায় আশ্রয় নিতো তা আদিম মানুষের সেই স্মৃতি মনে করায় এই পবিত্র স্মারক 'বোঙা হাতি'। এখন 'বোঙা হাতি' দেশ বিদেশের ড্রইং রুমে পৌঁছে গেছে। 

তথ্যসূত্র- গেট বেঙ্গল, ভারত উত্থান 

প্রতিবেদন- সুমিত দে

No comments