মুখ ঢেকে যায় মুখোশে, উত্তর দিনাজপুরের মুখোশ শিল্প সমৃদ্ধ করছে বাংলার হস্তশিল্পকে
উত্তর দিনাজপুর মুখোশের ঐতিহ্য আজও ধরে রেখেছে। আদিকাল থেকে ধর্মীয় রীতি, উৎসব, পার্বণ থেকে শুরু করে আত্মরক্ষার জন্য ব্যবহৃত হতো মুখোশের। আদিম সমাজে অশরীরী আধিভৌতিক জগতের সঙ্গে সংযোগ ঘটাতেও মুখোশ ব্যবহৃত হতো। মানুষের ব্যক্তি চরিত্রকে অন্য এক সত্ত্বার রূপ দেয় মুখোশ। প্রচলিত আছে ঈশ্বর, জীবিত ও মৃত মানুষের যোগসূত্র ঘটাতে মুখোশ রহস্য ও গুপ্তবিদ্যার হাতিয়ার। বিশ্বের প্রায় সকল দেশেই ব্যবহৃত হয় মুখোশ। ফ্রান্স ও স্পেনে খ্রিস্টপূর্ব কুড়ি হাজার বছর আগে মুখোশের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে।
উত্তর দিনাজপুরকে বলা হয় 'মুখোশের দেশ।' এখানকার কাঠ ও শোলার তৈরি মুখোশ জগদ্বিখ্যাত। উত্তর দিনাজপুরের কাঠের মুখোশে প্রধানত ছাতিম, গামার, শিমুল, শিশু, আম ও জাম কাঠ ব্যবহৃত হয়। এইসব কাঠ ওজনে হালকা ও সহজে ফাটেনা, তাই এ ধরণের কাঠ ব্যবহার করা হয়। মুখোশ বানানোর জন্য ৫০ সেমি ও ৯০ সেমি পরিধিবিশিষ্ট কাঠের খণ্ড নিতে হয়। এরপর ঐ কাঠখণ্ডকে লম্বালম্বি চেরাই করে দুখণ্ড করে দুটো মুখোশ তৈরি করা হয়। মানুষের দাঁত, মুখ, চোখ, নাক বিশেষ বাটালির সাহায্যে বানানো হয়। এরপর তার ওপর তারপিন তেলের সঙ্গে রঙ মিশিয়ে মুখোশের কাজ সম্পূর্ণ করা হয়। আর শোলার মুখোশে পুকুর বা জলাশয় থেকে শোলা সংগ্রহ করা হয়। শোলাগুলিকে লম্বালম্বি ভাবে কেটে তাতে প্রয়োজনমতো আঠা মিশিয়ে মুখোশের আকৃতি বানিয়ে তার ওপর রঙ করা হয়।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সমাদৃত হচ্ছে উত্তর দিনাজপুরের মুখোশ। বহু শিল্পী মুখোশ শিল্পের সাথে এখানে জড়িত। মুখোশ শিল্পকে কেন্দ্র করে বহু স্বনির্ভর গোষ্ঠীও এখানে গড়ে উঠেছে। উত্তর দিনাজপুরের কথা বললে সবার প্রথমে মুখোশ শিল্পের কথা উঠে আসে। শিল্পীদের অসাধারণ প্রতিভার বহিঃপ্রকাশ লক্ষ্য করা যায় মুখোশগুলোতে। স্বাধীনতার আগে থেকেই মুখোশ শিল্প গড়ে উঠেছে উত্তর দিনাজপুরে।
অনেক লোকনাট্যে নাচেরও প্রয়োজন হয়। যেখানে নিজস্ব রুচি, অঙ্গভঙ্গিতে নায়ক-নায়িকারা নৃত্য পরিবেশন করে৷ অনেক সময় নায়ক-নায়িকাদের উদ্দাম নৃত্য দেখানো হয় মুখোশের সাজে। উত্তর দিনাজপুরে গম্ভীরা ও জিতিয়া অষ্টমী উপলক্ষ্যে মুখোশ নাচের আলাদা আসর বসে৷ দলে দলে সুসজ্জিত হয়ে ঢোল বাজানোর তালে তালে উত্তেজিত ভাবে নৃত্য চালাতে থাকে। স্থানীয়ভাবে এই নৃত্যকে মুখা নৃত্য বলে। এই মুখা নৃত্যে ঢোল বাদক ও নৃত্যকারী শেষ পর্যন্ত বাহ্যিকজ্ঞান হারিয়ে ফেলে৷
উত্তর দিনাজপুর জেলার ঐতিহ্যবাহী লোকশিল্প হলো মোখা। উত্তর দিনাজপুরের মুখোশ শিল্প প্রতিবেশী দেশ নেপাল হয়ে তিব্বত, চীন ও শ্রীলঙ্কায় পৌঁছে যাচ্ছে। জাপানের টোকিও শহরে অত্যন্ত সমাদৃত এই শিল্প। প্রতি বছর উত্তর দিনাজপুরের শহরাঞ্চলগুলোতে মুখোশ মেলা অনুষ্ঠিত হয়। রাজ্যের সকল জেলার হস্তশিল্প মেলাতেও এখান থেকে মুখোশ যায়। উত্তর দিনাজপুর জেলার মুখোশ শিল্প বাংলার হস্তশিল্পের গৌরব বৃদ্ধি করছে।
প্রতিবেদন- সুমিত দে
তথ্যসূত্র- বঙ্গদর্শন, বিবর
Post a Comment