জামালপুরের এক প্রাচীন নিদর্শন বাবা বুড়োরাজের মন্দির
প্রথমেই একটা প্রশ্ন যে, বাবা বুড়োরাজ কী শিব, না ধর্মরাজ ? অনাদিদেব শিবের সাথে কি ধর্মের ঐতিহ্য যুক্ত ছিল ?
জামালপুরের সবথেকে বহু পুরোনো মন্দির হল বাবা বুড়োরাজের মন্দির। প্রথমেই প্রণাম জানাই। দূর দূরান্ত থেকে বহু ভক্তের সমাগম ঘটে বাবার এই অলৌকিক মন্দিরে। এখানকার শিবলিঙ্গ টি দেখতে বেশ আশ্চর্যজনক কারণ এর কোনো শেষ আজও খুঁজে পাওয়া যায় নি। এই রহস্যময় মন্দির নির্মাণের পিছনেও রয়েছে এক অলৌকিক কাহিনী, যা হয়তো অনেকেই জানেন না। এখানে ধর্মরাজ রূপে অধিষ্ঠিত রয়েছে বাবা বুড়োরাজ। জানা যায়, একসময় নাকি এই এলাকা গভীর জঙ্গলে ঢাকা ছিল। ধর্মরাজের প্রকৃত স্বরূপ যাই হোক না কেন, কেউ কেউ তাঁকে বুদ্ধ বলে প্রমাণ করেছেন। ধর্ম পূজা বিধানে তাঁকে সূর্য ও বলা হয়েছে। কেউ আবার বরুণ বলেছেন, কারও কাব্যে ধর্মরাজ ও নারায়ণ অভিন্ন।
পৌরাণিক শিবের মধ্যে বৈদিক রুদ্রদেবের আরাধনার প্রসঙ্গে রামকৃষ্ণ গোপাল ভাণ্ডারকর মন্তব্য করেছেন যে, 'প্রলয়ঙ্কর ঝড়, বাত্যা, অশনিবিশ্বদাহী অগ্নি, মৃত্যু আনয়নকারী সংক্রামক ব্যাধি পুঞ্জ প্রভৃতি নানা প্রকার প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও সংহার লীলার মধ্যে বৈদিক ঋষিগণ ভীতি উদ্রেককারী রুদ্রের উচ্চ রূপের প্রকাশ দেখতে পেতেন । এই ভাবেই আর্য ও আর্যেতর জাতি গোষ্ঠীর দ্বারা পুজিত হয়ে শিব মিশ্র দেবতায় পরিণত হয়েছেন।'
"হে রুদ্র, তোমার ললাটের যে ধ্বক্ ধ্বক্ অগ্নিশিখার স্ফুলিঙ্গ মাত্র অন্ধকার গৃহের প্রদীপ জ্বলিয়া উঠে–সেই শিখাতেই লোকালয়ে সহস্রের হাহাধ্বনিতে নিশীথ রাত্রে গৃহদাহ উপস্থিত হয়। হায় শম্ভু, তোমার নৃত্যে, তোমার দক্ষিণ বা বাম পদক্ষেপ সংসারের মহাপাপ ও মহাপূণ্য, উৎক্ষিপ্ত হইয়া উঠে।"
দুইজন বিখ্যাত মনীষী রুদ্র সম্পর্কে এটি দুটি আশ্চর্য কবিত্বময় বিবরণ প্রদান করেছেন। এই বর্ণনা কবির ভাষায় অপূর্বতা লাভ করেছে। কিন্তু রুদ্রের সামগ্রিক পরিচয় এই বিবরণ থেকে পাওয়া সম্ভব নয়।
পৌরাণিক বিবরণে শিবকে অনাদি লিঙ্গ বলে ব্যাখ্যা করা হয়েছে অর্থাৎ শিবের মহিমার কোন তলদেশ খুঁজে পাওয়া যায় না। ব্রাহ্মণ পুরোহিতের সাহায্য ব্যতীত মেয়েরাও শিব ঠাকুরকে আপন করে নিয়ে সামান্য গঙ্গা জল ও বিল্বপত্র দিয়ে মাটির তৈরি শিবের পূজা অর্চনা করে থাকেন।
জামালপুরে বুড়ো রাজের পুজা ও অনুষ্ঠান দেখে অনুমান করা যায় যে, আদিতে এখানে ধর্মের পূজার প্রচলন ছিল এবং কোন কারণে এই পূজা বন্ধ হয়ে যায়।
কিন্তু আবার কোথাও তিনি যমরাজ রূপে কল্পিত, কোথাও বা শিব। আবার 'ফকির' রূপেও ধর্মের আত্মপ্রকাশ। তিনি আবার সোমও। এদিক থেকে সীতারাম দাসের 'জটিল ঠাকুর' নামটি তাঁর ক্ষেত্রে অধিকতর যথার্থ। মূলত বহুরুপেই ধর্মরাজের আত্মপ্রকাশ। আবার এখানে শিব রূপে। বুড়ো রাজের আবির্ভাব প্রসঙ্গে বিনয় ঘোষ বলেছেন যে, যদু ঘোষ নামে স্থানীয় একজন গোপ একদিন হঠাৎ দেখতে পান যে, তাঁর শ্যামলী নামে গাই গরুটি জামালপুরের এক জায়গায় দাড়িয়ে আছে। আর তার বাঁট থেকে ঠিক ফোয়ারার মতো দুধ ঝরে পড়ছে। স্থানীয় বিজ্ঞ ব্যক্তি চাটুজ্যে মশায়ের কাছে তিনি যান রহস্য উদঘাটনের জন্য। চাটুজ্যে মশায় দেখলেন, একটি পাথরের মাথায় দুধ জমা হচ্ছে। বলা বাহুল্য, পাথরটি অনাদি মঙ্গল শিব। সেই রাতেই চাটুজ্যে মশায় স্বপ্ন দেখলেন, দেবতার পূজোর ব্যবস্থা করতে হবে অনাড়ম্বরে। রীতিমতো ঠিক তাই করা হল।
এই ধর্মরাজের বহুরূপী ধারণের জন্যই হয়তো একটি মন্ত্রে বলা হয়েছে : নমস্তে বহুরূপায় যথায় ধর্ম রাজায়। তাছাড়া, 'অনাদ্যের পুঁথি' তে তাঁকে আদি অনাদি রূপে স্ততি করেও বলা হয়েছে –
"তুমি চন্দ্র তুমি সূর্য্য তুমি দিবাকর। তুমি হর তুমি হরি তুমি বৃহস্পতি।।"
তবে এখন প্রশ্ন হল বুড়োরাজ কি শিব, না ধর্মরাজ ? কেউ কেউ বলেন, আদি পুরোহিত চাটুজ্যে মশায় এই ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন অনাদি মঙ্গল শিব বলে। অনাদিদেব কে যদি শিব বলেই মনে করতেন তবে তিনি তো শিবের নামেই পূজা প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন, তাঁর সাথে ধর্মের সংযোগ স্থাপন করেছেন কেন ?
উভয় দেবতাই বিশিষ্ট গ্রাম দেবতারূপে প্রতিষ্ঠিত হলেও কোথাও কোথাও লৌকিক দেবতা হিসেবেই পরিচিত। আর তাছাড়া শিব পূজার উৎপত্তি হয়েছিল প্রাক্ – বৈদিক যুগে বা প্রাগৈতিহাসিক যুগে। একথা সকলেই জানেন। সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শনে নবম প্রস্তর বা পোড়ামাটির নির্মিত এমন অনেক বস্তু পাওয়া গেছে, যেগুলো কে মার্শাল সাহেব লিঙ্গ প্রতীক বলে অনুমান করেছেন। আর পরবর্তীকালে শিবলিঙ্গ আবিষ্কৃত হওয়ায় অতীতের স্মৃতি চিহ্ন স্বরূপ পুনরায় শিবের মাধ্যমে পূজা প্রকাশ ঘটে, যার বহিরাঙ্গের রূপটি শিবের হলেও আচার অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ধর্মরাজ বিরাজ করেছেন।
বুড়ো রাজের নাম তত্ত্বের প্রসঙ্গে বিনয় ঘোষ বলেছেন যে, বুড়ো শিবের 'বুড়ো' আর ধর্মরাজের 'রাজা', আর তাই 'বুড়োরাজ'। কিন্তু যেখানে তাঁকে অনাদ্যের পুঁথি তে 'আদি অনাদি' বলা হয়েছে, সেখানে শিব যেমন বুড়ো, তেমনি ধর্ম ও তো বুড়ো এবং তিনি তো 'রাজ'। সুতরাং এখানে ধর্মরাজ ই বুড়োরাজ রূপে সূচনা কালেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন।
গ্রামের পূর্ব ভাগে জঙ্গলের মধ্যে জীর্ণ দশাগ্ৰস্ত মসজিদের অস্তিত্ব মুসলমান বসতি র প্রত্যক্ষ প্রমাণ। তবে বলা যায়, এই জায়গা টি ধ্বংস প্রাপ্ত অবস্থায় ছিল। সেখানে শুধুমাত্র মুসলমান বসতি ছিল না, তার সাথে সাথে হিন্দু বসতি ও ছিল। আর তার প্রমাণ হল আমাদের বাবা বুড়োরাজ। অর্থাৎ বাবা বুড়োরাজ কে ধ্বংস প্রাপ্ত অবস্থা থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল। এই বুড়োরাজ এর মন্দির ধ্বংস হয়েছিল হয় মুসলিম আধিপত্য কালে, নয়তো বর্গীর হাঙ্গামার কালে।এই হাঙ্গামার সময় কালে সমুদ্র গড়, জান্নগড় প্রভৃতির সাথে নিমদহ গ্রাম টিকেও বর্গীরা পুড়িয়ে দিয়েছিল। এসবের ক্ষেত্রে মোগল পাঠান রাও সেই সময় পালিয়ে গিয়েছিল। আর এই পালিয়ে যাওয়ার ইতিহাস হয়তো এই নিমদহ সংলগ্ন জামালপুরে রয়েছে। চাটুজ্যে মশায়ের পক্ষ থেকে ধর্মরাজের ঐতিহ্য কে ত্যাগ করা হয়তো সম্ভব হয় নি। যদি হতো তবে বুড়োরাজ একমাত্র শিব রূপেই প্রতিষ্ঠা পেতেন।
অনাদ্যের পুঁথি তে 'তুমি হর' বলা হয়েছে। আর জামালপুরের পূজোর মন্ত্রে এই সত্যই দেখা যায়। সেখানে বলা হয়েছে– নিরঞ্জনং নিরকারং মহাদেব মহেশ্বরম্ । শরণং পাপখন্ডনং ধর্মরাজ নমোঽস্তুতে ।। অর্থাৎ এখানে ধর্মকে ই শিব রূপে বা শিব কেই ধর্ম রূপে প্রণাম জানানো হয়েছে।
বুড়ো রাজের উৎপত্তি প্রসঙ্গে যে কিংবদন্তি দেখা যায়, সেই রকম কিংবদন্তি তারকেশ্বরের তারকনাথের মতো পশ্চিমবঙ্গের অনেক দেবতার ক্ষেত্রেই দেখা যায়। বৈশাখী পূর্ণিমায় বুড়ো রাজের পূজো ও গাজন হয়। আর শিবের পূজা ও গাজন হয় চৈত্র সংক্রান্তিতে। তাছাড়া মানদকারীরা বারমাসে বারটি শুক্লপক্ষের সোমবার পালন করে থাকেন সকলে। সন্তান কামনায় মানত করে থাকে। এছাড়া গাজনে সন্ন্যাসী হওয়া, দন্ডখাটা উৎসবের অঙ্গ রূপ। এখানে হাজার হাজার পাঁঠা বলি হয়। পাঁঠা নিয়ে আবার কাড়াকাড়ি ও লাঠালাঠি হয়, তা বিরল দৃষ্টান্ত। বুড়োরাজ এখানে ইট পাথরের মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত নন। তিনি বাঁকানো চালের মাটির বড় ঘরে প্রতিষ্ঠিত।।
কথিত আছে, জামালপুরের এই মন্দিরের অলৌকিক শক্তিতে সেরে যায় বহু মানুষের দুরারোগ্য ব্যাধি। আর তাই আজও এই কারণে পুণ্য অর্জন করতে আসেন ভক্তরা।
Post a Comment