Header Ads

সম্প্রতি নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী রাইনহার্ড ও আন্দ্রিয়ার গবেষণার পূর্বসূরী হলেন মৃনাল দাশগুপ্ত


জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করা বিজ্ঞানী বলতে আমরা প্রথমে আইস্টাইন ও স্টিফেন হকিন্সের কথা ভাবি কিন্তু এতোসব উজ্জ্বল নক্ষত্রদের ভিড়ে প্রায় হারিয়ে যাওয়া প্রখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী  মৃনাল দাশগুপ্তকে আমরা কজন বাঙালিই বা চিনি? জ্যোতির্বিজ্ঞান বিভাগে একজন সফল বাঙালি হিসেবে তিনি বিশ্বসভায় বাঙালির মুখ উজ্জ্বল করেছেন। রেডিয়ো জ্যোতির্বিজ্ঞানে বিজ্ঞানী মৃনাল দাশগুপ্তর আবিষ্কার অনস্বীকার্য। তিনিই প্রথম দেখিয়েছিলেন যে, রেডিয়ো তরঙ্গ গ্যালাক্সির ভেতর থেকে নয়, বাইরের দু'পাশের কোনো উৎস থেকে আসছে৷ 


২০২০ সালে সম্প্রতি কৃষ্ণগহ্বর বা ব্ল্যাকহোল নিয়ে কাজের জন্য নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন জার্মানির বিজ্ঞানী রেনহার্ড গেনজেল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানী আন্দ্রেয়া ঘেজ। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রে অবস্থিত দানবাকৃতি ব্ল্যাকহোল আবিষ্কারের জন্য তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে নোবেল পুরস্কার। এই নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত গবেষণার পূর্বসূরি ছিলেন বিজ্ঞানী মৃনাল দাশগুপ্ত। তিনি ব্ল্যাকহোলের প্রধান মেরুদণ্ড আবিষ্কার করেছিলেন। তার থিয়োরির ওপর ভিত্তি করেই বিজ্ঞানী রেনহার্ড গেনজেল ও আন্দ্রেয়া ঘেজ গবেষণা শুরু করেন। ১৯৫৩ সালে বিজ্ঞানী মৃনাল দাশগুপ্ত যে গবেষণা করেন তার সাথে নোবেলজয়ী ঐ দুই বিজ্ঞানীর কাজের মিল রয়েছে। 

বিজ্ঞানী মৃনাল দাশগুপ্ত জন্মগ্রহণ করেন ১৯২৩ সালে অবিভক্ত বাংলার বরিশালে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এস.সি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি যে বছর এম.এস.সি সম্পূর্ণ করেন ঠিক সেই বছরেই দেশভাগ হয়। তাঁর পরিবারের সকলে কলকাতা চলে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। তাঁরা সপরিবারে কলকাতাসহ উঠে আসার পর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক এস.কে মিত্রের সাথে সহকারী হিসেবে কাজ করার সুযোগ পান। এস.কে মিত্রের উদ্যোগেই ম্যাঞ্চেস্টার শহরে গিয়ে তিনি রেডিয়ো জ্যোতির্বিজ্ঞানের কাজ হাতেকলমে করবার সুযোগ পান। ম্যাঞ্চেস্টার থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়ে তিনি দেশে ফেরেন। তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন ও এই বিশ্ববিদ্যালয়েই তাঁর কর্মজীবন অতিবাহিত হয়। 

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি রেডিয়ো ফিজিক্স এন্ড ইলেকট্রনিক্স বিভাগে অধ্যাপনা করতেন। এই বিভাগের উন্নতির জন্য তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন।  এই বিভাগেই তিনি নানা সময় বিভিন্ন উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। ১৯৯১ সালের দিকে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে অবসর নেন। এরপর কলকাতা বিড়লা প্ল্যানেটেরিয়ামের এস্ট্রোনমি এন্ড প্ল্যানেটোরিয়াম সায়েন্স কোর্সের অধিকর্তা হিসেবে তিনি কাজ করেছেন। তাঁর অধীনে অভিসন্দর্ভ সম্পন্ন করা বিভিন্ন ছাত্র ছাত্রী নানা সময়ে বিভিন্ন বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞানী ও গবেষক হিসেবে কাজ করেছেন। 

এবার তিনি যেটা আবিষ্কার করলেন তা হলো-  জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের জানা ছিল, সিগনাস-এ নামে একটি গ্যালাক্সি রেডিয়ো তরঙ্গের উৎস। কিন্তু গ্যালাক্সিটার ভিতরে ঠিক কোন জায়গা থেকে রেডিয়ো তরঙ্গ বেরিয়ে আসছে তার হদিশ তাঁরা তখনও পাননি। চল্লিশ দশকের শেষ ভাগে রেডিয়ো জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এমন একটা পদ্ধতি উদ্ভাবন করলেন যার মাধ্যমে একটি সুবিশাল রেডিয়ো টেলিস্কোপ ছাড়াও কোনো রেডিয়ো নক্ষত্রের আকৃতি নির্ণয় করা সম্ভব হল৷ ধরা যাক, এক কিমি ব্যবধানে রাখা দুটো ছোট রেডিয়ো টেলিস্কোপ এক সঙ্গে একটা জ্যোতিষ্ককে পর্যবেক্ষণ করছে। এই দু'টো রেডিয়ো টেলিস্কোপের পর্যবেক্ষণের সম্বন্বয় ঘটিয়ে জ্যোতিষ্কটির এমন একটি ছবি বানানো গেল যা অনেকাংশেই এক কিমি আয়তনের একটা রেডিয়ো টেলিস্কোপ দিয়ে তোলা ছবির প্রায় সমতুল্য। এই পদ্ধতির নাম 'রেডিয়ো ইন্টারফেরোমেট্রি'। যার অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্টিন রাইল। যিনি নোবেল পান ১৯৭৪ সালে। জড্রেল ব্যাঙ্কে এই পদ্ধতিটিরই আরও উন্নতি ঘটালেন হ্যানবেরি ব্রাউন। 

একই পদ্ধতিতে সিগনাস-এ পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে রজার জেনিসন ও মৃনাল দাশগুপ্ত যে অত্যাশ্চর্য আবিষ্কারটি করে বসলেন তার জন্য সেই সময় কেউই তৈরি ছিলেন না। তাঁরা দেখতে পেলেন, রেডিয়ো তরঙ্গ গ্যালাক্সির ভেতর থেকে নয়, বাইরের দু'পাশের কোনো উৎস থেকে আসছে৷ 

রজার ও মৃনালের আবিষ্কৃত সিগনাস-এ'র রেডিয়ো লোব ব্ল্যাক হোলের অস্তিত্বের স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়। কারণ সিগনাস-এ'র আধুনিক ছবিতে স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে, গ্যালাক্সির কেন্দ্র থেকে দু'পাশে দু'টো সরু গ্যাসের প্রবাহ। সেখান থেকে রেরিয়ে এসেছে 'রেডিয়ো জেট'। এই জেটগুলো যেখানে শেষ হয়েছে সেখানেই লোবগুলোর সৃষ্টি৷ আর জেট ও লোবগুলি গ্যালাক্সি কেন্দ্রের ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহর থেকে উৎপন্ন হচ্ছে। 

এতো বড়ো মাপের জ্যোতির্বিজ্ঞানী হিসেবে তিনি গোটা বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তুলেছিলেন। বিজ্ঞানীমহলের একাংশের মনে যখন একটা ধারণা জন্মেছিল যে ব্ল্যাকহোলের কোনো অস্তিত্বই নেই সেখানে ব্ল্যাকহোল আবিষ্কারের প্রধান মেরুদণ্ড আবিষ্কার করে খ্যাত হলেন বিজ্ঞানী মৃনাল দাশগুপ্ত।

প্রতিবেদন- সুমিত দে  

No comments