কানোজি আংরে ও এক দুঃসাহসিক বাঙালির হাড়হিম করা আন্দামান অ্যাডভেঞ্চার
অ্যাডভেঞ্চারের নেশা বাঙালির বহুদিনের। অ্যাডভেঞ্চার বাঙালির রক্তের মধ্যে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে। অ্যাডভেঞ্চারের নেশাতে বাঙালি ছুটেছে আসমুদ্র হিমালয় থেকে দিগন্তবিস্তৃত সাহারা। শত শত বাঙালি বারংবার বিভিন্ন দুঃসাহসিক অ্যাডভেঞ্চারে গা ভাসিয়েছেন। পৃথিবীতে যে সকল সফল বাঙালি অ্যাডভেঞ্চারার রয়েছে তাদের মধ্যে এক অন্যতম নাম হলো পিনাকী রঞ্জন চট্টোপাধ্যায়।
উত্তাল সমুদ্রে একটি ছোটো ডিঙাতে অবিশ্বাস্য ৩৩ দিন কাটিয়ে আন্দামানের পোর্টব্লেয়ারে পৌঁছেছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরবিজ্ঞানের অধ্যাপক তথা প্রখ্যাত সাঁতারু ও ক্রীড়াবিদ পিনাকী রঞ্জন চট্টোপাধ্যায়। কলকাতা থেকে যাত্রা শুরু করেন তিনি। কলকাতার নদীপথ পার হয়ে বঙ্গোপসাগরের ওপর দিয়ে তিনি প্রবল সাহসের সঙ্গে পোর্টব্লেয়ারে পৌঁছেছিলেন। হাজারো ঝড়-ঝঞ্ঝা ও বিপদের সম্ভাবনাকে হারিয়ে তিনি জয়ী হন এই অ্যাডভেঞ্চারে।
১৯৬৯ সালের ১ লা ফেব্রুয়ারি কলকাতার মন'ওয়ার জেটি থেকে ভারতীয় নৌসেনার অফিসার লেফটেন্যান্ট অ্যালবার্ট ডিউকের সাথে সাধারণ পালহীন কাঠের ডিঙাতে করে আন্দামনে রওনা দেন তিনি। তাদের এই ডিঙাটির নাম ছিল কানোজি আঙরে। শিবাজীর নৌ সেনাপতি তুকোজি আংরের ছেলে ছিলেন কানোজি আংরে। যিনি একাই ইংরেজদের বহু জাহাজকে ধ্বংস করেছিলেন৷ সেই কানোজির নামেই ডিঙার নামকরণ। বিশ্বনন্দিত সাঁতারু মিহির সেন নামকরণ করেন এই ডিঙাটির। মিহির সেন ছিলেন এই অ্যাডভেঞ্চারের প্রাণপুরুষ। বিপদসংকুল এই সমুদ্র যাত্রায় তাঁরা কয়েকবার নিখোঁজও হয়ে যান। যদিও শেষ পর্যন্ত ৮ ই মার্চ প্রায় ৩৩ দিন পর তাঁরা পোর্টব্লেয়ারের আবের্ডিন জেটিতে পৌঁছান।
সমগ্র অ্যাডভেঞ্চারের নকশা তৈরি করেন ভারতীয় নৌসেনার কমান্ডার রথীন দাস। যিনি হাতের তালুর মতো বঙ্গোপসাগরকে জানতেন৷ পিনাকী রঞ্জন চট্টোপাধ্যায়ের বয়স তখন বছর তেইশ, এই বয়সেই ১০০০ মাইলের এই সমুদ্রযাত্রা ডিঙাতে পার হয়ে বিশ্বরেকর্ড গড়েন তিনি। প্রথম পর্যায়ে অ্যাডভেঞ্চারটি বেশ ভালোভাবেই শুরু হয় তবে মাত্র এক সপ্তাহ গড়াতে না গড়াতেই তাঁরা নিখোঁজ হয়ে যান।
এই অ্যাডভেঞ্চারে তাঁরা ঠিক কতদূর যাচ্ছেন তা জানানোর জন্য তাঁদের বেতার সংকেত ভেসে আসতে থাকে। ফেব্রুয়ারির ৮ তারিখে তাদের বেতারে 'আর আর আর' সংকেত দেওয়ার কথা। অথচ ৮ তারিখ তাদের থেকে কোনো বেতার সংকেত পাওয়া যায়নি।
১২ ই ফেব্রুয়ারি ঠিক হয় বায়ুসেনার বিমান বঙ্গোপসাগরের ওপর দিয়ে ওড়ে তাদের খুঁজে আনার জন্য তল্লাশি চালাবে। এক বায়ুসেনার অফিসার ১৩ ই ফেব্রুয়ারি সাতসকালে কলকাতা বিমানবন্দরে এলেন। এখানে কানপুর থেকে উড়ে এসেছে বায়ুসেনার এক বিমান সুপার কনি। এক বাঙালি স্কোয়াড্রেন লিডার ঐ বায়ুসেনার অফিসারকে নিয়ে উড়ে চলেন। সুপার কনি একদম ছোটো একটি বিমান। বসার আসনও ছোটো। কোনো আরাম পর্যন্ত এই বিমানটিতে। মানে কোনোরকমে বসে থেকে এগিয়ে চলা। এই বিমানে সামান্যতম অঘটন ঘটলে তাঁদেরও আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। ফলে তাঁদের মাঝেও একটা চিন্তার ভাঁজ পড়তে থাকে।
বিমান ছাড়া এ পথে তল্লাশি চালানো বেশ কঠিন। বায়ুসেনার ঐ অফিসার বাঙালি স্কোয়াড্রেন লিডারকে হেলিকপ্টারের কথা বলেছিলেন। তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন এতোটা পথ ঘুরে গন্তব্যস্থানে পুনরায় পৌঁছতে গেলে হেলিকপ্টারের সব জ্বালানি শেষ হয়ে যাবে। তাই বিমান ছাড়া দ্বিতীয় আর কোনো উপায় নেই। রুদ্ধশ্বাস গতিতে সমুদ্রের ওপর দিয়ে সুপার কনি উড়ে চলেছে। সমুদ্রের ওপর কিছুদূর এগিয়ে যেতেই তাঁদের চোখে পড়লো দুটো জাহাজ। তাঁরা একটি জাহাজে বিমানটিকে টেক অফ করে খবর দিলেন যে একটি ডিঙাতে দুইজন পুরুষ অ্যাডভেঞ্চারে বেরিয়ে নিখোঁজ হয়েছেন। তাঁদের দেখা পেলে যেন জানানো হয়।
জাহাজে খবর দেওয়ার পর সুপার কনি কলকাতা ফিরে এলো। জাহাজ দুটোও রওনাকালে তাঁদের দেখতে পেল না। তাঁরাও খারাপ খবর দেয় যে তাদের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। তাহলে তাঁরা কী সমুদ্রের অতল গভীরে তলিয়ে গেছে? বেশিরভাগ মানুষ ধরেই নিয়েছিল যে তাঁদের অ্যাডভেঞ্চার ব্যর্থ বা হয়তো তাঁরা মারা গেছেন। অনেকে ভেঙ্গে পড়তে শুরু করেন। মিহির সেন আত্মবিশ্বাসের সাথে সকলকে আশ্বাস দেন যে তাঁরা হারিয়ে যাননি, সময়মতো ঠিক তাঁরা ফিরে আসবেন। তাঁর আত্মবিশ্বাস মিলে গিয়েছিল কারণ দীর্ঘ একমাস পর পোর্টব্লেয়ারে পৌঁছে গেলেন তাঁরা। সফলতার মুখ দেখলো এক দুঃসাহসিক অ্যাডভেঞ্চার। বিশ্বের দুঃসাহসিক অভিযানের খাতায় নাম লেখালেন এক বাঙালি।
এই অ্যাডভেঞ্চার এতোটাই ভয়াবহ ছিল যে অ্যাডভেঞ্চারের সময়কালে পিনাকীবাবুর ডান হাতের আটটি লিগামেন্ট ছিঁড়ে যায়। ফলে তাঁকে বাম হাতে দাঁড় টানতে হয়। দশ দিন যাবৎ ইনফ্লুয়েঞ্জা জ্বর জাপটে বসে থাকে তাঁর শরীরে। আর ডিউকের চাগাড় দিয়ে ওঠে হার্নিয়া। এতোকিছুর পরও হার মানতে রাজী নন তাঁরা। লক্ষ্যকে স্থির রেখে এগিয়েই চলতে থাকেন তাঁরা। অবশেষে সাফল্যের সাথে শেষ হলো অ্যাডভেঞ্চার। তাঁদের স্বচক্ষে দেখার জন্য পোর্টব্লেয়ারের আবের্ডিন জেটিতে ভিড় জমালেন হাজার হাজার সাধারণ মানুষ ও একদল সাংবাদিক।
পিনাকী রঞ্জন চট্টোপাধ্যায় এই অ্যাডভেঞ্চারে সফল হওয়ার পর ঠিক করেন তিনি এবার নৌকা নিয়ে কলকাতা থেকে ইন্দোনেশিয়া যাবেন। কিন্তু অদৃষ্টের এমনই পরিহাস যে পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হওয়ার আগেই ১৯৮৩ সালের ২৪ শে সেপ্টেম্বর রহস্যজনক ভাবে জলে ডুবে মৃত্যু হয় তাঁর৷ তিনি একজন দক্ষ ক্রীড়াবিদ ও সাঁতারু হওয়া সত্ত্বেও তাঁর আকস্মিক মৃত্যু বড়োই দুর্ভাগ্যজনক।
তথ্যসূত্র- বঙ্গদর্শন, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান
Post a Comment