শতবর্ষ পেরিয়ে ঐতিহ্যবাহী আতরের প্রতিষ্ঠান 'গুপ্ত পারফিউমার্স' আজ বিলুপ্তির পথে
একটা সময় ইদ, বনেদি বিয়ে ও দুর্গাপুজোতে আতর বিক্রির রমরমা ছিল। দেশী সুগন্ধি আতর আজকাল খুব একটা বেশি বিক্রি হয়না। এখন লোকে বিদেশি সুগন্ধি সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে৷ ফলে আতর ব্যবসা এখন তলানিতে ঠেকেছে। কলকাতার অন্যতম আতর দোকান হলো 'গুপ্ত পারফিউমার্স৷' শতবর্ষ পেরিয়ে এখন এই দোকান ক্রমশ ধুঁকছে। কিন্তু এই দোকানকে বুক পেতে আগলে রেখেছেন এক বৃদ্ধ যার নাম রামপদ মাইতি।
শ্যামবাজারের পাঁচ মাথার মোড় থেকে বাগবাজার বাটার বাঁদিকে ফুটপাথ ধরে হাঁটলেই একটা লম্বা গলি। এই গলিতে রয়েছে কত রকমের দোকান। দশকর্মা, মনিহারি ও গ্রহরত্নের দোকানের সারির মাঝে একটি দোকান যার তাকের ওপর শিশি ঝোলানো, যা নানান রং ও গন্ধের তরলে ভরা। এই দোকানটিই হলো গুপ্ত পারফিউমার্স। দোকানের মধ্যে প্রাচীনতার ছাপ। ঝাপসা দেওয়াল। রংচটা সাইনবোর্ড। দোকানের বর্তমান অবস্থা দেখলে যেন মায়া পড়ে যায়।
এককালে এই দোকানের কর্মচারী ছিলেন রামপদ মাইতি। পরবর্তীকালে তিনিই হয়ে ওঠেন এই দোকানের মালিক। ৫৫ বছর ধরে এই দোকান তিনি সামলাচ্ছেন। চার-পুরুষ ধরে চলছে এই দোকান। তিনি এ দোকানে রয়েছেন তিন পুরুষ ধরে। তিনি প্রতিদিন একটার পর একটা শিশি খুলে রুমালে ঢালেন৷ গোলাপ, জুঁই, চন্দন, বেলফুল আরো কত রকমের সুগন্ধি। যার গন্ধে ভরে ওঠে দিকবিদিক। সকাল থেকে রাত অবধি একটা সাদা গদির ওপর কখনো তিনি শুয়ে থাকেন, আবার কখনো বসে থাকেন।
রামপদ মাইতি অত্যন্ত সাদামাটা মানুষ। কোনোদিন হারতে শেখেন নি তিনি। তার মুখে সবসময় কেমন যেন একটা হার না মানা হাসি লক্ষ্য করা যায়। ব্রিটিশ আমলে ব্রিটিশরাও লাইন দিয়ে এখানে আতর কিনতো। ২৫০ রকম শিশিতে তার কাছে সুগন্ধি পাওয়া যায়৷ এছাড়াও সুগন্ধি ধূপ, গোলাপ জল, ছেঁচা পান ও পানমশলা পাওয়া যায় তার কাছে। কিশোর বয়সে সেই যে আত্মীয়ের সাথে কলকাতা এলেন তারপর আর বাড়ি ফিরলেন না তিনি। সারাজীবনের জন্য থেকে গেলেন কলকাতায়।
মালিকের বাড়িতেই কলকাতায় তিনি থাকতেন৷ তৃতীয় পুরুষের আমল থেকেই ব্যবসাতে লোকসান শুরু হয়। বিদেশি নামীদামী ব্র্যান্ডের প্রোডাক্টের কাছে হার মানতে হয় আতরকে। আতর বিক্রি প্রায় উঠেই যেতে থাকে। লোকসান হতে বসা ব্যবসাকে তিনি দাঁড় করিয়েছিলেন ঠিকই, তবে সময়ের স্রোতে বদলেছে সবই৷ আগে সন্ধ্যা ছটার সময় খদ্দেরদের ভিড় লাগতো দোকানে৷ উত্তর কলকাতার চেনা ভিড় থাকলেও তার দোকানের সেই চেনা ভিড় আর নেই বললেই চলে৷ দোকান চালাতে গেলে এখন তাকে দশবার ভাবতে হয়৷ মাসে দুশো টাকার সুগন্ধি বিক্রি হয় বর্তমানে তার দোকানে। লকডাউনে চারমাস বন্ধ ছিল গুপ্ত পারফিউমার্স। তার দোকানের ভাড়া পাঁচ হাজার টাকা। তিনি জানেন না যে দোকানটা খুব বেশিদিন থাকবে কিনা।
প্রতিবেদন- সুমিত দে
Post a Comment