বাঙালি দম্পতির আফ্রিকান জনজাতি সম্পর্কিত গবেষণা প্রকাশ করলো 'নেচার'
"উদভ্রান্ত সেই আদিম যুগে স্রষ্ঠা যখন নিজের প্রতি অসন্তোষে। নতুন সৃষ্টিকে বারবার করেছিলেন বিধ্বস্ত, তাঁর সেই অধৈর্যে ঘন-ঘন মাথা নাড়ার দিনে রুদ্র সমুদ্রের বাহু প্রাচী ধরিত্রীর বুকের থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল তোমাকে, আফ্রিকা।" বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর আফ্রিকা কবিতায় এভাবে আফ্রিকাকে বর্ণনা করেছেন। সত্যি, বিশ্বের অন্যতম রহস্যময় মহাদেশ হলো আফ্রিকা। ভ্রমণপিপাসু ও চিন্তাশীল মানুষের কাছে আফ্রিকা প্রাণের থেকেও প্রিয়।
এই আফ্রিকার বুকে অনেক জনজাতি রয়েছে। যাদের কালচার, রীতি-নীতি, খাদ্যাভ্যাস পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলোর থেকেও আলাদা৷ আফ্রিকার বিভিন্ন জনজাতি সম্পর্কে বহুদিন থেকেই গবেষণা করছেন এক বাঙালি দম্পতি। বাঙালি লেখক অনন্য চৌধুরী ও লেখিকা ধৃতি সেনগুপ্ত। সম্প্রতি নেচার পত্রিকা থেকে প্রকাশিত হলো তাদের একটি গবেষণাপত্র। তারা পপুলেশন জেনেটিক্স নিয়ে এক দশক ধরে কাজ করছেন।
রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের মলিকিউলার বায়োলজি-বায়োফিজিক্স ও জেনেটিক্স বিভাগ থেকে পিএইচডি করেন অনন্য চৌধুরী। তারপর ২০১০ সালে তিনি পাড়ি দেন দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানসবার্গে। কয়েক বছর পর তার স্ত্রী ধৃতি সেনগুপ্ত যোগ দেন পপুলেশন জেনেটিক্সের গবেষণাতে। তাদের যুগান্তকারী গবেষণা সাড়া ফেলে দিয়েছে বিজ্ঞানীমহলে। এর আগে এতো ব্যাপক ভাবে আফ্রিকান জনজাতি নিয়ে গবেষণা হয়নি। তারা এ গবেষণাতে নানান অজানা তথ্যের সন্ধান দিয়েছেন।
আফ্রিকার বহু জাতি-উপজাতির বিপুল সংখ্যক জিন বৈচিত্র্যের উৎস, আফ্রিকান জনজাতির জেনেটিক ভ্যারিয়্যান্টসের পরিমাণ ও ৭০ পুরুষ পূর্বে আফ্রিকান উপজাতিরা কীভাবে আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে প্রভৃতি বিষয়ে গবেষণা করছেন তারা। এতোদিন আফ্রিকান জনজাতি সম্পর্কিত গবেষণা ইউরোপ বা আমেরিকাতে হয়েছে কিন্তু তাদের হাত ধরে আফ্রিকার বুকে প্রথম এরকম গবেষণা হচ্ছে। আগে ইউরোপে জনজাতি সম্পর্কিত গবেষণাতে কেবল আফ্রিকা থেকে জিন সংগ্রহ করা হতো।
দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানসবার্গের সিডনি ব্রেনার ইন্সটিটিউট ফর মলিকিউলার বায়োসায়েন্স ও কেপটাউনে বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা গবেষণার কাজটি চালিয়েছেন। তাদের এই গবেষণা বিজ্ঞানজগতে নতুন মোড় তৈরি করেছে। এ গবেষণার ফলে জানা গেছে আফ্রিকার ৩০০ জিনোম থেকে প্রায় ৩০ লাখ জেনেটিক ভ্যারিয়েন্টস (যার বাংলা অর্থ জিনগত বৈচিত্র্য) পাওয়া যায়। যার পরিমাণ ইউরোপীয়ান জনজাতির থেকেও বেশি।
এ গবেষণাতে আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল লক্ষ্য করা গেছে। নাইজেরিয়ার কয়েকশো কিলোমিটার জায়গার মধ্যে দুটো জনগোষ্ঠী আছে, একটির নাম ইওরোবা ও আরেকটি বিরোম। দুই জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা বান্টু। এই দুটো জনগোষ্ঠী মূলত পশ্চিম আফ্রিকান। এদের জিনগত বৈচিত্র্যর মধ্যে এক আশ্চর্যজনক বৈসাদৃশ্য রয়েছে। বিরোমের মধ্যে যে জিনগত মিশ্রণ আছে তা ইওরোবার মধ্যে নেই। এই মিশ্রণ প্রধানত কোনো এক প্রকার অজানা মাইগ্রেশনের ফলাফল। এমন জনগোষ্ঠীর মিশ্রণের কথা এর আগে কোনো গবেষণাতে ধরা পড়েনি৷ আগে ধরা হতো যে মানুষের বিবর্তন প্রধানত ম্যালেরিয়া, স্লিপিং সিকনেস প্রভৃতি রোগের সাথে জড়িত। অথচ এ গবেষণা প্রমাণ করতে সমর্থ হয়েছে যে মানুষের বিবর্তনে ভাইরাল সংক্রমণেরও যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে।
প্রতিবেদন- সুমিত দে
Post a Comment