ঊনবিংশ শতকে নারী শিক্ষার কথা প্রথম বলেন ইয়ং বেঙ্গলের সদস্য ও ভাষাবিদ কৃষ্ণমোহন ব্যানার্জী
বাংলার নবজাগরণের ফলে নারীশিক্ষার বিস্তার, যুক্তিবাদী চেতনার প্রসার, বিধবা বিবাহ আইন পাশ হয়, সতীদাহ প্রথা রদ হয়, বাল্যবিবাহ রদ করার চেষ্টা শুরু হয়েছিল। এই আন্দোলন বাঙালিকে ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে অনেকটাই বের করে আনতে সমর্থ্য হয়েছিল। এই নবজাগরণ শুরু হওয়ার জন্য ডিরোজিওর ইয়ং বেঙ্গলের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। ইয়ং বেঙ্গল নবজাগরণের অনুঘটক রূপে কাজ করেছিল।
ইয়ং বেঙ্গলের দ্বারা শত শত বাঙালির মুক্ত চিন্তার বিকাশ ঘটে কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। হিন্দুদের বর্ণবৈষম্যের জন্য যিনি কলম ধরেছিলেন। নবজাগরণের সময় রাধাকান্ত দেব রাজা রামমোহন রায়ের সতীদাহ প্রথা রদ এবং বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহের প্রচলনের চরম বিরোধীতা করেন। রাধাকান্ত দেব রাজা রামমোহন রায়ের সতীদাহ প্রথা রদের বিরুদ্ধে লর্ড বেন্টিঙ্কের সাথেও কথা বলেছিলেন যাতে এই আইন না পাশ হয় তখন (১৮৫০) কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় একটি বইতে ওনার সমালোচনা করে ওনাকে লিখলেন গাধাকান্ত দেব।
কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতেই বসতো ডিরোজিওর শিষ্যদের আড্ডা। ওনারা হিন্দু মুসলমান ছোয়াছুঁয়ি মানতেন না, মুসলমানদের দোকান থেকে রুটি কিনে এনে খেতেন যার ফলে ওনার বিরুদ্ধে রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ ওনার নিজের বাড়ি থেকেই ওনাকে বিতাড়িত করলে উনি দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে আশ্রয় নেন। ১৮৪০ সালে তিনি 'ন্যাটিভ ফিমেল এডুকেশন' নামে একটি গবেষণা পত্র প্রকাশ করেন যাতে তিনি ভারতীয় নারীদের প্রাথমিক শিক্ষা সম্পর্কে সচেতন করে বলেন নারীদের উন্নয়নে শিক্ষা আবশ্যক, নারীশিক্ষা ছাড়া সমাজের উন্নতি অসম্ভব।
নারী শিক্ষার জন্য মিস অ্যাক্রয়েডের তত্ত্বাবধানে বঙ্গ মহিলা স্কুল প্রতিষ্ঠিত হলে উনি ওনার মেয়েকে ওখানে ভর্তি করেন। রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরোধীতা করায় ডিরোজিও হিন্দু স্কুল থেকে বিতাড়িত হলে কৃষ্ণমোহন ব্যানার্জী এনকোয়ারার নামে একটি সাময়িকী প্রকাশ করে তিনি এর প্রতিবাদ করেন। হিন্দু ধর্মের রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে বার বার তিনি মুখ খুলেছেন ও নারী শিক্ষার ব্যাপারে ওনার চিন্তাভাবনায় অনেকেই প্রভাবিত হয়েছিলেন। এর পাশাপাশি বাংলা ভাষার প্রথম বিশ্বকোশ বিদ্যাকল্পদ্রুম তেরো খন্ডে তিনি প্রকাশ করেন। তিনি বাংলা, ইংরেজি, সংস্কৃত, গ্রিক এবং হিব্রু ভাষায় ছিলেন সুপণ্ডিত। মুক্ত চিন্তার প্রসারের জন্য তিনি বেথুন সোসাইটি, বঙ্গীয় সমাজ-বিজ্ঞান সভা, ভারত সংস্কার সভা এবং এশিয়াটিক সোসাইটির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন।
নিজ বাড়ি থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর তিনি আলেকজান্ডার ডাফের সংস্পর্শে আসেন এবং খ্রিস্টধর্মে রূপান্তরিত হন ফলে রক্ষণশীল সমাজে তীব্র বিতর্কের মধ্যে পড়েন ফলে হেয়ার স্কুলের চাকরি থেকেও তিনি বিতাড়িত হন এবং তিনি ত্যাজ্যপুত্র হন। যে কারণে ওনার স্ত্রীও ওনার সহধর্মিনী হতে প্রথম দিকে অস্বীকার করেছিলেন। শিবনাথ শাস্ত্রীর মতে বিশপ উইলশন আস্ত একটি গীর্জা বানিয়ে ওনাকে দান করেছিলেন (বিধান সরণীর ক্রাইস্ট চার্চ)।
তথ্যসূত্র- রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ, শিবনাথ শাস্ত্রী; সংসদ বাঙ্গালী চরিতাভিধান, সম্পাদনা সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু, Tattwabodhini Patrika and the Bengal Renaissance by Amiya Kumar Sen
Post a Comment