বাঘনাপাড়া নামের উৎপত্তির আড়ালে লুকিয়ে থাকা গল্প
পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমান জেলায় অবস্থিত বাঘনাপাড়া রেলওয়ে স্টেশন। মূলত অম্বিকা কালনা স্টেশনের আগের স্টেশন হল এই বাঘনাপাড়া। একটি প্রাচীন সমৃদ্ধ গ্রাম। এই গ্রামের কিছু ইতিহাস রয়েছে তা তাহলে জানা যাক।
পশ্চিমবাংলার বৈষ্ণব শ্রীপাট গুলির মধ্যে বর্ধমান জেলার বাঘনাপাড়ার একটা বিশেষ গুরুত্ব আছে। কাটোয়া বা অম্বিকা কালনার তুলনায় বাঘনাপাড়ার গুরুত্ব টা কম নয়, যদিও গুরুত্ব টা অন্যদিক দিয়ে বিচার্য। বাংলার বৈষ্ণব সংস্কৃতিতে বাঘনাপাড়ার গোস্বামীরা একটি বিশেষ ভূমিকা গ্ৰহণ করেছিলেন। খড়দহ, শান্তিপুর, জিরাট প্রভৃতি অঞ্চলের গোস্বামী দের মতো। বৈষ্ণব সমাজে তাদের প্রতিপত্তি আজও অক্ষুন্ন রয়েছে। প্রায় শ্রীচৈতন্যের কাল থেকেই বাংলাদেশে তাঁদের ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে দেখা যায়।
বর্ধিষ্ণু গ্রাম ছিল না তখন বাঘনাপাড়া, ধর্ম কেন্দ্র ও বিদ্যা কেন্দ্রও ছিল না। সুতরাং, ব্রাহ্মণ বৈদ্য কায়স্থাদির ও বাস ছিল না, তাহলে কাদের বাস ছিল ? এখন অবশ্য বাঘনাপাড়া ব্রাহ্ম প্রধান গ্রাম, তখন ছিল অব্রাহ্মণ প্রধান গ্রাম অর্থাৎ গ্রামে সেই সময় জেলে বাগদি ইত্যাদির বাস ছিল বেশি। বাঘনাপাড়া গ্রামের দক্ষিণ থেকে পূর্ব দিকে ছিল বল্লুকা নদী। এই বল্লুকা নদীই ধর্ম পূজার আদি পীঠস্থান বলে প্রসিদ্ধ।
এবার বাঘনাপাড়া নামটির উৎপত্তি কোথা থেকে এসেছে, আর সেই উৎপত্তির পেছনে কি বা কিংবদন্তি রয়েছে তা জানা যাক।
বাঘনাপাড়া অঞ্চল আগে জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল এবং সেই জঙ্গলে নাকি আগে বাঘ বাস করত। আর সেটা আজও হয়তো অনেকের মুখে বহু প্রচলিত। বাঘনাপাড়া গ্রাম প্রধানত গোস্বামীদের চেষ্টায় এখন বেশ সমৃদ্ধ গ্রামে পরিণত হলেও একসময় যে শ্বাপদসঙ্কুল জঙ্গলে পরিবেষ্টিত ছিল, বিশেষ করে তিন চারশো বছর আগে তা জানাই যায়। বাঘনাপাড়া গঙ্গার পূর্বে ও পশ্চিমে অনেক পাড়াই তখন জঙ্গলাকীর্ণ ছিল এবং এই জন্য ই সেখানে হয়তো বাঘ ও ভাল্লুকের বাস ছিল।
একটি কিংবদন্তি হল, শাপগ্ৰস্ত ব্যাঘ্রপাদ মুনি ব্যাঘ্র কলেবর ধারণ করে এখানে তপস্যা করেন। কঠোর তপস্যার ফলে তিনি শাপমুক্ত হন। এই ব্যাঘ্রপাদ মুনির স্মৃতি বিজড়িত গ্রাম বলে এর নাম হল বাঘনাপাড়া।
দ্বিতীয় কিংবদন্তি জানা যায়, 'বংশী শিক্ষা' গ্ৰন্থ থেকে। এই গ্ৰন্থে বলা হয়েছে যে এই অঞ্চলে আগে গভীর জঙ্গল ছিল এবং তাতে নাকি বাঘ ও বাস করত। নিত্যানন্দ পত্নী জাহ্নবা দেবীর পালিত পুত্র রামচন্দ্র গোস্বামী (বাঘনাপাড়ার গোস্বামী বংশের প্রতিষ্ঠাতা) বা রামাই জঙ্গলাকীর্ণ জায়গায় বাঘকে হরি নামে বশীভূত করে গ্রাম কে ব্যাঘ্রহীন করার জন্য গ্রামের নাম বাঘনাপাড়া। বৈষ্ণব সংস্কৃতির কেন্দ্র মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের পার্ষদ বংশীবদন চট্ট বাঘনাপাড়ায় বসতি স্থাপন করেছিলেন। বংশী বদনের পৌত্র ও চৈতন্য দাসের পুত্র রামচন্দ্র বা রামাই কে দীক্ষা দিয়ে জাহ্নবা দেবীর পালিত পুত্র হিসাবে গ্ৰহণ করেছিলেন। জাহ্নবা দেবীর সঙ্গে বৃন্দাবন পরিক্রমা করে বৃন্দাবন থেকে কৃষ্ণ বলরামের বিগ্ৰহ এনেই রামাই বাঘনাপাড়ায় প্রতিষ্ঠা করেন। মাঘ মাসের কৃষ্ণা তৃতীয়াতে রামচন্দ্রের তিরোধান দিবসে ছয় দিন ব্যাপী মহোৎসব হয়।
বংশীবদন ও বংশী দাসের জীবন চরিত 'বংশী শিক্ষা' গ্ৰন্থে বাঘনাপাড়া র ইতিহাস উল্লেখ করা রয়েছে। মূলত বংশীবদন গোস্বামী ছিলেন শ্রীচৈতন্যের পাশ্বচর। সন্ন্যাস গ্রহণের পর শ্রীচৈতন্যে যখন তীর্থ যাত্রা করেন তখন নবদ্বীপে তাঁর মা ও স্ত্রীর দেখা শুনার ভার দিয়ে যান বংশী বদনের উপর। শোনা যায়, এই সময় নাকি বংশীবদন বিষ্ণু প্রিয়ার বিরহ বেদনায় কাতর হয়ে শ্রীচৈতন্যের মূর্তি তৈরি করান।
শ্রীচৈতন্যের তীর্থ যাত্রাকালে দেখা যায় তিনি ও তাঁর সহচরবৃন্দ এই রকম সংকীর্তন করে পথের অনেক বিপদের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছেন। মূলত গোস্বামী দের বসবাসের ফলে এখানে আস্তে আস্তে জনবসতি বাড়তে থাকে। লোকের বসবাস করলে বাঘের বাস এমনিতেই কমে যাবে।
রামাই পন্ডিতের নামে প্রসিদ্ধ 'শূণ্য পুরাণে'ও দেখা যায় – "বৈকুণ্ঠে তে জীয়ে ধর্ম, বল্লুকা তে স্থিতি।" এছাড়াও বৈশাখী পূর্ণিমায় কৃষ্ণ বলরামের ফুল দোল, দোল যাত্রায় কৃষ্ণ বলরাম রেবতী ও রাধারানীর গ্রাম পরিক্রমার উৎসব। চৈত্র মাসে গোপীশ্বর শিবের গাজন, জগন্নাথের স্নানযাত্রা, রথযাত্রা, বংশীবদনের জন্মোৎসব প্রভৃতি গ্রামটিকে সত্যি উৎসব মুখর করে রাখে।আর বল্লুকা নদীর তীরে বাঘনাপাড়ায় ধর্মরাজ ও মনসার অধিষ্ঠান।
মাঘ মাসের শুক্লা দ্বিতীয়ায় ধর্মরাজের জাত উৎসব ও জ্যৈষ্ঠ মাসের সংক্রান্তিতে মনসার ঝাপান উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।
তথ্যসূত্র- বর্ধমানের ইতিহাস – সত্য সিঙ্কর মুখোপাধ্যায়।
Post a Comment