কানাইলাল দত্তদের মতো বীরদের কাছে গোপনে পিস্তল পৌঁছে দিতে শ্রীশচন্দ্র ঘোষ ছিলেন অতুলনীয়
স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্দোলনের জন্য তখন অগ্নিযুগ, বাংলার মাটি তখন তপ্ত। ব্রিটিশদের বুকে ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল একের পর এক বিপ্লবী। বিভিন্ন সময়ে মেদিনীপুরে একের পর এক ডিস্ট্রিক্ট মেজিস্ট্রেট খুন হচ্ছেন, বিনয় বাদল দিনেশরা রাইটার্স হামলা করছেন তো কোথাও বুড়িবালামের তীরে বিদেশ থেকে অস্ত্র এনে ইংরেজদের হামলা করছেন বাঘা যতীন তো কোথাও মাস্টারদার নেতৃত্বে অস্ত্রাগার লুন্ঠন হচ্ছে। এরকম একের পর এক ঘটনাই স্বাধীনতার অনুঘটক রূপে কাজ করেছে।
বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আন্দোলনে বাঙালি জাতীয়তাবাদী পত্রিকা হিতবাদীর ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এই পত্রিকার আড়ালে চলতো বিপ্লবীদের ঐক্যবদ্ধকরার কাজ। হিতবাদী পত্রিকায় কাজ করার সুবাদে বিপ্লবীদের সাথে আলাপ হতে শুরু করে অগ্নিযুগের মহাবিপ্লবী শ্রীশচন্দ্র ঘোষের। সেইসব বিপ্লবীদের ইংরেজদের চোখে ধুলো দিয়ে আশ্রয় দেওয়া ও তাদেরকে গোপনে বন্দুক পৌঁছে দেওয়ার কাজে হাতে খড়ি হয় শ্রীশচন্দ্র ঘোষের সেই থেকে এ কাজে তিনি পারদর্শী হয়ে ওঠেন।
ফরাসি উপনিবেশ চন্দননগরকে কাজে লাগিয়ে বিপ্লবীরা চালাতেন একের পর এক দুঃসাহসী কার্যকলাপ। চন্দননগরে বাড়ি ছিল শ্রীশচন্দ্র ঘোষের যে কারণে তিনি এই কাজের ভার নিতেন। ইংরেজরা ফরাসিদের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে ওনার বাড়ির সামনে পুলিশ ফাঁড়ি বসিয়েও ওনাকে ধরতে পারেনি।
বাংলা, পাঞ্জাব এবং মহারাষ্ট্রের বিপ্লবীরাও একযোগে বিভিন্ন পরিকল্পনা করতেন ব্রিটিশ তাড়াতে। মহারাষ্ট্রের বিপ্লবী সখারাম গনেশ দেউস্কর ছিলেন মারাঠী এবং বাংলা ভাষায় সুপন্ডীত তিনি হিতবাদী পত্রিকার সম্পাদনা করার দায়িত্ব নেন। তখন সখারাম গনেশ দেউস্করের মাধ্যমে শ্রীশচন্দ্র ঘোষের বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর পরিচয় হয়। রাসবিহারী বসুকে একাধিক বার পুলিশের নজর এড়িয়ে বিপ্লবী শ্রীশচন্দ্র ঘোষ পৌঁছে দিয়েছেন ওনার গন্তব্যে। চন্দননগরের কুখ্যাত মেয়র তার্দিল্যাভ হত্যার চেষ্টা, ডেনহ্যামের হত্যার চেষ্টার সময়ও তিনি বিপ্লবীদের সাহায্য করেছিলেন। রডা কোম্পানির লুন্ঠন করা কার্তুজ ও মাউজার পিস্তল তিনি পৌঁছে দিয়েছিলেন বিপ্লবীদের ডেরায়।
রাসবিহারী বসুুর বিরুদ্ধে নরেন্দ্রনাথ গোস্বামী বা নরেন গোসাঁই রাজসাক্ষী হন। নরেন গোঁসাই এভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করলে তাকে হত্যার পরিকল্পনা করেন বিপ্লবী কানাইলাল দত্ত তখন আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে কানাইলাল দত্তের কাছে ছলচাতুরী করে রিভলবার পৌঁছে দেন বিপ্লবী শ্রীশচন্দ্র ঘোষ। বিপ্লবী নরেন গোঁসাই পুলিশের কড়া পাহারায় জেলে বন্দী ঠিক তখনই অসুস্থতার অজুহাতে হাসপাতালে ভর্তি হন কানাইলাল দত্ত। সেখানে বিপ্লবী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সহায়তায় নরেন গোঁসাইকে হত্যা করেন বিপ্লবী কানাইলাল দত্ত যার বিচারে ওনাদের দুজনের ফাঁসির দন্ড দিয়েছিল আদালত।
বিপ্লবী মতিলাল রায়, রাসবিহারী বসু, অমরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো বিপ্লবীদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষার কাজ করতেন বিপ্লবী শ্রীসচন্দ্র ঘোষ। এছাড়াও দীনেশচন্দ্র মজুমদার, অরবিন্দ ঘোষ এরকম বহু ফেরারী বিপ্লবীকে নিরাপদে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন শ্রীশচন্দ্র ঘোষ। বহুবার একাজে ওনাকে সহায়তা করতেন বিপ্লবী মতিলাল রায়। ব্রিটিশ পুলিশ ওনাকে ধরার জন্য বাড়ির সামনে পুলিশ ফাঁড়ি বসায় তা সত্বেও তিনি পুলিশের চোখে বার বার ধূলো দিয়ে সাহারানপুর, লক্ষ্ণৌ, লাহোর, বেনারস, দিল্লি গেছেন ও নিরাপদে ফিরে এসেছেন কোনোভাবেই পুলিশ ওনাকে ধরতে পারেনি। বিপ্লবী রাসবিহারী বসু বিপ্লবী শ্রীশচন্দ্র ঘোষকে জাপান থেকে বিভিন্ন নির্দেশ সহ চিঠি পাঠাতেন কিন্তু শেষ দিকে কয়েকটি নির্দেশ সফল না হওয়ার কারণে ভেঙে পড়েন বিপ্লবী শ্রীশচন্দ্র ঘোষ এবং দুঃখের সাথে আফিম খেয়ে আত্মহত্যা করেন।
এক নির্ভীক মহাবিপ্লবী ছিলেন শ্রীশচন্দ্র ঘোষ কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় উনি এখনও বিস্মৃতির আড়ালে থেকে গেছেন। আজ বাঙালির অনেকেই বলেন বাঙালিরা নাকি ভীতু, দুর্বল সেইসব মানুষদের একরাশ করুণা ও অনুরোধ অগ্নিযুগের ইতিহাস পড়ুন ও বাঙালি জাতির প্রকৃত ইতিহাস জানুন।
তথ্যসূত্র- নারায়ন সান্যাল (১৯৭৯), আমি রাসবিহারীকে দেখেছি, কলকাতা: করুনা প্রকাশনী; প্রথম খন্ড, সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু (২০০২), সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান।
Post a Comment