মন্দিরের শহর অম্বিকা কালনার প্রসিদ্ধ তীর্থক্ষেত্র সিদ্ধেশ্বরী মন্দির
বহু বছরের পুরানো শহর কালনা। ভাগিরথী নদীর এ পারে কালনা আর ওপারে শান্তিপুর। ১৬৬০ খ্রিষ্টাব্দে ভন ডেন ব্রুকের মানচিত্রে প্রর্দশিত একালের অম্বিকা কালনা হল 'Ambowa'। বৃন্দাবন দাস তাঁর চৈতন্য ভগবতে অম্বিকা কালনা কে উল্লেখ করেছেন– "এই মতে সপ্তগ্ৰামে অম্বয়া মুলুকে। বিহরেন নিত্যানন্দ পরম কৌতুকে"।। অনেকের অনুমান, অম্বুঋষির আশ্রম স্থল হিসেবে স্থানটি প্রসিদ্ধিলাভ করেছিল অম্বিকা নামে।
এই শহর যে একসময় তন্ত্রসাধনার কেন্দ্র ছিল তারও প্রমাণ মেলে। কালী থেকেই শহরের নামকরণ কী না,তা নিয়ে চর্চা চলে আজও। শহরের নাম কালনা হলেও রেল স্টেশনের নাম কিন্তু অম্বিকা কালনা। শুধু শহর কালনাই নয়, মহকুমার পূর্বস্থলী, মন্তেশ্বরেও রয়েছে অনেক প্রাচীন ইতিহাস বিজড়িত কালী মন্দির।।অবশ্য বলা যায় অধিকাংশ মসজিদ-ই তৈরি হয়েছিল মূলত হিন্দু দেবালয়ের ভগ্নাবশেষ দিয়ে। আবার অনেকে বিশ্বাস করেন যে, অম্বিকা দেবীর মন্দির আদিতে জৈন মন্দির ও এখানে জৈন দেবতা ছিলেন।তা থেকে অনুমান করা হয়, কালনায় জৈন দের প্রভাব ছিল। কালনায় মুসলমান যুগের নিদর্শনগুলি মূলত তুর্কি আফগান রাজত্বকালের। এই সময় ইসলাম সংস্কৃতিতে প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে কালনা। আবার একই সময় কালনা সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র হয়ে ওঠে শ্রীচৈতন্য ও নিত্যানন্দের প্রভাবে।
কালনা শহরের সংস্কৃত সাহিত্যের পন্ডিত তারানাথ তর্কবাচষ্পতি মহাশয় কে কলকাতার সংস্কৃত কলেজে নিয়োগের জন্য কালনায় আসেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। শাও কবি কমলাকান্তের জন্ম কালনার বিদ্যাবাগীশ পাড়ায় ১৭৭১সালে।
স্বর্গীয় বিনয় ঘোষ মন্তব্য করেছেন-"অম্বিকা কালনার অম্বিকা জৈনদেবী ছিলেন। পরে তিনি হিন্দু শক্তি পূজায় স্বাতন্ত্র্য বিসর্জন দিয়েছেন। বৌদ্ধতন্ত্রের প্রভাবের যুগেই বাংলাদেশে অম্বিকা পূজার প্রচলন ছিল মনে হয়। অর্থাৎ পাল যুগে। অম্বিকা কালনার ইতিহাস হিন্দু পাল যুগ পর্যন্ত বিস্তৃত নাহলে "অম্বিকা" কথার ব্যাখ্যা করা যায় না"। উমাকান্ত প্রেমানন্দ শাহ রচিত "Iconography of the Jain Goddess Ambika" নামক একটি প্রবন্ধ অবলম্বনে (Journal of the university of Bombay, 1940). উক্ত মন্তব্যটি করেছিলেন শ্রদ্ধেয় বিনয় ঘোষ।
এই মূর্তিটি ঘিরে যে তন্ত্রসাধনা বা গুহ্য সাধনার চর্চা ছিল...... সে কথাও অনস্বীকার্য। বাংলার কুটির দেউল শিল্পের অন্যতম নির্দশন এই মন্দির। মন্দিরের গায়ে রয়েছে পোড়ামাটির কাজে নগর সংকীর্তন এর ছবি। যা বৈষ্ণব ও শাক্তধর্মের মিলনের ছবি তুলে ধরেছে বলে মনে করা হয়। ইতিহাসের অনেক কথাই বুকে ধরে রয়েছে সিদ্ধেশ্বরী কালীর মূর্তি ও মন্দির। দারু নির্মিত দেবী মূর্তিতে নেই কোনও সূক্ষ্ম কাজের ছোঁয়া। যা থেকে অনুমান করা হয়, দারু শিল্পের একেবারে প্রথমাবস্থায় অর্থাৎ আনুমানিক ষষ্ঠ বা সপ্তম শতাব্দীতে এই মূর্তিটি তৈরি হয়েছিল।
অম্বিকা কালনার "জোড়বাংলা" শৈলীর একমাত্র মন্দিরটি হলো সৃষ্টি অম্বিকা সিদ্ধেশ্বরী মহামায়ার। এই দেবীকে অনেকেই মনে করেন যে ইনি জৈন দেবী। আর তাঁরই নামানুসারে হয় শহরের নামকরণ। পূর্বে "অম্বিকা" ও "নিজ কালনা" নামে দুটি আলাদা অঞ্চল ছিল। পরবর্তীকালে স্থান দুটি একীকরণ করে নাম হয় "অম্বিকা কালনা"। সাধারণের কাছে এই দিবি "সিদ্ধেশ্বরী কালী" নামে পরিচিত হলেও মন্দিরের প্রবেশদ্বারের উপরে যে শ্বেত পাথরের ফলক লাগানো আছে তাতে দেবীকে ওই পূর্বোক্ত নামেই অভিহিত করা হয়েছে।
অতীতের কথা থেকে জানা যায় কীর্তি চন্দ্রের পুত্র ছিলেন চিত্রসেন রায়। দক্ষ প্রশাসক ও প্রশাসন গুণে বাংলা সুবাদার নবাব ও দিল্লীশ্বরের অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন তিনি। চিত্রসেন ই সর্বপ্রথম দিল্লির বাদশাহ মোঘল সম্রাট মহম্মদ শাহ কর্তৃক "রাজা" উপাধি লাভ করেন ১৭৪১ খ্রিস্টাব্দে। তখনকার সময় গভীর জঙ্গলে ভরা ছিল আজকের ব্যাণ্ডেল- নবদ্বীপ রেলপথের অম্বিকা কালনা।
একদিন রাজা চিত্রসেন রায় ঘোড়ায় চেপে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ করেই তার কানে এল ঘন্টা বাদ্যের ধ্বনি। রাজা তা লক্ষ্য করেই জঙ্গলের গভীরে ঢুকে পড়লেন। দেখলেন জনহীন একটি প্রাচীন ভাঙ্গা মন্দির। গর্ভ মন্দিরে দেবী কালীকে বিগ্রহের সামনে সাজানো রয়েছে পুজোর নানা উপকরণ। সেই দেখেই রাজা প্রাসাদে ফিরে চলে এলেন ।
১৭৩৯ সালে প্রাচীন ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দির ক্ষেত্রেই নতুন মন্দির নির্মাণ করে নিত্য পূজার ব্যবস্থা করেছিলেন রাজা চিত্রসেন রায়। কালনায় যতগুলো মন্দির আছে তার মধ্যে সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরের স্থাপত্যরীতির একেবারেই অনন্য সাধনা।
কালি বা কালিকা হলেন একজন হিন্দু দেবী। তাঁর অন্য নাম শ্যামা বা আদ্যা শক্তি। প্রধানত শাক্ত ধর্মাবলম্বীরা কালীর পূজা করেন। তন্ত্র শাস্ত্রের মতে, তিনি দশমহাবিদ্যা নামে পরিচিত তন্ত্র মতে পূজিত প্রধান দশজন দেবীর মধ্যে প্রথম দেবী। বাঙালি হিন্দু সমাজে দেবী কালীর মাতৃরূপের পূজা বিশেষ জনপ্রিয়। পুরান ও তন্ত্র গ্রন্থগুলোতে বিভিন্ন রূপের বর্ণনা পাওয়া যায়। বানেশ্বর শিব মন্দিরের মত একই উচ্চতাবিশিষ্ট গম্বুজাকৃতি আরেকটি যে মন্দির সহজেই নজর কাড়ে তা হল সিদ্ধেশ্বরী মন্দির। খুব জাগ্ৰত এই দেবী কালের বিবর্তনে হিন্দু ধর্মের দেবী কালীতে রূপান্তরিত হয়ে সিদ্ধেশ্বরী মাতা নামে পরিচিত হয়েছেন। ভাদুড়ী পাড়ায় অবস্থিত মন্দিরের বিগ্রহ দীঘির জল ও নিম কাঠ দিয়ে তৈরি করে সাধনায় বসেন সাধক অম্বরীশ, ৬৮৮ সনে সিদ্ধিও লাভ করেন এই সাধক। কিন্তু তখন কোন মূর্তি ছিল না।
মন্দিরটি উঁচু ভিত্তি-বেদির ওপর প্রতিষ্ঠিত। মন্দিরটিতে উঠবার জন্য আটটি ইটের ঢেউখেলানো সিঁড়ি ও একটি পাথর বসানো সিঁড়ি আছে । গায়ে পোড়ামাটির কাজ। দরজাটি আকারে বিশাল নয়। প্রাচীন মন্দিরের গর্ভগৃহ একেবারে জমজমাট। মাথায় বসনে ভূষনে সুসজ্জিতা। মাথায় মুকুট, নাকে নথ। করুণাঘন আকন ফালা ফালা চোখ। মাধুর্যে ভরা মুখমন্ডল। উচ্চতায় চার থেকে পাঁচ ফুট। মৃন্ময়ী বিগ্ৰহ মতান্তরে নিমকাঠে নির্মিত। দেখলে মনে হয় কষ্টিপাথরের। দক্ষিণ দুই হস্তে বরাভয় মুদ্রা। বামের ঊদ্ধহস্তে খপর,নিম্নহস্তে নরমুন্ড। দেবী দারু নির্মিত হলেও শিবের মূর্তিটি কিন্তু দারু নির্মিত নয়। যোগী অম্ব্ঋষি প্রতিষ্ঠিত পঞ্চমুন্ডের আসনে প্রাচীন ঘটটি ডানদিকে। যোগীরাই প্রতিষ্ঠা করেন দেবীকে। অম্বরিশের নামানুসারেই তাঁর আরাধ্য অম্বিকাই দেবী "সিদ্ধেশ্বরী পাড়া" গ্রামের অধিষ্ঠাত্রী দেবী স্বয়ংসিদ্ধেশ্বরীই।
মা সিদ্ধেশ্বরীর প্রতিবছর কার্তিকী দীপান্বিতা কালীপুজোয় দেবীর পুজো হয় বিশেষ জাঁকজমকে। মন্দিরের সামনে একটি প্রতিষ্ঠা লিপি থাকলেও বারবার দেওয়া রঙের প্রলেপে তা ভীষণ অস্পষ্ট। তবে পূর্বে উদ্ধারী কৃত লিপিটির পাঠ হলঃ "শুভমস্তু শকাব্দা ১৬৬১/২/২৬/৬ শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী দেবীং শ্রী যুক্ত মহারাজা চিত্রসেন রায়স্য। মিস্ত্রি শ্রীরামচন্দ্র"।
অতএব লিপি থেকে জানা যায় যে, ১১৪৬ বঙ্গাব্দের ২৬ শে জৈষ্ঠ্য মন্দিরটি নির্মাণ করেন রাজা চিত্রসেন রায়। আর মন্দিরটির নির্মাণ শিল্পী ছিলেন শ্রী রামচন্দ্র মিস্ত্রী। মন্দিরের সামনে ত্রিলিখান অলিন্দ। খিলান গুলির উপরে আছে টেরাকোটার প্রতীক শিবমন্দির ও তার মধ্যে রয়েছে শিবলিঙ্গ। পোড়ামাটির কয়েকটি ফুল ও আছে। কিন্তু বারবার দেওয়া রঙের প্রলেপে টেরাকোটার কাজ খুবই অস্পষ্ট।
বর্তমান মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা চিত্রসেন হলেও তার বহু পূর্ব থেকেই দেবী সিদ্ধেশ্বরী স্বয়ং অধিষ্ঠাতা অম্বিকা কালনায়। চিত্রসেনের একশো বছর আগে "ধর্মমঙ্গল" লিখেছিলেন রূপরাম চক্রবর্তী। তাঁর গ্রন্থে দেবী সিদ্ধেশ্বরীর কথা উল্লেখিত হয়েছে এইভাবে "তোমার মহিমা মাতা কি বলতে পারি। অম্বুয়ার ঘাটে বন্দো কালিকা ঈশ্বরী"।
সিদ্ধেশ্বরী মন্দির প্রাঙ্গণে চারটি শিব মন্দির আছে। কিন্তু এগুলির ও কৌলিন্যে এতোটুকু মরচে ধরে নি। এদের মধ্যে তিনটি "আটচালা" রীতির। এদের মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৭৪৬ খ্রীঃ (১৬৬৮ শকাব্দ), প্রতিষ্ঠা করেন তিলক চন্দ্রের অমাত্য রামদেব নাগ। রাজা তিলক চন্দ্রের মাতা লক্ষী কুমারী দেবী মন্দির যে শিব মন্দির টি নির্মাণ করেন তার প্রতিষ্ঠাতা কাল ১৭৬৩ খ্রীঃ (১৬৮৫ শকাব্দ)।
প্রাচীন উপাখ্যানে দেখা যায় , বর্তমান কোচবিহার, গোয়ালপাড়া, অসম অঞ্চলে নরকাসুরের পুত্র ভগদত্ত রাজত্ব করতেন। এই ভগদত্তের বংশে রাজা ভাস্কর বর্মনের জন্ম। এই বংশের বিলুপ্তির পর কোচবিহার অঞ্চলটি রাজা ধর্মপাল অধিকার করেছিলেন। পরবর্তীকালে এর ধ্বংসাবশেষের ওপর ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে মহারাজা নরনারায়ন দুটি নাট মন্দির পঞ্চরত্ন সমেত ইটের পরিখা বেষ্টিত, বর্তমানের এই কামাক্ষীয় মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মন্দিরের ভিতরে রয়েছে ভগবতী মূর্তি।। সত্যি বলতে পুরো কালনা শহরটিকে যেন আলোকিত করে রেখেছে এই সিদ্ধেশ্বরী মাতার মন্দির।
সিদ্ধেশ্বরী মায়ের মন্দিরের বর্তমান সেবায়েতের সঙ্গে আমি। যাঁর কাছে থেকে মা এবং মন্দির সম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্য আমার লেখাকে আরো সমৃদ্ধ করে তুলতে সাহায্য করেছে। তাই আমি ওনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ।।
Post a Comment