আব্দুল কালামের সমতুল্য পরমাণু বিজ্ঞানী হয়েও প্রাপ্য সম্মান পেলেন না বিজ্ঞানী শেখর বসু
ভারতের পরমাণু বিজ্ঞানী বললে যে কজন বিজ্ঞানীর নাম উল্লেখ না করে আপনি পারবেন না তাঁরা হলেন হোমি জাহাঙ্গীর ভাবা, চৈতন্যময় গাঙ্গুলী, শেখর বসু, বাসন্তী দুলাল নাগচৌধুরী, পি.কে. আইনগার তাদের মধ্যে অন্যতম। বলতে গেলে এনারা না থাকলে ভারত পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র হতেই পারত না।
পরমাণুর অস্ত্রের সুফল নেই তা সকলেই জানি যদিও যুদ্ধ সমরাস্ত্রবিদরা একটা সূত্র মেনে চলেন এবং ধরা হয় যে দেশের পরমাণু আছে সেই দেশের সাথে বড় স্কেলের যুদ্ধে সহজে কোনো দেশ যায়না। উদাহরণ স্বরুপ আমেরিকা বিভিন্ন দেশের সাথে যুদ্ধ করেছে যেমন ইরাক, আফগানিস্থানের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করলেও তারা চীন, রাশিয়া বা উত্তর কোরিয়ার সাথে যুদ্ধে যেতে পারেনি। একইভাবে চীন, ভারত, পাকিস্তানের ঠান্ডা লড়াই চললেও কেউই বড় স্কেলের যুদ্ধ করার সাহস পাচ্ছেনা। উত্তর কোরিয়ার থেকে অস্ত্রে দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপান এগিয়ে কিন্তু তা সত্বেও তাদের প্রতিরক্ষায় আমেরিকার সাহায্য নিতে হচ্ছে। তাছাড়া মালাক্কা এবং দক্ষিণ চীন সাগরে চীন এবং আমেরিকার, আর্কটিক সাগরে আমেরিকা ও রাশিয়ার ঠান্ডা লড়াই চললেও তারা সরাসরি যুদ্ধের কথা কেউই বলেনা। কিন্তু পরমাণু না থাকলে সহজেই বড় স্কেলের যুদ্ধ এখনও হয় যেমন ইজরায়েল গাজাকে সহজেই আক্রমণ করতে পেরেছে, সিরিয়াতেও আমেরিকা বা রাশিয়া দুই দেশ প্রায়ই প্লেন থেকে বোমা নিক্ষেপ করে আসছে। আমেরিকা আফগানিস্তানে মোয়াব নিক্ষেপ করতে পেরেছে কিন্তু তারা কখনও বলেনা যে আক্সাই চীন ভারতকে চীন ফিরিয়ে দিক নইলে সেখানে মোয়াবের মতো বোমা নিক্ষেপ করবো। তাই যতক্ষণ না সমস্ত পরমাণু বোমা নিস্ক্রিয়করণ করছে তার আগে পর্যন্ত পরমাণু একটি দেশকে বড় বৈদেশিক আক্রমণ থেকে রক্ষা করে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।
ভারতের প্রথম পরমাণু শক্তিধর জাহাজ আই.এন.এস আরিহান্তের নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর তৈরির পিছনে যার সবচেয়ে বেশি ভূমিকা ছিল, তিনি হলেন শেখর বসু। আই.এন.এস ক্লাস সাবমেরিনের প্রজেক্ট ডাইরেক্টর ছিলেন তিনি। তামিলনাড়ুর থেনিতে পশ্চিম ঘাট পর্বতমালার ১২০০ মিটার নীচে তৈরি হয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নিউট্রিনো ডিটেক্টর আয়রন ক্যালোরিমিটার বা আইক্যাল যা আগে থাকা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নিউট্রিনো ডিটেক্টরটির চেয়েও চারগুণ বড়ো (অর্থাৎ এটিই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় চুম্বক) এই নিউট্রিনো গবেষণাগার তৈরিতে শেখর বসুর ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়। তারাপুর, ট্রম্বে এবং কালপক্কমে শেখর বসুর নেতৃত্বেই তেজস্ক্রিয় বর্জ্য পুনর্নবিকরণ ও ব্যবহারযোগ্য করে তোলা যায় কারখানা তৈরি হয় যা তেজস্ক্রিয় দূষণ কমানোর জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। তিনি নিউক্লিয়ার রিসাইকেল বোর্ডের চিফ একজিকিউটিভ থাকার সময় এই কাজটি করেছিলেন।
তিনি ভারতের পরমাণু শক্তি বিভাগের সচিব থাকাকালীন আমেরিকার ন্যাশানাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের সাথে ভারতের কয়েকটি বিজ্ঞান প্রজেক্টের মউ (MoU) চুক্তি সম্পাদন হয় যা ছিল পদার্থবিদ্যার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম মাধ্যাকর্ষণ তরঙ্গ শণাক্তকরণ যন্ত্র (Gravitational Wave Detector) এবং পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম লিগো ডিটেক্টার তৈরি যা তৈরি হচ্ছে মহারাষ্ট্রের হিঙ্গোলি জেলায়।
এছাড়াও শেখর বসুর তত্ত্বাবধানে কম খরচে রেডিওথেরাপি ট্রিটমেন্ট করা যায় এমন যন্ত্র তৈরি করা শুরু করে ভারতের পরমাণু শক্তি বিভাগ। ওনার তত্ত্বাবধানে ১০ টি প্রেসারাইজড হেভি ওয়াটার রিঅ্যাক্টর, ২ টি হেভি ওয়াটার রিঅ্যাক্টর এর মতো ২১ টি রিঅ্যাক্টর এবং কালাপক্কমের প্রোটোটাইপ ব্রিডার রিঅ্যাক্টর। এছাড়াও ওনার নেতৃত্বেই সার্নের সাথে ভারতের পরমাণু শক্তি বিভাগের চুক্তি হয় এবং ভারতের কোম্পানির ইঞ্জিনিয়াররা সার্নের গবেষণায় অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। অর্থাৎ ভারতের বিজ্ঞানচর্চাকে তিনি কয়েক ধাপ এগিয়ে দেয় ওনার বহুমুখী কার্যকলাপ।
তিনি ১৯৫২ সালের ২০ শে সেপ্টেম্বর বিহারের মুজফ্ফরপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তারপর তিনি বালিগঞ্জ গর্ভমেন্ট হাই স্কুলে ভর্তি হন। তারপর ভাবা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টারের ট্রেনিং স্কুল বীরমাতা জিজাবাই টেকনোলজিক্যাল ইনস্টিটিউট থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ গ্র্যাজুয়েট হন। তারপর তিনি ইন্ডিয়ান ন্যাশানাল অ্যাকাডেমি অফ ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ইন্ডিয়ান সোসাইটি ফৎ নন-ডেসট্রাকটিভ টেস্টিং এর ফেলো হন। ২০১২ সালে তিনি ভাবা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টারের ডিরেক্টর হিসেবে নিযুক্ত হন। ২০১৬ তে তিনি ভারতের পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিযুক্ত হন। তিনি ২০০২ সালে ন্যাশানাল নিউক্লিয়ার সোসাইটি অ্যাওয়ার্ড, ২০০৬ ও ২০০৭ সালে ডিপার্টমেন্ট অফ অ্যাটমিক অ্যানার্জি অ্যাওয়ার্ড এবং ২০১৪ সালে পদ্মশ্রী পুরষ্কার পান।
এত কিছুতে অবদানের পরও ওনাকে খুব বেশি মানুষ চেনেন না যা বাঙিলির কাছে লজ্জার। উনি কলকাতা শহরে মাত্র ৬৮ বছর বয়সে কোভিড-১৯ এ মৃত্যুবরণ করেন গত ১৭ ই সেপ্টেম্বর। বাঙালি পরমাণুবিদ হিসেবে তিনি বাঙালির কাছে গর্বের।
Post a Comment