দৃষ্টিহীন হয়েও রেডিও চ্যানেল খুলে নতুন প্রতিভা তুলে আনছেন আরজে সায়ন্তন ব্যানার্জি
কেবল দৃষ্টিহীন হওয়ার জন্য তার কপালে জুটেছিল বহু আঘাত ও অবহেলা। জীবনের চলার পথে বাঁধা হয়ে ওঠে তার নিত্যসঙ্গী। মাত্র নয় মাস বয়সেই সারাজীবনের জন্য দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেললেন তিনি। চোখের সামনে শুধুই অন্ধকার তার। জীবন থেকেও যেন নেই। অনেকটা মৃতের চোখ দিয়ে বিশ্ব দেখার মতো অবস্থার মধ্য দিয়ে দিন কাটছে তার।
কলকাতার ২৯ টি নামীদামী স্কুলে ভর্তি নেওয়া হয়নি তাকে। সেইসব স্কুলে দৃষ্টিহীনদের পড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। স্কুলগুলোতে দৃষ্টিহীনদের পড়ানোর মতো পরিকাঠামোর যথেষ্ট অভাব। এই দৃষ্টিহীন ব্যক্তিটিকে ২৯ টি নামীদামী স্কুল ফেরালেও তার ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যায়নি। তার নিজস্ব প্রতিভার মন্ত্রবলে তিনি হয়ে উঠলেন একজন রেডিও জকি। তিনি হলেন কসবার বাসিন্দা সায়ন্তন ব্যানার্জি।
যারা প্রধানত শিল্পী হন, তারা দৃষ্টিহীন হোক কিংবা প্রতিবন্ধী হোক তাদের কোনো বাঁধার গন্ডি টেনে আটকে রাখা যায়না। দৃষ্টিহীন হয়েও কবি হোমার লিখেছেন 'ইলিয়াড ও ওডিসি' মহাকাব্য, জন মিল্টন দৃষ্টিহীন হয়েও লিখেছেন 'প্যারাডাইস লস্ট' কাব্য, হেলেন কেলার দৃষ্টিহীন হয়েও একজন কিংবদন্তি লেখিকা হয়ে ওঠেন। বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় দৃষ্টিহীন হয়েও একজন নামকরা চিত্রকর হয়ে ওঠেন। এমন হাজারো উদাহরণ আছে। সায়ন্তন ব্যানার্জিও তাদের মতোই একজন দৃষ্টিহীন শিল্পী। পেশা ও প্যাশনকে কাজে লাগিয়ে কলকাতার দ্বিতীয় দৃষ্টিহীন ব্যক্তি হিসেবে তিনি তৈরি করে ফেলেছেন অনলাইন রেডিও প্ল্যাটফর্ম। তার এই রেডিও প্ল্যাটফর্মের নাম 'রেডিও লাউঞ্জ'।
বাংলা মৌলিক গানকে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গাতে পৌঁছে দিচ্ছেন তিনি। আট থেকে আশি সবার কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছেন তিনি। অতিমারির ভয়াবহ পরিস্থিতিতে তিনি গুগুল মিটের সাহায্যে বহু ছাত্রছাত্রীদের অনলাইনে ক্লাসও নিচ্ছেন। তার তৈরি করা রেডিও প্ল্যাটফর্মে তিনি নতুন নতুন প্রতিভা তুলে আনছেন৷
হাসিমুখে মিষ্টি কণ্ঠে তার সঞ্চালনা ও গান মুগ্ধ করে শ্রোতাদের। একজন মানুষ দৃষ্টিহীন হয়েও কীভাবে হাসিখুশীতে থাকতে পারে? কীভাবে একজন দৃষ্টিহীন মানুষ গলা ছেড়ে এতো ভালো গান করতে পারে? তার গলায় রেডিও লাউঞ্জের প্রতিটি অনুষ্ঠান শুনলে এমন প্রশ্নই যে-কোনো মানুষকে তাড়া করবে। ছোটো থেকে আজ অবধি পদে পদে লাঞ্ছনা ও অপবাদ সহ্য করতে হচ্ছে তাকে। তারপরও মনের জোরে আনন্দের সাথে গেয়ে চলছেন জীবনের জয়গান।
কসবার রুবিপার্কে ১৯৯২ সালের ৭ ই জুলাই এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম হয় সায়ন্তন ব্যানার্জির। তিনি জন্মানোর ছয়মাসের মধ্যেই শারীরিক সমস্যার সৃষ্টি হয় তার। চিকিৎসকরা জানিয়ে দেন বাচ্চাটাকে আর বাঁচানো যাবে না৷ ছেলেকে বাঁচানোর জন্য তার বাবার লড়াই শুরু হলো। স্বল্প আয় করা সত্ত্বেও তিনি ছেলেকে বেসরকারি হাসপাতালে প্রত্যহ তিন হাজার টাকা বেড ভাড়া দিয়ে ছেলের চিকিৎসা করান। তার বাবার এই লড়াই আজকে সফল। আজকের আরজে সায়ন্তন এখন পুরোপুরি সুস্থ। আরো ভালো হতো যদি তিনি দৃষ্টি ফিরে পেতেন।
সায়ন্তনের পড়ার বয়স হলে তার বাবা কলকাতার বহু নামীদামী স্কুলে তাকে ভর্তি করাতে গেলে স্কুল কর্তৃপক্ষ দৃষ্টিহীন বলে তাড়িয়ে দেয়। শেষমেশ টালিগঞ্জ লাইটহাউস ফর দ্য ব্লাইন্ড স্কুলে তাকে ভর্তি করা হয়। অল্পদিনের মধ্যেই তিনি আয়ত্ত করে ফেলেন ব্রেল পদ্ধতি। সাতবছর বয়সে ভর্তি হলেন নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন ব্লাইন্ড বয়েজ অ্যাকাডেমিতে প্রথম শ্রেণীতে। এখানে তিনি তর্ক-বিতর্ক, ক্যুইজের মতো নানান অনুষ্ঠানে অংশ নিতে থাকেন। ধীরে ধীরে তার মধ্যে সাংস্কৃতিক বিকাশ ঘটতে থাকে৷ মাধ্যমিকে ভালো নাম্বার নিয়ে তিনি সফল হন৷ আবারো তার বাবা চেষ্টা চালালেন তাকে বড়ো স্কুলে ভর্তি করার৷ কিন্তু বড়ো স্কুলগুলো সেই বারবার দৃষ্টিহীন বলে তাকে দূরে ঠেলে দেয়। যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য পাঠভবন নামের একটি বিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পান তিনি।
উচ্চমাধ্যমিকে পড়ার সুযোগ পেলেও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেবার আগের দিন পর্যন্ত তাকে বাঁধা-বিপত্তির মুখ দেখতে হয়েছে। তিনি হয়তো উচ্চমাধ্যমিক দিতে পারবেন না৷ পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি নেওয়ার জন্য তাকে বিকাশ ভবন অবধি ছুটতে হয়েছে। বিকাশ ভবনে গিয়ে প্রমাণ করতে হয়েছে যে তিনি সত্যিই দৃষ্টিহীন। বিকাশ ভবনে তাকে দৃষ্টহীনের প্রমাণ দেওয়ার পর পরীক্ষায় বসার অনুমতি দেওয়া হয়। পাঠভবনে একজন দৃষ্টিহীন ছাত্র পড়াশোনা করে সেটাও পরীক্ষার আগে স্কুল কর্তৃপক্ষের অজানা ছিল। বহু কষ্টে উচ্চমাধ্যমিক উত্তীর্ণ হলেন তিনি। এরপর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে পড়াশোনা আরম্ভ করেন। সেখানে কমিউনিটি রেডিও জেইউ-তে তাঁর রেডিও জকি হিসেবে নতুন জীবন শুরু হয়।
তার শ্রবণশক্তি এতোটাই তীক্ষ্ণ যে শুনে শুনেই সবকিছু মনে রেখে দেন। তিনি দৃষ্টিহীন হয়েও পুজো পরিক্রমার সঞ্চালনা একেবারে ঠিকঠাক ভাবে মিলিয়ে দেন। বাংলা মৌলিক গানের ধারাও বদলে দিচ্ছেন তিনি৷ সোশ্যাল মিডিয়াতেও বিভিন্ন পেজ আছে তার। সত্যি আজকালকার যুগে এমন প্রতিভা খুবই বিরল। সায়ন্তন ব্যানার্জি পথ দেখাচ্ছেন যে মনের ইচ্ছের জোর থাকলে তাকে কোনোভাবেই কোনোকিছুতে থামানো সম্ভব নয়। সায়ন্তন ব্যানার্জির সফলতার এ লড়াইটা মোটেও সহজসাধ্য নয়।
প্রতিবেদন- সুমিত দে
Post a Comment