হুগলী নামের পিছনে লুকিয়ে থাকা সম্ভাব্য রহস্যগুলি
এই জেলার নাম 'হুগলী' হল কীভাবে সেই প্রসঙ্গে বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিভিন্ন যুক্তির অবতারণা করেছেন। কিন্তু কেউই সুস্পষ্টভাবে প্রামাণ্য কোন তথ্য প্রমাণ দেখাতে পারেন নি। প্রতিটি জেলায় একে অন্যের থেকে যেমন ভূমিরূপে আলাদা; তেমনি ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকেও স্বতন্ত্র।
বর্ধমানের দক্ষিণাংশকে বিচ্ছিন্ন করে ১৭৯৫ সালে ইংরেজরা প্রশাসনিক কারণে হুগলী জেলা তৈরি করেছিল। হাওড়া তখনও হুগলী জেলার অংশ ছিল। জেলা বলতে কতগুলো থানার সমষ্টি। মহকুমার ধারণা তখনও জন্ম নেয় নি। পঞ্চদশ শতাব্দীতে হুগলীর অস্তিত্ব ছিল না; হুগলীর যাবতীয় ব্যবসা বাণিজ্য স্মরণাতীত কাল থেকে সপ্তগ্রাম অবধি একমাত্র ছিল। সপ্তগ্রামের যখনই অবনতি দেখা দিতে শুরু করল তখন পর্তুগীজ বণিকদের যত্নেই এই শহরের গোড়া পত্তন হয়; পর্তুগীজগণ এখানে প্রতিষ্ঠিত হবার পর গোলাঘাটে একটি দুর্গ নির্মাণ করে এবং এই দুর্গ থেকেই আধুনিক হুগলী শহরের উদ্ভব হয়েছে।
ভাগীরথী তীরবর্তী যে সমস্ত জায়গায় ইউরোপীয় বণিক গণ উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। তার মধ্যে এই জায়গাটি সর্বাপেক্ষা প্রাচীন। পর্তুগীজদের বাণিজ্য কুঠি এখানে সংস্থাপিত হওয়ার আগে এটি একটি নগণ্য স্থান ছিল। সামুদ্রিক বাণিজ্যের কল্যাণে হুগলীর উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে প্রাচীন বন্দর সপ্তগ্রামের পতন হয়। সেই জন্য হুগলী তৎকালে প্রাচ্যের একটি প্রধান বন্দর হয়ে ওঠে।
হুগলী নামটি পর্তুগীজদের দেওয়া নাম; মূলত ভাগীরথীর তীরে বহু হোগলা গাছ জন্মাতো এবং এই হোগলা থেকেই হুগলী নামের উৎপত্তি হয়েছে। সপ্তদশ শতাব্দীর বিভিন্ন পুস্তক ও কাগজপত্রাদি তে হুগলী - ওগোলি, ওগলি, গোলিন, হিউগলি, হাগলে, গুলি প্রভৃতি নামে আখ্যাত আছে; কিন্তু ঠিক কোন সময়ে যে হুগলীর উৎপত্তি হয়েছিল তা সঠিকভাবে নির্ণয় করা যায় না।
ফেরিয়া ডি সৌজার পর্তুগিজ ইতিহাসে (১৬৯৬ খ্রীঃ এর ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়) হুগলীর নাম গলিন বলে উল্লেখ করা হয়। ১৬২০ খ্রীঃ ডিসেম্বর মাসে পাটনা থেকে হিউজ এবং পার্কার সাহেব যে পত্র লেখেন সেখানে উল্লেখ করা আছে যে, নিম্ন বঙ্গে পর্তুগীজদের দুইটি দুর্গ আছে, একটি পিরপুল্লীতে (সম্ভবত : পিপলী), আর একটি গলির বা গলিন এই দুটো জায়গায়।ডাচ্ শাসনকর্তা ব্রাউচ ১৬৬০ খ্রীঃ হুগলীর নাম ওয়েগলী বা হোয়েগলী বলে লিখেছিলেন। ডি লেইটের ইন্ডিয়া ভেরা নামে পুস্তকে উগেলী বলে আবার উল্লেখ আছে। প্রথম থেকেই যে সমস্ত নামের উল্লেখ করেছি তার সাথে হুগলীর অনেকটা সৌসাদৃশ্য আছে। টিপু সুলতানের পাঠাগারের বিভিন্ন গ্ৰন্থেও হুগলীর উৎপত্তি বিষয় রয়েছে। কিন্তু কোন সময় স্থাপিত হয় এইরকম তথ্য নেই। তাই এই বিষয়ের মীমাংসা করা খুবই দুস্কর।
একটা সময় ছিল যখন এই অঞ্চল ছিল কৈবর্ত ও বাগদিদের আবাসস্থল। ১৯৪১ খ্রীঃ বিভিন্ন জাতিসমূহের মধ্যে কৈবর্ত ও বাগদি জাতির সংখ্যাধিক্য পরিলক্ষিত হয়।কৈবর্ত ও বাগদি জাতির হুগলী জেলায় বাস সম্বন্ধে ঐতিহাসিক হান্টার সাহেব তাদেরকে আদিতে অনার্য জাতি বলে সিদ্ধান্ত করেছেন।আবার পরবর্তীকালে তারাই হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করে হিন্দু সমাজভুক্ত হন। বকডিহি পরগণা তে এদের আদি নিবাস ছিল বলে 'বাগদি' নামকরণ হয়।
প্রাচীন কালে হুগলী জেলা যে সমৃদ্ধশালী ছিল এবং এই জেলার অধিবাসীগণ যে খুব কর্মঠ ছিল, তা টয়েনবি সাহেব ভারত সরকারের রেকর্ডে রক্ষিত একটি পত্র থেকে উদ্ধৃত করে (২০ এপ্রিল ১৮৩৮) তার পুস্তকে লিপিবদ্ধ করেন। ১৫১৭ সালে পর্তুগীজরা ব্যবসায়িক প্রয়োজনে বঙ্গদেশে প্রবেশ করে। ১৫৩৬ সালে সুলতান মাহমুদ শাহের দেওয়া সনদের বলে পর্তুগীজরা ব্যবসা শুরু করেন সপ্তগ্রামে। ১৮২৪ খ্রীঃ বিশপ হেবার ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থান পরিভ্রমণ করেন। তিনি হুগলী জেলার গঙ্গা তীরস্থ একটি গ্রামের সুন্দর চিত্র তার জার্নালে অঙ্কন করে দেখিয়েছিলেন।
১৪৯৫ সালে বিপ্রদাস পিপলাই রচিত 'মনসামঙ্গল' কাব্যে হুগলী নামের উল্লেখ দেখা যায়। এর থেকে বোঝা যায়, জেলার নামকরণ বিদেশী কৃত নয়। কারণ, এই রচনা কালের ২২ বছর পর পর্তুগীজরা বাংলায় প্রবেশ করেছিল। কিভাবে এই হুগলী নামকরণ হল, এ সম্পর্কে নানা মত থাকলেও তার মধ্যে সবথেকে প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী সপ্তগ্রাম বন্দরের যাতায়াতের পথে একটি গ্রাম্য জনপথের নদীর ধারে প্রচুর হোগলা গাছ জন্মেছিল। নদী পথে যাতায়াতের সময় পাশের গ্রামের নাম জানতে চায় কোন এক নাবিক। সাহেব নদীর তীরে হয়ে থাকা গাছের নাম জানতে চাইছেন এমন ধারণা থেকে উত্তর দেওয়া হয়েছিল 'হোগলা'। তবে এই ধরণের ঘটনা ঘটেছিল কিনা তার কোনো তথ্য প্রমাণ নেই।
১৫৯০ সালে রচিত আবুল ফজল এর 'আইন ই আকবরী' গ্ৰন্থেও হুগলী নামের স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে বা আছে। ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে পলি জমির সরস্বতী নদীর নাব্যতা নষ্ট হয়ে ভাগীরথী খাতে এই প্রবাহে পরিবর্তিত হলে পর্তুগীজরা ভাগীরথীর তীরে হুগলী বন্দর গড়ে তোলে।
১৮২৫ সালে ওলন্দাজ ও ১৬৩৮ সালে ইংরেজরা এই বন্দরে ব্যবসা শুরু করেছিল। ওলন্দাজ পরে চুঁচুড়া দখল পায় নবাবদের আনুকূল্য এবং ১৮২৫ সালে ৭ মে চুঁচুড়া ইংরেজদের দখলে আসে। চুঁচুড়ার নিকটবর্তী চন্দননগর ছিল ফরাসিদের দখলে। ১৮১৬ সালে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে ফরাসি দের হাতে ছিল। ১৯৫০ সালের ২ রা মে এই শহর ভারত সরকারের কর্তৃত্বাধীনে আসে। আর শ্রীরামপুর নগরী ছিল ১৭৫৫ থেকে ১৮৪৫ পর্যন্ত দিনেমারদের দখলে।
আবার এর সঙ্গে যোগ হয়েছে জনশ্রুতি। যেমন আমরা যদি ঐতিহাসিক তথ্য প্রমাণ ঘেটে দেখি তাহলে দেখতে পাব, সপ্তদশ শতকের বিভিন্ন গ্ৰন্থে এবং প্রথম ইংরেজ গর্ভনর উইলিয়াম হেজেস এর ডায়রি তে হুগলী বিভিন্ন নামে উল্লেখিত হয়েছে। যেমন – ও গোলি, ওগলি গোলিন, হাগলে, হিউগলি প্রভৃতি।
১৬৩২ খ্রীঃ আব্দুল হামিদ লাহরী 'হুগলী' বন্দরের উল্লেখ করে সেখানে পোর্তুগীজ প্রাধান্যের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। আবুল ফজলের 'আইন ই আকবরী' গ্ৰন্থেও সুস্পষ্টভাবে 'হুগলী' নামটি উল্লেখিত আছে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হল 'আইন ই আকবরী' রচনার পরবর্তী সময়ে রচিত পর্তুগীজ লেখক ফারিয়া সোজার বইতে হুগলী নামটির বদলে 'গোলিন', ১৬২০ সালে লেখা হিউগেস ও পার্কারের চিঠিতে 'গোললিন' এমনকি ফরাসি পর্যটক বার্নিয়ের লেখা "Travels in the mogul Empire" গ্ৰন্থেও 'ও গোলি' নামটি ব্যবহার করা হয়েছে।
হুগলী জেলার ইতিহাস প্রণেতাদের মধ্যে অন্যতম D. G. Crawford তাঁর "A BRIEF History OF THE HUGHLI DISTRICT" 'হুগলী' নামের উৎপত্তি নিয়ে থাকতে পারে।
আবার কারও কারও মতে, পর্তুগীজ বণিকেরা পণ্য মজুত করার জন্য যে সকল গুদাম বা গোলা তৈরি করেছিল তা থেকেও 'হুগলী' নামটি এসেছে থাকতে পারে।
প্রখ্যাত ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকারের মতে, পর্তুগীজদের মুখের ভাষায় যা 'ও গোলিম' বা 'ও গোলি' বাঙালি উচ্চারণে তাই 'হুগলী'। তবে অনেকেই এই মতটিকে যুক্তিগ্রাহ্য নয় বলেই মনে করেন।
১৫৮০ সাল নাগাদ আগত পর্তুগীজরা হুগলী কে চিনত– পোর্তো পেকুয়েনো। আবার ১৫৮৮ খ্রীস্টাব্দে Ralph Fitch হুগলী বানান লিখে গেছেন– Hugeli. অনেক ঐতিহাসিক একথা মনে করেন যে, প্রচলিত 'হুগলী' নাম থেকেই উচ্চারণ বিকৃত হয়ে বিদেশীদের লেখায় গোলিন বা ও গোলি এসেছিল।
পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেছেন – "Hooghly was even the settlement of Portuguese a place of some important…Voorraad who writes before the arrival of the Portuguese in India mentions it by the proper name Highly."
বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব হিসেবে ছিল : রাজা রামমোহন রায়, প্রখ্যাত বাংলা সাহিত্যিক প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, প্রখ্যাত বাংলা সাহিত্যিক শশধর দত্ত, ঊনবিংশ শতাব্দীর বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্যিক অজয় মুখোপাধ্যায়, স্বাধীনতা সংগ্রামী, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতা, পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী।।
তথ্যসূত্র –হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ : সুধীর কুমার মিত্র।।
Post a Comment