নব্বই এর দশকে দূরদর্শনে হিন্দি আধিক্যের প্রতিবাদ করেছিলেন বাঁকুড়ার শিক্ষাবিদ ক্ষুদিরাম দাস
বাংলা ভাষার স্বাধিকার রক্ষায় যারা কাজ করছেন তাদের প্রায় সকলেই বাঁকুড়ার ক্ষুদিরাম দাসকে চেনেন। তিনি নব্বইয়ের দশকে বারবার বাংলা সংস্কৃতির ওপর আক্রমণ লক্ষ্য করেছেন তাই তিনি বাংলা সংস্কৃতির আক্রমণ ও হুমকি বন্ধ করতে আন্দোলন শুরু করেন। বাংলা অনুষ্ঠান কমিয়ে দূরদর্শনে হিন্দির আধিক্য দেওয়া শুরু হলে তিনি হিন্দি আধিক্যবাদের প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন কলকাতার দূরদর্শন কেন্দ্রে।
বাংলা ভাষায় সংস্কৃতই নয় আদিবাসী ভাষার শব্দ সংখ্যাও যথেষ্ট বেশি হলেও তা অনেকে স্বীকার করতে চান না, তিনি এর প্রতিবাদ করেন এবং ১৯৯৮ সালে সাঁওতালি বাংলা সমশব্দ অভিধান প্রকাশ করেন। বাংলা সাহিত্যে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ডি-লিট অর্জন করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বাংলা ভাষায় লেখা গবেষণাপত্র তিনিই প্রকাশ করেন ১৯৬২ সালে।
১৯১৫ সালের ৯ই অক্টোবর বাঁকুড়ার বেলিয়াতোড়ে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। ১৯৩৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এম.এ. তে ৭২.৬ শতাংশ নাম্বার পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে প্রথম হন এবং নতুন নাম্বারের রেকর্ড তৈরি করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পাঁচটি স্বর্ণপদক ও স্যার আশুতোষ মুখার্জি রৌপ্য পদক লাভ করেন। ১৯৪১ সালে তিনি বি.টি. পরীক্ষায় পাশ করেন। আর্থিক সামর্থ্য না থাকায় আরো ২০ বছর পর তিনি বাংলায় ডি-লিট লাভ করেন যা ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত প্রথম বাংলায় লেখা গবেষণা পত্র। ১৯৩৯ সালে তিনি কাব্যতীর্থ ও কাব্যরত্ন পরীক্ষাতেও পাশ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রামতনু লাহিড়ী অধ্যাপক পদ তিনি লাভ করেন। ওনার আগে এই পদ লাভ করেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দীনেশচন্দ্র সেন, খগেন্দ্রনাথ মিত্র, শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো গুণী মানুষরা।
তিনি বাংলা অভিধান তৈরির জন্য ১৯৮২ থেকে ১৯৯৬ দীর্ঘ ১৪ বছর সময় দেন কিন্তু কিছু মানুষের চক্রান্তে তা এখনও প্রকাশ পায়নি। তথাকথিত নীচু জাতের লোক বলে তাঁর অভিধানকে ছাপতে দেওয়া হয়নি। বাংলা ভাষার প্রসারের জন্য চৌদ্দ বছর ধরে অভিধান লিখলেন তারপরও সেই পরিশ্রমের দাম তিনি পেলেন না। তিনি শিকার হলেন বর্ণবিদ্বেষের। সমগ্র বাঙালি জাতির কাছে যা অত্যন্ত লজ্জার বিষয়। তাঁর অভিধানকে ছাপতে না দেওয়ার ফলে বাংলা ভাষার চরম ক্ষতি হয়। বর্তমান সমাজের হাতে-কলমে শিক্ষিত নামমাত্র বাঙালিরা তো আবার এসব মানেনা। তারা বাংলা ভাষার জন্য দামী কথা বললেই তাকে প্রাদেশিক বলে গালাগাল দেয়৷ তার ফলেই তো আজকে বাঙালি শিকড় থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। শিকড়ের টান না বুঝলে সেই জাতি টেকেনা। ক্ষুদিরাম দাসের বাঙালি জাতির শিকড়ের সাথে গভীর সম্পর্ক ছিল বলেই তিনি বাংলা ভাষার একজন যোদ্ধা হিসেবে লড়াই করতে পেরেছেন৷
প্রথিতযশা এই অধ্যাপক ছিলেন বিপুল সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রীর শিক্ষাগুরু। প্রথিতযশা এই অধ্যাপক ছিলেন বিপুল সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রীর শিক্ষাগুরু। তাঁর কৃতি ছাত্রদের তালিকায় রয়েছেন অধ্যাপক শঙ্করী প্রসাদ বসু, কবি শঙ্খ ঘোষ, অধ্যাপক অরুণ কুমার বসু, অধ্যাপক শিশির কুমার দাশ, অধ্যাপক উজ্জ্বল কুমার মজুমদার ও সাংবাদিক ওয়াকিল আহমেদ প্রমুখ। তাঁর পাণ্ডিত্য, রসবোধ ও মেধাশক্তিতে মুগ্ধ হয়েছেন তাঁর সমকালীন জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিরা। জনার্দন চক্রবর্তী ও কালীপদ সেনের মতো সহকর্মী অধ্যাপকদের স্নেহধন্য ছিলেন তিনি৷ যুক্তি ও বুদ্ধি দিয়ে সবকিছু বিচার করার পক্ষপাতী ছিলেন তিনি। ছেঁদো কথা, বাঁধা ঝুলি ও লোক গুজবে তিনি বিশ্বাস করতেন না। তিনি সর্বদা মৌলিকভাবে চিন্তা করতে ভালোবাসতেন৷ তিনি তাঁর ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও মৌলিকতা তৈরি করার চেষ্টা করতেন৷ সহায়ক গ্রন্থ অপেক্ষা মূল গ্রন্থ পাঠের জন্য তিনি ছাত্রছাত্রীদের উৎসাহিত করতেন।
ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সাদামাটা মানুষ। আড়ম্বর, বিলাসিতা ও অতিরিক্ত আভিজাত্য তিনি একেবারেই পছন্দ করতেন না। আটপৌরে ধুতি ও পাঞ্জাবি এবং আনুষ্ঠানিক ভাবে খাদির জহরকোট ছিল তাঁর পরিধেয় পোশাক। তিনি নিজের পরিবারের স্বাচ্ছন্দবোধকে ঘৃণা করতেন। উৎসবের মরসুমে তিনি জামাকাপড় দোকানে কেনাকাটা করতে যেতেন ঠিকই তবে সেই পোশাক তিনি বাড়ির লোকের জন্য নয়, দরীদ্র-অসহায়দের জন্য কিনে আনতেন৷ তিনি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় ঘোর বিশ্বাসী ছিলেন। ছুটির দিনে তাঁর বাড়িতে লোকেদের লম্বা লাইন পড়ে যেত। লোকেরা বিনে পয়সায় তাঁর কাছ থেকে হোমিওপ্যাথি ঔষধ ও পথ্য পেত।
সেকেলের তথাকথিত এলিট সম্প্রদায়ের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিলেন তিনি৷ শহুরে এলিট প্রথার তিনি ঘোর বিরোধী ছিলেন। প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার মুক্তমনা পথিক হিসেবে বাংলা ভাষার জন্য আজীবন লড়াই করে গেছেন।হিন্দি সাম্রাজ্যবাদ বাংলা ভাষার কতটা ক্ষতি করতে পারে তার একটা আভাস তিনি পেয়েছিলেন। জোরপূর্বক হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটতেও দেখেছেন নিজের চোখে৷ বুক ঠুকে তাঁর প্রতিবাদও করেছেন তিনি৷ মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের পক্ষপাতী ছিলেন তিনি। মাতৃভাষা শিক্ষাদানের অন্যতম হোতা হিসেবেও উঠে আসে তাঁর নাম৷
কৃষ্ণনগরের পৌরসভার শিক্ষা সমিতির তিনি সভাপতি হয়েছিলেন। তিনি বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর হামলা হওয়ার আশঙ্কার ভয় পেতেন৷ বাংলা ভাষার সম্মান রক্ষার জন্য তাঁর সভাপতিত্বে ১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় 'বঙ্গ-ভাষা প্রসার সমিতি'। বাংলা ভাষা সাহিত্য, বাংলার সুস্থ ও বৃহৎ সংস্কৃতির হৃতগৌরব ফিরিয়ে আনা ছিল এই সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য। বাংলার বুকে সমস্ত অফিস, আদালত, ব্যাঙ্ক, পোস্ট অফিস, বিদ্যালয়, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় সর্বত্র বাংলা ভাষায় কাজকর্ম চালু করতে বৃহত্তর আন্দোলনে সামিল হন তিনি৷
একবার তিনি বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে মেট্রোসিনেমার সামনে এক জনসভাতে বাংলা ভাষার স্বাধিকারের পক্ষে বক্তব্য রাখেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে একুশে ফেব্রুয়ারির স্মরণে অনুষ্ঠিত পদযাত্রাতে তিনি পা মিলিয়েছিলেন৷ দূরদর্শনে যেভাবে নোংরা ভাবে বাংলার বুকে বাংলা ভাষার অনুষ্ঠান কমিয়ে হিন্দি অনুষ্ঠান বৃদ্ধি করা হয়, সেই হিন্দি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান তিনি৷ কলকাতা দূরদর্শন কেন্দ্রের অধিকর্তার কাছে গিয়ে তিনি প্রতিবাদ করেছিলেন।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, ভাষাতত্ত্ববিদ ও সমালোচক ক্ষুদিরাম দাস বাংলা ভাষার জন্য নিঃস্বার্থ ভাবে লড়াই করলেন অথচ বাংলার অধিকাংশ যুবক-যুবতীরা তাঁকে চেনেন না। বাঙালি ভুলে গেছে বাংলা ভাষার জন্য তাঁর লড়াইকে। বাঙালি তাঁকে মনে না রাখলেও তাঁর আদর্শ বর্তমান বাংলার আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে৷ বর্তমান বাংলাতে শিকড়ের মতো গজিয়ে উঠছে বিভিন্ন বাঙালি সংগঠন৷ হয়তো তাদের হাত ধরেই ক্ষুদিরাম দাসের পুনর্জন্ম হবে।
Post a Comment