এক পরিযায়ী শ্রমিক মাকে যিনি দুর্গারূপে দেখিয়েছেন, থিমমেকার রিন্টু দাসের সাক্ষাৎকার
বেহালা বড়িশা ক্লাবের এ বছরের পুজোর থিম হলো "মারির দেশে ত্রাণের বেশে, অন্নপূর্ণার ভেলায় ভেসে।" এই অভিনব থিমের ভাবনা ও পরিকল্পনা যার মস্তিষ্কপ্রসূত সেই বিখ্যাত থিমমেকার রিন্টু দাস ধরা দিলেন লিটারেসি প্যারাডাইসের এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকারে।
লিটারেসি প্যারাডাইস- বেহালা বড়িশা ক্লাবের এমন প্রতিমার অভিনব ভাবনাটি আপনার কীভাবে এসেছে?
রিন্টু দাস- আসলে এ বছরের আমার থিমের নাম "মারির দেশে ত্রাণের বেশে, অন্নপূর্ণার ভেলায় ভেসে।" এই কনসেপ্টটা নিয়ে আমি কাজ করছি। এই কনসেপ্টটা যখনই আমার মাথায় আসে। বিগত ছ'মাস যাবৎ যখন আমি লকডাউনে ঘরবন্দী তখন টিভির পর্দা খুললেই দেখতে পাচ্ছি মৃত্যুমিছিল। এতো মানুষ এফেক্টেড৷ এতো মানুষ রাতের পর রাত, দিনের পর দিন হাঁটছে। একটু খাবার পাচ্ছে না, একটু জল পাচ্ছে না। মায়েরা সব হাঁটছে, মেয়েরা সব হাঁটছে৷ তখনই আমার মনে হয়েছিল আমি যদি এ বছর পুজো করি তাহলে মানুষের জন্যই পুজো করবো। ঐ মায়েদেরই পুজো করবো যেই মা তার চার ছেলেমেয়েকে নিয়ে রাতের পর রাত হাঁটছে সেই আমার কাছে মা দুর্গা। ওটা নিয়েই আমি কাজ করবো৷ এইভাবে প্ল্যান করি, যেহেতু আমরা পুজো যখন করি একবছর আগে থেকেই আমাদের এগ্রিমেন্ট হয়ে যায়। ২০১৯ সালে এগ্রিমেন্ট হয়ে গিয়েছিল কিন্তু তখন আমাদের বাজেট অনেকটাই ছিল। যখন এই করোনা পরিস্থিতিতে ক্লাব কর্তৃপক্ষকে আমি ফোন করি তখন ওনারা বললেন "দেখুন রিন্টুবাবু এ বছর আমরা পুজো করতে পারবো না৷ কোনো অ্যাড, পয়সা নেই, কী করে করবো? কী করে সম্ভব?" আমি তখন ওনাদের বললাম "দেখুন আমি দুর্গাপুজোর ফিল্ডে কাজ করে আমার নাম-যশ-অর্থ সবই এখান থেকেই পেয়েছি৷ মা দুর্গা আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। এ বছর আমার মাকে কিছু দেওয়ার আছে। আপনারা যা বাজেট পারবেন সেটাই করুন, আমি সেটা দিয়েই পুজোটা করবো। তারা বললো "আমরা বাজেটের পাঁচ ভাগের এক ভাগ বাজেট দিতে পারবো তাও চেষ্টা করবো।" আমি শুনে বলি তাই দিয়েই করবো। আমি আরো বললাম "আর কী কী দিতে পারবেন?" আমাদের কাউন্সিলার সুদীপ বললেন "আমি ক্লাব থেকে ৩০,০০০ কেজি চাল বিতরণ করেছি। তার অজস্র চটের বস্তাগুলো আছে৷" আমি বললাম ঠিক আছে ঐগুলো আমাকে দিন, ওটা দিয়েই আমি প্যান্ডেল বানাবো৷ আর কোনো মেটেরিয়াল আমি প্যান্ডেলে ব্যবহার করবো না।" তো তিনি বললেন "আপনি যা পারবেন সেটাই করুন, ওটা আপনার ব্যাপার।" আমার এ বছরের মোটোই ছিল মিনিমাম বাজেট ম্যাক্সিমাম ভাবনা। আমি একজন শিল্পী হিসেবে এতোদিন বিগ-শর্ট বাজেটে অনেক কাজ করেছি। এই ছোটো বাজেটে কী করে কাজ নামাতে হয় সেটা আমাদের কাছে চ্যালেঞ্জ ছিল৷ এ বছর আমার প্রমাণ করবার সময় এসেছে সেটা আমি মনে করেছিলাম৷ তাই এই কনসেপ্টটা নিয়েই আমি কাজ করি৷ এখানে দেখবেন যে কম্পোজিশনটা নিয়ে আমি কাজ করেছিলাম যে মা দুর্গা তার পুরো পরিবার নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে ও পিছন দিকে ঘুরে তাকাচ্ছে। এই প্যান্ডেলটাতে কোথাও আমি রঙ ব্যবহার করিনি৷ যার যার নিজস্ব রঙই আমি রেখেছি৷ চটের মধ্যে যে একটা শৈল্পিক মান ও গুণ আছে সেটাকে আমি খুঁজে বের করবার চেষ্টা করেছি। ঠাকুরটাকেও দেখবেন মা দুর্গাকে কিন্তু আমি কোনো রঙ করিনি। এখন অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন কেন রঙ করিনি? আমার মনে হয়েছে এই কষ্টের মধ্যে মা দিন কাটাচ্ছে, খাবার পাচ্ছে না, ছেলেমেয়ের মুখে অন্ন তুলে দিতে পারছে না। সেই জায়গা থেকে মায়ের রঙ বা মায়ের জৌলুসটা আসবে কোথা থেকে? তাই মায়ের গায়ে কোনো রঙ করিনি৷ অথচ নীচে যে গনেশটা আছে তাকে আমি কিন্তু কালারফুল করেছি৷ ও তো তখন খুব ছোটো ও কিচ্ছু বোঝে না। কী মহামারী, কী চলছে ও কিছুই বোঝে না, ও আনন্দেই রয়েছে, ও ঐ শিশু হিসেবে খেলা করছে। এবার আমি যে কম্পোজিশনটা করেছি আপনি দেখবেন মা দুর্গাকে আমি একটা সূর্যের মাঝখানে রেখেছি৷ সূর্য হচ্ছে একটা শক্তি। মা দুর্গা একটা শক্তি। আমার যে মা দুর্গা, সেই মা দুর্গা রাতদিন খেটেছে, একটু খাবার পায়নি তবুও তার মধ্যে একটা শক্তি আছে সে যদি সুযোগ পায় তাও পেয়ে যেতে পারে। আমি এভাবেই দেখিয়েছি। মা দুর্গার পিছনে দশটা হাত, গোল একটা চাকতির মধ্যে মা দুর্গা রয়েছে। সে বামদিক ডানদিক তাকাচ্ছে। মা দুর্গা আমাদের অন্তর্যামী, সবাইকে মা দেখছেন। আপনি ঢুকতে না ঢুকতেই দেখবেন একটা ত্রাণের সিকোয়েন্স থাকবে। মানে ভয়েসওভার রয়েছে। ত্রাণের সময় সবাই লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। ভলেন্টিয়ার্সরা বলছে সোশ্যাল ডিসটেন্সিং মেনটেইন করে দাঁড়ান। নাহলে ত্রাণ দেবো না বা মাস্ক না পরলে ত্রাণ দেবো না। এই ঘটনার মাঝেই আমার দুর্গা আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছে ত্রাণ নিতে। তখন এক ভলেন্টিয়ার্স বলে উঠছে "এই এই তুমি কোথায় যাচ্ছো?" তখন সে ঘুরে বলছে "কেন মায়ের কাছে যাচ্ছি ত্রাণ নিতে।" সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্মী সরস্বতী বলছে "মায়ের কাছে যাচ্ছি ত্রাণ নিতে।" তখন ভলেন্টিয়ার্সরা চিনতে পারবে মাকে৷ তারপর ভলান্টিয়ার্সরা বলছে "মা তুমি৷ জয় মা দুর্গা, জয় মা দুর্গা।" এরকমই একটি ফিল তৈরি করা হয়েছে। এটা আমার কাছে একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। সত্যি কথা বলতে এই কাজটা করে আমি আনন্দ পাচ্ছি৷ কেননা দীর্ঘ লকডাউনের মধ্যে আমার টিমে যে সাড়ে তিনশো থেকে চারশো ছেলে কাজ করে তারা মাঝে মাঝেই ফোন করে বলছিল "দাদা আর পারছি না, দাদা আর পারছি না। আমাদের টাকা দিতে হবে না, তুমি আমাদের কাজ দাও কাজ দাও।"
লিটারেসি প্যারাডাইস- এ বছর কলকাতার কতগুলো ক্লাবের প্রতিমার দায়িত্বে আছেন আপনি?
রিন্টু দাস- আমি এবছর প্রধানত চারটি কাজ করছি। একটা বড়িশা ক্লাব, একটা হিন্দুস্তান পার্ক আর একটা বাঘাযতীন তরুণ সংঘ আর একটা কাজ করছি পুরুলিয়ার ভামুড়িয়াতে। এই চারটে প্যান্ডেলের পুরো দায়িত্বে আমি। আমার কনসেপ্ট, আমার ডিজাইনে পুরো তিনটে কাজ হয়। একটা পুজো করতে গেলে ডেকোরেটার একটা আছে, লাইট অ্যাঙ্গেল আছে, সাউণ্ড অ্যাঙ্গেল আছে সবাই আমার ডিরেকশন অনুযায়ী পুরো কাজটা করে। এই যে ঠাকুরটা করিয়েছি পল্লব ভৌমিককে দিয়ে ও আমার কলেজেরই একজন জুনিয়র। আমার ড্রয়িং অনুযায়ী ও পুরো কাজটা করেছে৷ ওর কাজটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। এই দুর্গাকে আমি তিন ভাবে বানিয়েছি। একবার শাড়ীটা পছন্দ হয়নি, শাড়ীটা ভালো লাগছিল না বলে ভেঙ্গে দিয়েছি৷ আমি মায়ের মুখের সেই আদলটা পাচ্ছিলাম না বলে আমি মাথাটা তিনবার ভেঙ্গে আদলটা বানিয়েছি।
লিটারেসি প্যারাডাইস- আপনি কতদিন ধরে এই পেশার সঙ্গে যুক্ত আছেন?
রিন্টু দাস- আমি গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ থেকে ১৯৯৯ সালে ওয়েস্টার্ন পেইন্টিং নিয়ে পাস আউট। তারপরে আমি দিল্লিতে ২৬ শে জানুয়ারির জন্য ট্যাবলোর যে ডিজাইনগুলো হয় সেই ফুল ডিজাইনগুলো আমি করতাম৷ তারপর গভর্নমেন্টের যে মিউজিয়ামগুলো আছে সেই মিউজিয়ামের কাজগুলো আমি করতাম। সিকিমের থাঙ্কা পিলার ওয়াল পেইন্টিং ও আসাম-পাটগাঁও পেইন্টিং এই ধরণের কাজগুলো করতাম। গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজের আমারই এক বন্ধু পল্লব দাস সে বললো "পুজোর কাজ করনা, পুজোতে তো এতো সুন্দর কাজ হচ্ছে।" ২০১৩ সাল থেকে আমি পুজোর কাজ করা শুরু করি। তখন থেকেই আমি আমার জীবনের সাফল্য পাই। তখন আমি একটা কনসেপ্ট নিয়ে ছোটো বাচ্চাদের নিয়ে কাজ করেছিলাম। ছোটো বাচ্চাদের মায়েরা কীভাবে মেন্টাল প্রেসার দেয় যে ডাক্তার হতে হবে, ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে। এই কনসেপ্ট নিয়ে কাজ করে আমি খুব সাফল্য পাই। তারপর থেকে ধারাবাহিক ভাবে সাফল্য পেয়েছি। আমি একটা গনশা করেছিলাম একটি ছোট্ট বাচ্চার চরিত্র নিয়ে৷ একটা বাচ্চা আমাদের পাড়াতে থাকে। বাচ্চাটির একটি চায়ের দোকান আছে। সে চায়ের দোকানে কাজ করে৷ তার বাবা-মা নেই। সেই বাচ্চা ছেলে গনশার চরিত্রটি নিয়ে কাজ করেছিলাম দমদম পার্ক তরুণ সংঘে। খুব সাড়া পড়ে গিয়েছিল এই কাজটিতে। ২০১৭ সালে নলিন সরকার স্ট্রিটে মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের নিয়ে একটা কাজ করেছিলাম। তার কনসেপ্ট ছিল 'মা তুমি কার?' মা কী শুধু তুমি ওদেরই মা, আমার মা নও। অনেকে আমাকে প্রশ্নও করেন "রিন্টুবাবু আপনার তৈরি প্যান্ডেলে ঢুকলে কেন চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে যায়?" তখন আমি বলেওছিলাম যে দেখুন পুজোটা আপনার ও আমার নয়, পুজোটা সবার। যে ছেলেমেয়েটা ঘরে বসে পুজোটা দেখতে পাচ্ছে না তারও তো এটা পুজো। যে দুর্গা রাস্তায় বেলুন বিক্রি করে তার চার ছেলেমেয়েদের জামাকাপড় কিনে দিয়ে যদি পুজোতে সামিল হতে পারে তাহলেই পুজোটি সফল বলে মনে করি। আমি তাদের কথাই তুলে ধরার চেষ্টা করি৷ আমি একবার মাতৃঋণ নিয়ে কাজ করেছিলাম ২০১৮ তে বড়িশা ক্লাবেই। সেখানে আমি তুলে ধরেছিলাম মায়েদের শেষ বয়সটাতে কী অসুবিধা হয়। তাদের ছেলেমেয়েরা কেরিয়ারের জন্য দেশের বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মা যখন শেষ বয়সে ছেলেকে চায় 'বাবু তুই বাড়িতে কবে আসবি। তোর বাবার ওষুধটা তো শেষ হয়ে গেছে৷' সে তার কেরিয়ার নিয়েই ব্যস্ত। সেই কনসেপ্টটা যখন করেছিলাম আমি জীবনের সেরা পুরস্কারটা পেয়েছি এক ভদ্র মহিলা বেরিয়ে এসে বলছিল 'এটার আর্টিস্ট কে?' তখন বললাম 'আমি।' সে তখন কাঁদতে কাঁদতে বলছে "দাদা আপনি আমার চোখ খুলে দিলেন। আমি আমার মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এসেছি। আমি কালকেই আমার মাকে নিয়ে আসবো। আমি খুব অন্যায় করেছি।" তখন মনে হলো আমরা শিল্পী হিসেবে সমাজের প্রতি তো আমাদের দায়িত্ব আছে কোনটা ভালো কোনটা খারাপ সেটা তুলে ধরার। আমার তখন মনে হলো একজন লোককে আমি শিক্ষা দিতে পেরেছি এটাই আমার জীবনের সাফল্য, এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো পাওনা৷ আমি এই রকম কনসেপ্ট নিয়েই কাজ করি৷ আমি দমদম পার্ক তরুণ সংঘেই আরবানাইজেশন নিয়ে কাজ করেছিলাম। শহরে যেভাবে ব্যাঙের ছাতার মতো ফ্ল্যাটগুলো হচ্ছে তাতে পৃথিবী একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে। মাস্ক নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হবে। ছেলে হয়তো বাবাকে বলবে "বাবা তুমি ফেরার সময় আমাকে একটা অক্সিজেন টপাব ভরে দাও আমি দম নিতে পারছি না।" এইদিনও আসবে একদিন। যেভাবে গাছ কেটে কেটে পুকুর ভরাট হচ্ছে। সেটার ওপরও কাজ করেছিলাম আমি। বহু সংবাদপত্রে এটা নিয়ে লেখালেখি হয়েছিল। আমি ফাইভ জির ওপর কাজ করেছিলাম৷ নেদারল্যান্ডে ফাইভ জি আসার জন্য কত পাখি মারা গিয়েছিল। ২০২০ তে ফাইভ জি টেস্টিং হওয়ার কথা ছিল তার ওপরও কাজ করেছি। এটা নিয়েও দেখেছি বহু পত্র-পত্রিকায় খুব লেখালেখি হয়েছিল। আমি তো এই ধরণের কাজ করতেই বেশি পছন্দ করি। আমি গত বছর আরেকটা যেমন কাজ করেছিলাম সেটা নিয়ে বেশ ঝামেলাতেও পড়ি। সেটার কনসেপ্ট ছিল 'আমরা এক, একা নয়।' আমি তিনটে ধর্ম নিয়ে একসাথে কাজ করেছিলাম। উৎসবটা শুধু হিন্দু বাঙালিদের নয়, উৎসবটা সবার। হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান সব ধর্মের। সেই কাজটা করাতে আমার ভীষণ সমস্যা হয়েছিল। দিল্লি মিডিয়া বিতর্ক করেছিল, এখানেও কাজটা প্রায় বন্ধের মুখে চলে এসেছিল। বিশাল পুলিশ ফোর্স নিয়ে এসে আমাদের থ্রেট দিয়েছিল 'মন্দিরে কেন আজান বাজবে?' আমি তিনটে ধর্মকেই রেখেছিলাম। আমি একটা ঢালাই মেশিন রেখেছিলাম। ঢালাই মেশিনে সিমেন্ট, বালি মাখিয়েই তো একটা ঘর তৈরি হয়। ঐ ঢালাই মেশিনের ভেতরেই আমি মন্দির, মসজিদ ও গীর্জা রেখে দিয়েছিলাম। ওটা যখন ঘুরছে তাতে ইলিউশন হয়ে ব্রাহ্মণ চলে আসছে সে মন্ত্র পড়ছে, আবার ইলিউশন হয়ে খ্রীস্টান চলে আসছে ও শেষে আবার ইলিউশন হয়ে একজন মুসলিম চলে আসছে সে আজান পড়ছে। এই ঢালাই মেশিনের মধ্যে লাইন দিয়ে নেমে আসছে মন্দির, মসজিদ ও গীর্জা। মন্দিরে কেন আজান বাজবে সেটা নিয়ে বহু তোলপাড় হয়ে গিয়েছিল। আমার বক্তব্য ছিল পুজোটা সবার। ঐ ঢালাই মেশিনের মাধ্যমে মন্দিরও হচ্ছে, মসজিদও হচ্ছে এবং গীর্জাও হচ্ছে। আমি তো এই ধরণের কাজ করি। আমার এই যে এতো বড়ো একটা প্ল্যাটফর্ম। আমার মনে হয় আমার শিল্পী হিসেবে একটা গুরু দায়িত্ব আছে। আমার যেটা খারাপ লাগে, যেটা ভালো লাগে সেটাই তুলে ধরার চেষ্টা করি। এই হচ্ছে আমার কাজ।
লিটারেসি প্যারাডাইস- আপনার আর্টশিল্পের প্রতি প্রবল আগ্রহ কীভাবে তৈরি হয়?
রিন্টু দাস- আমি যখন ক্লাস ফোরে পড়ি। থ্রি কী ফোর হবে। তখন আমার দাদার ওদের ক্লাসের একটি ছেলে ওর খাতার মধ্যে তিতুমীরের বাঁশের কেল্লার ছবি এঁকেছে। ও সেটা এনে মাকে দেখায়। বলে "মা দেখো আমাদের ক্লাসের একটা ছেলে কী সুন্দর ছবিটা এঁকেছে দেখো। তখন মা ছবিটি দেখে এতো প্রশংসা করলো যে আমার মনে হচ্ছে কোথাও একটা হিংসে হচ্ছে। আমি হয়তো ছবিটি তখন নিতে পারিনি। আমি ঐ ছবিটি নিয়ে বসে গোটা দুপুর ড্রয়িং করেছি। করার পর আমিও যখন মাকে ছবিটি দেখায় 'মা দেখো এই ছবিটা আমি এঁকেছি।' মা ছবিটি দেখে বলে "বাঃ। তুই তো খুব ভালো ছবি আঁকিস।" ঠিক এই দিনটি থেকেই আমার ছবি আঁকার শুরু। তারপর একটু বড়ো হয়ে ঠাকুর গড়তাম৷ পুকুর থেকে মাটি নিয়ে আসতাম। যে পুকুরে ঠাকুর ভাসানো হতো সেখান থেকে ঠাকুরের কাপড়, ঠাকুরের চুল নিয়ে আসতাম। সেগুলো সারাবছর বাড়িতে জমিয়ে রেখে ছোটো ছোটো ঠাকুর বানিয়ে বাড়িতে পুজো করতাম। সেই আমার জীবনের শুরু। তারপর আর্ট কলেজ। তারপর আর্ট কলেজ থেকে বেরিয়ে আমার কাজ। তারপর আস্তে আস্তে এই জায়গাটা আমি পেলাম।
লিটারেসি প্যারাডাইস- এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের শিল্পের প্রতি খিদে ঠিক কতটা আছে বলে আপনার মনে হয়?
রিন্টু দাস- আমি একটা কথা আমার ছাত্রদেরই বলি "তোমরা না লক্ষ্মীর পিছনে ছোটো না, মা সরস্বতীর পিছনে ছোটো।" আমি আমার অভিজ্ঞতা দিয়েই বলছি তোমরা যদি লক্ষ্মীর পিছনে ছোটো তাহলে বিদ্যার দেবী পালিয়ে যাবে। তুমি যদি সরস্বতীকে ভালোবাসো তাহলে লক্ষ্মী পায়ে হেঁটে তোমার বাড়িতে পৌঁছে যাবে। আমি আমার অভিজ্ঞতা দিয়েই বলছি আমি যখন কাজে একের পর এক সাফল্য পেয়েছি তখন আমার বাড়িতে লোকজন এসে দাঁড়িয়ে আছে এক বছর আগের থেকেই একটা থিমের পুজো করার জন্য। তাই আমি আমার ছাত্রদের বলি যে কাজটা ভালোবেসে করো, মন দিয়ে করো৷ অভ্যাস করো, চর্চা করো। ফলের আশা করো না। তুমি শুধু কাজটা করে যাও৷ যে কাজটা তুমি করবে চোখের সামনে সেটা দেখার চেষ্টা করবে। একটা পেইন্টিং করতে গেলে চোখের সামনে দেখতে হবে, সেটাকে ভালো করে জানতে হবে। যদি তুমি চোখের সামনে ছবিটা ভালো করে দেখতে পারো তাহলেই তুমি ভালো ছবি আঁকতে পারবে৷ নাহলে তুমি ঘেঁটে ঘ হয়ে যাবে।
লিটারেসি প্যারাডাইস- সোশ্যাল মিডিয়াতে লক্ষ লক্ষ মানুষের মন ছুঁয়ে গেছে এই দুর্গা প্রতিমার ছবি দেখে। অনেকে আবার এই ছবিটি নিয়ে বাজে ভাবে বিতর্কও বাঁধাচ্ছে। যারা এই প্রতিমাটি নিয়ে বিতর্ক তৈরি করছেন তাদের আপনি কী বলতে চান?
রিন্টু দাস- না প্রধানত আমি একটা কথাই বলি অনেকে বলছেন এটা বিকাশ ভট্টাচার্যের কাজের কপি বা অন্য কিছু। বিকাশ ভট্টাচার্য আমার গুরু। তাকে আমি শ্রদ্ধা করি। ওনার কাজের আমি বড়ো ভক্ত। ওনার কাজের প্রতি আমার এই ইনফ্লুয়েন্স পড়ে। আর ইনফ্লুয়েন্স পড়াটা আমার মনে হয়না কোনো অন্যায়। বিকাশ ভট্টাচার্যও যামিনী রায়ের দুর্গার ইনফ্লুয়েন্স থেকে দুর্গার প্রতিমাটা তৈরি করেছিলেন। আমি কাজটা আমার মতো করে করি। দুর্গার কোলে একটা বাচ্চা থাকলেই কী বিকাশ ভট্টাচার্যের সেই দুর্গার কপি হয়ে গেল? এরকম মন্তব্য করা তো ঠিক নয়। আমি যখন মাতৃঋণটা করি পাশের বাড়ির এক ভদ্রমহিলাকে দেখে কাজটা করেছিলাম। আমরা শিল্পী, শিল্পের জন্য সবসময় চোখ কান খোলা রাখতে হয়। আমি যেটা দেখি সেটা নিয়েই কাজ করার চেষ্টা করি। এটা কোথায় অন্যায়? আমি তো অন্যায় দেখতে পাইনা। জানিনা লোকে কেন বাজে মন্তব্য করে এতো লাফালাফি করছে। আপনি দেখুন না যামিনী রায়ের ছবিগুলো কীভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। কতরকম কালার টিন্ট ব্যবহার করা হচ্ছে। কই তার বেলা তো কাউকে একটা উচ্চবাক্য উচ্চারণ করতে দেখছি না। বিকাশবাবু এক প্রেক্ষিতে কাজ করেছেন আর আমি আরেক প্রেক্ষিতে কাজ করছি। আমার কম্পোজিশন, রঙ, স্টাইল, ঢং সবই তো আলাদা৷ ওটা টুডি আর এটা থ্রিডি। আমি আবারো বলছি আমি আমার গুরুর ইনফ্লুয়েন্স হয়েছি। এটা একেবারেই কোনো অন্যায় নয়। সচিনের খেলা দেখে ইনফ্লুয়েন্স হয়ে সেওয়াগ উঠে এসেছে। কিশোর কুমারের গান শুনে ইনফ্লুয়েন্স হয়ে কুমার শানু উঠে এসেছে। এটাই কিন্তু স্বাভাবিক। ওভাবেই পৃথিবী এগোতে থাকে। আমার জানি না কেন মনে হচ্ছে লকডাউনে অনেকে বাড়িতে বসে আছে কিছু একটা নিয়ে মাতামাতি করতে হবে, তাই এটা অনেকে করছে বলে আমার ধারণা। তারা মানুষকে কোনো কাজ করতে দেবে না। আমি জানিনা ঠিক বলছি নাকি ভুল বলছি। যদি ভুল বলে থাকি আপনারা আমাকে ক্ষমা করে দেবেন।
প্রতিবেদন- সুমিত দে
Post a Comment