ভারতের প্রথম কীট-পতঙ্গের বিজ্ঞানী গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য || অন্তিম পর্ব
আমরা গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যের লেখনীর সাথে পরিচয়লাভ করি বিখ্যাত 'প্রবাসী' পত্রিকায় তাঁর প্রকাশিত প্রবন্ধগুলির মাধ্যমে। তাঁর প্রথম প্রকাশিত প্রবন্ধ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে 'পচা গাছপালার আশ্চর্য আলো বিকিরণ ক্ষমতা' নামক প্রবন্ধটি, যা প্রকাশিত হয়েছিল ১৩২৬ বঙ্গাব্দের পৌষ সংখ্যায়। এই লেখাটি লোনসিং থেকে প্রেরিত বলে জানা যায়। তবুও দেখা যায় যে, এই প্রকাশকালের ঠিক এক বছর আগে অর্থাৎ প্রবাসীর ১৩২৫ বঙ্গাব্দের পৌষ সংখ্যায় গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যের লেখা একটি ক্ষুদ্র আলোচনা প্রকাশিত হয়েছিল। এই ক্ষুদ্র আলোচনাটি গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য পাঠিয়েছিলেন ১৩২৫ বঙ্গাব্দের 'প্রবাসী'-র অগ্রহায়ণ সংখ্যায় রাখালরাজ রায় নামক এক লেখকের রচনার জবাবে।
গোপালচন্দ্রের লেখা আলোচনাটির শিরোনাম ছিল 'রাঁড়া পেঁপে গাছের ফল'। সেই পত্রিকার ২৩৬-২৩৭ পাতায় গোপালচন্দ্রের লেখাটির কিছুটা অংশ এখানে উদ্ধৃত করলামঃ–
"গত অগ্রহায়ণ সংখ্যার প্রবাসীতে শ্রীযুক্ত রাখালরাজ রায়, মহাশয়, রাঁড়া পেঁপে গাছের ফল সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ আলােচনা করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন—"ছাপড়াতে অবস্থানকালে তিনি কি রাঁড়া পেঁপে গাছেরই ফল হইতে দেখিলেন, না সেটা প্রকৃতির খেয়াল?" কিন্তু সেটা প্রকৃতির খেয়াল নহে; প্রকৃতির নিয়মে তা ব্যতিক্রম দেখা যায় না– রাখাল-বাবুরই চোখের ভুল। আমি বহুদিন যাবৎ গাছ ও তাহার ফল-ফুল লইয়া নানা প্রকার পরীক্ষা করিয়া দেখিতেছি। এরূপ পেঁপে গাছে এক বোঁটায় ৫/৭টি করিয়া ফল ধরে তাহা নতুন নহে। পুং-পুষ্প এক বোঁটা হইতে অনেকগুলি বাহির হয় এবং সে ফুলে ফল হয় না, সেটা সত্য, কিন্তু স্ত্রীপুষ্প ও অনেক সময় পুং-পুষ্পের ন্যায় ছড়ার আকারে একবোঁটায় অনেকগুলি করিয়া ফোটে, রাখালবাবু আশুবাবুর বাগানে যে গাছ দেখিয়াছিলেন উহা নিশ্চয়ই পুং পুষ্পের গাছ, কাজেই সেটিতে ফল ধরে নাই। তিনি একটু অনুসন্ধান করিলেই ইহা দেখিতে পাইতেন। অনেক স্থানেই এরূপ গাছ হয়।"
গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যের এমনভাবে পরীক্ষালব্ধ করে কোনো কিছু সাধারণ পাঠকের সামনে উপস্থাপনা আমরা বহুবার পেয়েছি। স্কুলের শিক্ষকতার পাশাপাশি বাগানের গাছ-গাছড়া নিয়েও প্রচুর বলা যায় বিভিন্ন রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন। লোনসিং স্কুলের ছাত্রদের নিয়ে যে ফুল ও ফলের বাগান করেছিলেন এবং সেই বাগানে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন, সে সম্পর্কে তিনি লিখেছেনঃ–
"গাছপালা সম্বন্ধে সাধ্যমত পরীক্ষাদি করতাম। কৃত্রিম উপায়ে পরাগ সঙ্গম ঘটিয়ে উদ্ভিদ তৈরির চেষ্টা, কলমের সাহায্যে একই গাছে দু-তিন রকমের ফুল উৎপাদন করা ইত্যাদি ছিল পরীক্ষার বিষয়।"
গোপালচন্দ্রের ছেলেবেলা থেকেই যে বিজ্ঞানচর্চার ও লেখালেখির অভ্যাস ছিল সে সম্পর্কে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ছোটভাই পঙ্কজবিহারী ভট্টাচার্য লিখেছেন যা প্রকাশিত হয়েছিল জ্ঞান ও বিজ্ঞান পত্রিকার ১৯৮১ সালের নভেম্বর সংখ্যায়। সেখানে লেখা রয়েছেঃ–
"ছােটবেলা থেকেই গােপালচন্দ্রের প্রবল অনুসন্ধিৎসা ছিল। স্কুলে শিক্ষকতা করার সময় তিনি বনে-বাদাড়ে, ঝােপে-ঝাড়ে, পরিত্যক্ত ভিটেয় তিনি একলা ঘুরে বেড়াতেন; প্রকৃতির লীলারহস্য, কীটপতঙ্গের গতিবিধি, আহারবিহার, ক্রীড়াকৌতুক নিবিষ্টমনে নিরীক্ষণ করে লিপিবদ্ধ করে রাখতেন এবং বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশের জন্য পাঠাতেন।"
যাইহোক, ১৩২৫ বঙ্গাব্দের 'প্রবাসী' পত্রিকার মাঘ সংখ্যা গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য লিখিত আরও দুটি আলোচনা দেখতে পাই। যাদের শিরোনাম হল 'জন্তুদের গায়ের রং' ও 'গলাইয়া শব্দ কোথা থেকে আসিল?'
আগে উল্লেখিত ১৩২৬ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত প্রবন্ধের পর ১৩২৭ বঙ্গাব্দে শ্রাবণ সংখ্যায় তাঁর আরেকটি প্রবন্ধ 'ব্যাঙের ছাতার আলো’ প্রকাশিত হয়েছিল।
গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যের রচনার সংখ্যা প্রায় আটশো বা তারও বেশি কেননা অনেকেই বলেন যে তখনকার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ছাড়াও এই জ্ঞান ও বিজ্ঞান পত্রিকাতেই তাঁর প্রকাশিত প্রবন্ধ-নিবন্ধের সংখ্যা অত্যন্ত আটশো। যেসব পত্রিকাতে তাঁর প্রচুর লেখা প্রকাশিত হয়েছিল সেগুলি হল– 'প্রকৃতি', 'প্রবাসী', 'সন্দেশ', 'জ্ঞান ও বিজ্ঞান', 'বঙ্গশ্রী', 'শিশুসাথী', 'যুগান্তর', 'দেশ', 'আনন্দবাজার' ইত্যাদি।
তার লেখা নিয়ে যেসব বই প্রকাশিত হয়েছে সেগুলি হলঃ–
আধুনিক আবিস্কার, বাংলার মাকড়সা, জীববিদ্যা, করে দেখ (১ম খণ্ড,২য় খণ্ড ও ৩য় খণ্ড), আণবিক গ্রন্থ (অনুবাদ), মহাশূন্যের রহস্য (অনুবাদ), আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু (সহ লেখক: মনােজ রায়), বাংলার কীট-পতঙ্গ, মনে পড়ে, পশুপাখী কীটপতঙ্গ, বিজ্ঞানের আকস্মিক আবিষ্কার, বাংলার গাছপালা, বিজ্ঞান অমনিবাস, করে দেখ (অখণ্ড), জন-বিজ্ঞানের নানা খবর, বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞান সংবাদ, মানব কল্যাণে পারমাণবিক শক্তি, জীবন নিয়ে যে বিজ্ঞান, প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ, বিষয় উদ্ভিদ, বিস্ময়কর জীবজগৎ, কিশাের রচনা সংকলন, ছোটদের সেরা বিজ্ঞান রচনা সংকলনঃ গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য।
এখানে জানিয়ে রাখা ভালো যে, ১৯৫১ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত সামাজিক পতঙ্গ বিষয়ক যে আন্তর্জাতিক আলোচনা চক্র অনুষ্ঠিত হয়েছিল তাতে ভারতীয় শাখা পরিচালনা করার জন্যে গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য আমন্ত্রিত ছিলেন। কিন্তু তিনি যেতে পারেননি। জানা যায় যে, আমেরিকান মিউজিয়াম অফ ন্যাচারাল হিস্ট্রি থেকে প্রকাশিত 'ন্যাচারাল হিস্ট্রি'-সহ বিভিন্ন জার্নালে ইংরেজিতে তাঁর মোট ২২ টা পেপার প্রকাশিত হয়েছিল।
গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য ছিলেন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সম্পাদকমণ্ডলীর মধ্যে অন্যতম। এছাড়া, তিনি সরকারি পরিভাষা সংসদেরও একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন।
গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য তাঁর বিজ্ঞানচর্চা ও সাহিত্যচর্চার জন্যে দেরীতে হলেও স্বীকৃতি পেয়েছেন। ১৯৬৮ সালে তিনি পেয়েছেন 'আনন্দ পুরস্কার'। ১৯৭৪ সালে 'বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ' তাঁকে প্রদান করে 'সত্যেন্দ্রনাথ বসু ফলক'। এর পরের বছর অর্থাৎ ১৯৭৫ সালে তাঁর লিখিত বাংলার কীটপতঙ্গ বিষয়ক এক অমূল্য সম্পদ 'বাংলার কীটপতঙ্গ' বইয়ের জন্যে তিনি 'রবীন্দ্র পুরস্কার' লাভ করেন। ওই বছরই তিনি লাভ করেন তাঁর জন্মস্থান থেকে লোনসিং হিতৈষী সমিতির সংবর্ধনা। ১৯৭৯ সালে তাঁর আগের কর্মক্ষেত্র 'বসু বিজ্ঞান মন্দির' থেকে লাভ করেন সেখানকার 'জুবলি পদক'। এছাড়াও, নানান সম্মাননা ও পুরস্কার তিনি লাভ করেছেন। বিজ্ঞানচর্চার জন্য ১৯৮১ সালে মৃত্যুর মাস তিনেক আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ভূষিত করে সামরিক ডি.এস.সি. ডিগ্রি দিয়ে। এর কিছুদিন পর ১৯৭১ সালের ৮ই এপ্রিল কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হয়। তিনি আমাদের ছেড়ে প্রায় চল্লিশ বছর আগে চলে গেলেও আজও তাঁর কাজ নিয়ে, তাঁর লেখা নিয়ে পুরোদমে চর্চা চলছে। তিনি আজও বেঁচে রয়েছেন তাঁর যাবতীয় লেখনীতে। আজও একাধিক প্রকাশনা সংস্থা তাঁর লেখাগুলি প্রকাশিত করে চলেছে। বাংলা বিজ্ঞান সাহিত্যে আজও এক উজ্জ্বলতম আইকন, অন্যতম সেরা পথ-প্রদর্শক হলেন গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য।
পশ্চিমবঙ্গ সরকার ২০০৫ সাল থেকে তাঁর নামাঙ্কিত 'গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য স্মৃতি পুরস্কার' প্রবর্তন করে থাকে। এই পুরস্কার বাংলায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণে যাঁরা বিশেষ ভূমিকা পালন করেন তাঁদের দেওয়া হয়ে থাকে। 'সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল' ও 'কিশোর জ্ঞান-বিজ্ঞান', 'গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য পুরস্কার' বিজ্ঞান সাহিত্যিকদের নিয়মিত প্রদান করে থাকে। জনজীবনে বিজ্ঞানের প্রসারণ ঘটাতে তাঁর নামে গড়ে উঠেছে 'গোপালচন্দ্র বিজ্ঞান প্রসার সমিতি'।
সেই কবে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কালজয়ী বিজ্ঞান গ্রন্থ 'বিশ্বপরিচয়'-এর ভূমিকায় বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে লিখে জানিয়েছিলেন তাঁর মনের ইচ্ছা– "আমার দুঃসাহসের দৃষ্টান্তে যদি কোন মনীষী, যিনি একাধারে সাহিত্যরসিক ও বিজ্ঞানী এই অত্যাবশ্যক কর্তব্য কর্মে নামেন, তাহলে আমার চেষ্টা চরিতার্থ হবে।" সেই 'অত্যাবশ্যক কর্তব্য' অর্থাৎ মাতৃভাষা বাংলায় বিজ্ঞানের দুরহ, জটিল তত্ব ও তথ্যাদি সব ধরণের মানুষের বোঝার জন্যে সহজ, সরল করে লেখালেখি করার মতো দুঃসাধ্য কাজটি নিঃসন্দেহে গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য অনায়াসে পালন করে গেছেন। কোনো লোভ বা স্বার্থ ছাড়াই কেবলমাত্র মাতৃভাষা বাংলায় বিজ্ঞানকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ করে গেছেন তিনি। তিনি তাঁর লেখনীর মাধ্যমে সমৃদ্ধশালী করে গেছেন বাংলা বিজ্ঞান সাহিত্যকে। এ প্রসঙ্গে বলা যায় যে, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাণী অর্থাৎ "বিজ্ঞান যাহাতে দেশের সর্বসাধারণের নিকট সুগম হয় সেই উপায় অবলম্বন করতে হইলে একেবারে মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চার গােড়াপত্তন করিয়া দিতে হয়। ....আপাতত মাতৃভাষার সাহায্যে সমস্ত বাংলাদেশকে বিজ্ঞানচর্চায় দীক্ষিত করা আবশ্যক।" সার্থক রূপ দিয়েছেন শ্রীগোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য। রবীন্দ্র ভাবশিষ্য, আচার্য জগদীশ বোসের পথানুসারী, আচার্য সত্যেন বোসের যোগ্য সহকারি বাংলার বিজ্ঞান সাহিত্যের অন্যতম পথপ্রদর্শক শ্রীগোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যকে আমাদের তরফ থেকে রইলো সশ্রদ্ধ প্রণাম ও এই ধারাবাহিকটি রইলো তাঁর প্রতি এক শ্রদ্ধার্ঘ্য।
সংক্ষিপ্ত জীবনীঃ–
প্রকৃতি-বিজ্ঞানী, স্বভাব-বিজ্ঞানী গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য ১লা আগস্ট, ১৮৯৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন অধুনা বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার লোনসিং গ্রামে। তাঁর পিতার নাম অম্বিকাচরণ ভট্টাচার্য ও মাতার নাম শশীমুখী দেবী। প্রকৃতিপ্রেমিক ও বিজ্ঞানপ্রেমিক এই মানুষটির জন্ম হয় এক দরিদ্র পরিবারে। অল্পবয়সে তাঁর পিতা মারা যান। তাই, বড়ো ছেলে হিসেবে তাঁকেই সংসারের হাল ধরতে হয়– কখনো পিতার পেশা যজমানি করে, কখনো আবার জমিদারি কাছারিতে নায়েবগিরি করে। বহু কষ্টের মধ্যে পড়াশোনা করে ১৯১৩ সালে লোনসিং উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক (এখনকার মাধ্যমিক) পরীক্ষায় স্কুলে তো বটেই এমনকি গোটা ফরিদপুর জেলাতেও সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে স্বর্ণপদক লাভ করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কুপ্রভাব হিসেবে সৃষ্ট চরম দারিদ্রতার ফলে তাঁরা আই.এ.( ইন্টারমিডিয়েট ইন আর্টস অর্থাৎ এখনকার কলা বিভাগে উচ্চ-মাধ্যমিক।তখন বিজ্ঞানের ছাত্রদেরও আই.এ., বি.এ. পড়তে হত) অসম্পূর্ণ থেকে যায়। পরে, গ্রামের স্কুলেই ভূগোলের শিক্ষকতা শুরু করেছিলেন। অল্পবয়স থেকেই তিনি ছিলেন প্রকৃতিপ্রেমিক– প্রকৃতির প্রতি তাঁর নিবিড় কৌতূহল ও অকৃত্রিম ভালোবাসা প্রগাঢ় ছিল। তিনি শিক্ষকতার পাশাপাশি সাহিত্যচর্চা করেছেন, সমাজসেবা করেছেন, জারি গান ও পালা গানের দল তৈরি করেছেন, কবিতা ও ছড়া গান লিখেছেন। তিনি ছিলেন জারি গানের এক উঁচুমানের শিল্পী। এই গ্রাম্য শিক্ষক একদিন ঘন অন্ধকার রাতে লক্ষ্য করলেন 'পচা গাছপালার আশ্চর্য বিকিরণ ক্ষমতা'। তা নিয়ে ওই নামেই তাঁর এক প্রবন্ধ ১৯১৮ সালে বিখ্যাত প্রবাসী পত্রিকায় (১৩২৬ বঙ্গাব্দের পৌষ সংখ্যায়) প্রকাশিত হয়েছিল। তখন অবশ্য তিনি শিক্ষকতা ছেড়ে কলকাতার এক টেলিফোন অপারেটর অফিসে কাজ করতেন। তাঁর এই প্রবন্ধ আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল, তাঁকে এতটাই মুগ্ধ করে তুলেছিল যে তিনি বিপ্লবী পুলিনবিহারী দাসের মারফতে গোপালচন্দ্রকে ডেকে পাঠান। আর এই প্রকাশিত প্রবন্ধ ও আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর সাথে এই সাক্ষাৎকার গোপালচন্দ্রের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ১৯২১ সালে গোপালচন্দ্র বসু বিজ্ঞান মন্দিরে রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্টের পদে যোগদান করেন। ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত তিনি বসু বিজ্ঞান মন্দিরে কর্মরত ছিলেন। আচার্য বসুর নির্দেশে তিনি উদ্ভিদবিদ্যা ও প্রাণিবিদ্যা সম্পর্কে উচ্চমানের গবেষণা করেন। গবেষণা ছাড়াও ছবি আঁকা, ফটোগ্রাফির কাজ, ইলেকট্রনিক্সের কাজকর্ম, মোটর মেকানিক্স, ব্লক তৈরির কাজ, ব্ল্যাক্সমিথের কাজ, কার্পেন্ট্রির কাজ– সমস্ত কিছুই তাঁকে শিখতে হয়েছিল। বলা যায় তাঁর গবেষণা ক্ষেত্রটি ছিল বিরাট কেননা তিনি উদ্ভিদের শরীর বৃত্তীয় ঘটনা, মাছ-সহ অন্যান্য প্রাণি ও কীটপতঙ্গের আচার-আচরণ এমনকি মেটামরফোসিস, জীবদ্যুতি ইত্যাদি বিষয় নিয়েও কাজ করেছিলেন। তিনি মৌলিক গবেষণা করেছিলেন প্রধানত মাকড়সা, পিঁপড়ে, প্রজাপতি, শুঁয়োপোকা, মাছ ও ব্যাঙাচি নিয়ে। বাংলার নানান রকমের কীটপতঙ্গ বিশেষ করে বিভিন্ন ধরনের মাকড়সা, পিঁপড়ে, ব্যাঙাচি নিয়ে তাঁর যে গবেষণা তা এ দেশে তো বটেই এমনকি ইংল্যান্ড ও আমেরিকার বিজ্ঞানী মহলেও বেশ সমাদরলাভ করেছিল। ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় তিনি বহু গবেষণামূলক লেখা লিখে গেছেন যা প্রকাশিত হয়েছিল দেশ-বিদেশের বহু নামকরা জার্নালে। গবেষণার পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট বিজ্ঞান প্রচারক। ১৯৪৮ সালে বাংলায় বিজ্ঞান প্রচারের জন্য যে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ প্রতিষ্ঠিত হয় সেই প্রতিষ্ঠায় তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সহকারি। প্রথম থেকেই এই বিজ্ঞান পরিষদের মুখপত্র 'জ্ঞান ও বিজ্ঞান' পত্রিকার সাথে যুক্ত ছিলেন, পত্রিকায় লেখালেখির পাশাপাশি সম্পাদনাও করেছিলেন। বিজ্ঞানের তরুণ লেখকগোষ্ঠী তৈরি করার কাজে, বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানের বইপত্র লেখার ব্যাপারে, বিজ্ঞান ক্লাব তৈরি করার ব্যাপারে গোপালচন্দ্র বরাবর বড়োই আগ্রহী ছিলেন।
তাঁর লেখার সংখ্যা আটশোরও বেশি। আর তাঁর বেশিরভাগ লেখাই প্রকাশিত হয়েছে 'জ্ঞান ও বিজ্ঞান' পত্রিকায়। তাঁর গবেষণামূলক বইয়ের সংখ্যা আট, এছাড়াও অজস্র স্কুলপাঠ্য বই তো আছেই। তিনি ছিলেন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সম্পাদকমণ্ডলীতে। তিনি সরকারি পরিভাষা সংসদেরও একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা ও বিজ্ঞান প্রচারের স্বীকৃতিস্বরূপ হিসেবে তিনি লাভ করেছিলেন– 'আনন্দ পুরস্কার (১৯৬৮)', 'আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু ফলক (১৯৭৪)', 'রবীন্দ্র পুরস্কার (১৯৭৫)', 'লোনসিং হিতৈষী সমিতির সংবর্ধনা (১৯৭৫)' -সহ বিভিন্ন সম্মাননা ও পুরস্কার। ১৯৮১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁকে দেওয়া হয় সাম্মানিক ডি.এস.সি. ডিগ্রি। কিংবদন্তি এই প্রকৃতি-বিজ্ঞানী, দেশের প্রথম কীটপতঙ্গবিদ গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যের জীবনাবসান হয় ১৩ ই সেপ্টেম্বর, ১৯৮১ সালে কলকাতায়।
তথ্যসূত্রঃ- বিস্মৃতপ্রায় বাঙালি বিজ্ঞানী(প্রথম খণ্ড)– রণতোষ চক্রবর্তী, জ্ঞান বিচিত্রা।
ছোটদের সেরা বিজ্ঞান রচনা সংকলনঃ গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য (সংকলন ও সম্পাদনা– শ্যামল চক্রবর্তী), দে’জ পাবলিশিং।
বাঙালি চরিতাভিধান (প্রথম খণ্ড), সাহিত্য সংসদ।
গোপালচন্দ্রের প্রথম প্রকাশিত লেখা– এম.এ. আজিজ মিয়া, জ্ঞান ও বিজ্ঞান ডিসেম্বর, ২০১৯ সংখ্যা।
উইকিপিডিয়া।
Post a Comment