ভারতের প্রথম কীট-পতঙ্গের বিজ্ঞানী গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য || পঞ্চম পর্ব
কিংবদন্তি কীটপতঙ্গবিদ গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যের সাথে স্বনামধন্য বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর সাথে যেমন পরিচয় ছিল তেমনি পরিচয় ছিল আরেক বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানী আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সাথে। বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সাথে পরিচয় হওয়ার ফলে আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসুও গোপাল চন্দ্র ভট্টাচার্যের বিজ্ঞান প্রতিভা জেনে মুগ্ধই হন। আর সে কারণেই আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রকাশিত বিখ্যাত 'জ্ঞান ও বিজ্ঞান’ পত্রিকার দায়িত্ব গোপালচন্দ্রের হাতে বহুকাল সঁপে দিয়ে নিশ্চিন্ত ছিলেন। এবার আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সাথে গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যের পরিচয়ের কথা আমরা আলোচনা করব।
সালটা ১৯৪৭। এই অক্টোবর মাসেরই ১৮ তারিখ। সবে মাস দুয়েক হল দেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে। তবে, এরই মধ্যে কিছু বিজ্ঞান উৎসাহী মানুষ মাতৃভাষা বাংলায় বিজ্ঞানচর্চাকে অগ্রগতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে বেশ উঠে পড়ে লেগেছিলেন। বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও বেশ কয়েকজন 'বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ' গঠন করার জন্যে এক প্রথম সভা আহ্বান করেছিলেন। এই সভার আহ্বানকারীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য। ১৯৪৮ সালের ২৫ শে জানুয়ারি–বাংলা বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে এক উল্লেখযোগ্য দিবস। কেননা এই দিনই বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার অন্যতম সেরা সাময়িকী বা পত্রিকা 'জ্ঞান ও বিজ্ঞান’-এর প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন প্রফুল্লচন্দ্র মিত্র এবং এই পত্রিকার প্রকাশ সমিতির অন্যতম সদস্য ছিলেন গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য। ওই বছরের জুলাই মাস থেকে গোপালচন্দ্র হলেন সহযোগী সম্পাদক। তার পরের বছর অর্থাৎ ১৯৪৯ সালে হন যৌথ সম্পাদক। তবে,১৯৫০ সাল থেকে পুরোপুরি সম্পাদকের ভূমিকা তিনি পালন করেছিলেন। তিনি বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের কার্যকরী সমিতিতে ছিলেন সেই ১৯৪৮ সাল থেকে টানা ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত। কেবলমাত্র ১৯৬৭-৬৮ সাল বাদ দিয়ে। এরপর, ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন সহ-সভাপতি। 'জ্ঞান ও বিজ্ঞান' পত্রিকায় তাঁর প্রথম রচনা হল 'ভৌতিক আলো' যা ওই পত্রিকার প্রথম সংখ্যাতেই প্রকাশিত হয়েছিল। এই পত্রিকার ভার গ্রহণ করার পরে পত্রিকার জন্যে তাঁকে প্রচুর লিখতে হয়েছে। ওই পত্রিকার 'ছোটদের বিভাগ'-এর বেশির ভাগ রচনা তিনিই লিখেছিলেন। উক্ত পত্রিকার একটি জনপ্রিয় বিভাগের নাম ছিল–'করে দেখো' এবং এই বিভাগের সবকটি লেখাই ছিল গোপালচন্দ্রের। এই 'করে দেখ' বিভাগের সবকটা লেখাই পরে একটি জনপ্রিয় বইয়ের আকারে প্রকাশিত হয়েছিল। জানা যায় যে, প্রথম বারো সংখ্যার অর্থাৎ এক বছরে 'জ্ঞান ও বিজ্ঞান' পত্রিকার সংখ্যা ছিল ১০৪ এবং লেখার সংখ্যা ছিল ১৬২ যার মধ্যে গোপালচন্দ্র একাই লিখেছিলেন ৩৫-টি লেখা। তাহলে, কত লিখতেন তিনি, ভাবা যায়!
জ্ঞান ও বিজ্ঞান পত্রিকা ছাড়াও তিনি যুক্ত ছিলেন 'দৈনিক যুগান্তর' পত্রিকার সাথেও। সেই পত্রিকার 'ছোটদের পাততারি' বিভাগের বিজ্ঞানী ছিলেন তিনি। এক্ষেত্রে, বলা ভালো যে বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও আলোকচিত্রশিল্পী পরিমল গোস্বামীর বিশিষ্ট বন্ধু ছিলেন গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য। কলকাতা তথা বাংলার অন্যতম সেরা সারস্বত ও সংস্কৃতিবান প্রতিষ্ঠা হিসেবে পরিচিত 'বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ'-এর সাথেও বিজ্ঞানী গোপালচন্দ্র যুক্ত ছিলেন। এখানে উল্লেখ্য এই যে, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সাথে বিভিন্ন সময়ে বহু স্বনামধন্য বিজ্ঞানীদের নিবিড় যোগাযোগ ছিল। এই প্রতিষ্ঠানের সভাপতির পদ অলংকৃত করেছিলেন স্বনামধন্য দুই বিজ্ঞান সাধক আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু ও আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ প্রকাশিত সুবিখ্যাত কোষ 'ভারতকোষ’ গ্রন্থাবলীতে গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যের মোট ৫৬টি রচনা অন্তর্ভুক্ত আছে।
গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বসু বিজ্ঞান মন্দিরে নিয়মিত আসতেন। এমনকি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করার পরেও কাজের জগত থেকে বা বলাবাহুল্য বিজ্ঞানচর্চার জগৎ থেকে তিনি সরে আসেননি। ১৯৭৭ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত তিনি বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি আমৃত্যু হয়তো ওই পদে আসীন থাকতে পারতেন। কিন্তু বাঁধ সাধলো কেন্দ্রীয় সরকারের এক বিচিত্র নিয়ম। তা, কি সেই নিয়ম? তিনি স্নাতক নন তাই সম্পাদকের আসীনে তাঁর থাকা চলবে না। তাই, দীর্ঘ তিন দশক যোগ্য সম্পাদকের পদ সামলেও ডিগ্রির অভাবে ১৯৭৭ সালের এপ্রিল মাসে তাঁকে সম্পাদকের পদ থেকে ইস্তফা দিতে হয়। তবুও, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের সাথে যুক্ত ছিলেন। তিনি আমৃত্যু জ্ঞান ও বিজ্ঞান পত্রিকার মুখ্য উপদেষ্টার ভূমিকা পালন করে গিয়েছিলেন।
গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য গবেষণার বাইরেও প্রচুর বিষয় লিখে গেছেন। বিজ্ঞান সাময়িকীর দায়িত্ব গ্রহণ করার পর তাঁর এই লেখার দায়িত্ব আরো কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছিল যে আমরা দেখলাম। ছোটদের বিভাগ, কিশোরদের বিভাগ-সহ ইত্যাদি বিভিন্ন বিভাগ তিনি সম্পাদকরূপে ও লেখক হিসেবে যথাযথভাবে সমৃদ্ধশালী করে তুলেছিলেন তাঁর সম্পাদনা ও লেখনীর গুণে। আর এই সমৃদ্ধশালী করার কাজে তিনিও প্রচুর পরিমাণে লেখালেখি করে গেছেন। জ্ঞান ও বিজ্ঞান পত্রিকার সম্পাদকের ভূমিকার ক্ষেত্রে তাঁর বিভিন্ন বিভাগে লেখালেখির কথা তো আগেই জানতে পেরেছি।
গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য তাঁর কর্মজীবনের শেষে ব্যাঙাচি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার কাজ করেছিলেন। এ বিষয় তাঁর একটি গবেষণা সম্পূর্ণ নতুন দিক উন্মোচন করেছিল। তিনি জানিয়েছিলেন যে, ব্যাঙাচি থেকে পূর্ণাঙ্গ ব্যাঙে রূপান্তর পেনিসিলিন মন্থর করে দেয়। তিনি তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছিলেন ব্যাঙাচির দেহে পেনিসিলিন শরীরবৃত্তীয় পরিবর্তন ঘটায়। বলাবাহুল্য তাঁর এই গবেষণা শরীরবৃত্তীয় ও জীব-রসায়ন গবেষণার পথকে প্রশস্ত করে তুলেছে। পচা গাছপালার আলো বিকিরণ (যাকে বলে জৈবদ্যুতি) থেকে আরম্ভ করে দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য মেতে ছিলেন নানা পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ নিয়ে। বিচিত্র সব পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে তাঁকে যেতে হয়েছিল কোনও অজানা পুকুর ঘাটে বা অচেনা কারুর বাড়ির জানালার কাছে। তিনি কিন্তু সমস্ত বাহ্যজ্ঞানশূন্য অবস্থায় নিবিড় মনোযোগের সাথে পর্যবেক্ষণের কাজ চালাতেন। আসলে, প্রকৃত বিজ্ঞান সাধকের মতো পর্যবেক্ষণ বস্তুই ছিল তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। কিন্তু সাধারণ মানুষ কি তা বোঝে? তাই এই কারণে অনেকবার তাঁকে সাধারণের কাছে নিগৃহ হতে হয়েছে। কিন্তু তিনি যে প্রকৃতি বিজ্ঞানের এক নিবিড় সাধক, তাই এসব বাঁধায় তাঁর ধ্যান-জ্ঞানে কি ক্ষতিগ্রস্থ হয়? তা মোটেও হয়নি। আর তাই তো তাঁর হাত ধরে প্রকৃতি বিজ্ঞান গবেষণার এক নবদিক উন্মোচিত হয়েছে।
Post a Comment