নেতাজীর হাতে উদ্বোধন হওয়া 'মিত্রা' সিনেমাহল টিকিয়ে রাখতে পারেনি বাঙালি
সালটা ২০১৯। বন্ধ হয়ে গেল উত্তর কলকাতার ঐতিহ্যবাহী সিনেমাহল 'মিত্রা'৷ যার পূর্বনাম ছিল 'চিত্রা'। মল কালচারের প্রকোপে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে কলকাতার ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো। 'ভূতের ভবিষ্যৎ' চলচ্চিত্রে সব্যসাচী চক্রবর্তীর সেই ডায়লগটা খুব মনে পড়ে "কলকাতার পুরানো বাড়িগুলো খুব দ্রুত ভ্যানিশ হয়ে যাচ্ছে। উত্তর কলকাতার দু-দুটো শতাব্দী পার করা বাড়িগুলো থেকে দক্ষিণ কলকাতার আর্ট ডেকোর স্টাইলের বাড়ি। প্রগতির গুঁতোয় সব ভাঙ্গা পড়ছে। রাজ-স্বরাজ পেরিয়ে এখন শুরু হয়েছে প্রোমোটার রাজ। পারলে তারা রাইটার্স বিল্ডিং ভেঙ্গে সাততারা হোটেল খুলে বসে। নিত্যনতুন গন্ডোমেনিয়াম, প্যান্ডেমোনিয়াম, মাল্টিপ্লেক্স, মল-মূত্র ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র।"
প্রখ্যাত চলচ্চিত্র প্রযোজক বীরেন্দ্রনাথ সরকার যিনি ১৯৭০ সালে 'দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার' ও ১৯৭২ সালে 'পদ্মভূষণ' পুরস্কারে ভূষিত হন। সেই বীরেন্দ্রনাথ সরকার কলকাতার হিন্দু স্কুলে পড়াশুনা শেষ করার পর লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। লন্ডনে পড়াশুনা শেষ করার পর তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন। তিনি যখন ভারতে ফিরলেন তখন তাঁকে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। তিনি এ প্রস্তাবে রাজীও হয়ে যান। এখান থেকেই চলচ্চিত্রের প্রতি তাঁর একটা আলাদা আগ্রহ তৈরি হয়। তিনি হঠাৎ করেই বাংলা ভাষায় চলচ্চিত্র প্রদর্শন করার প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৩০ সালের ৩০ শে ডিসেম্বর কলকাতায় 'চিত্রা' নামক একটি চলচ্চিত্র প্রেক্ষাগৃহ স্থাপন করেন তিনি। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু উদ্বোধন করেন এই প্রেক্ষাগৃহের৷
পূর্ণদৈর্ঘ্যের সবাক ছবি 'দেনা-পাওনা' দিয়ে 'চিত্রা' সিনেমাহলের যাত্রা শুরু হয়। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর উদ্বোধনী ভাষণে স্বদেশী সিনেমা তৈরির আহ্বানে ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে সিনেমা তৈরির ডাকে বীরেন্দ্রনাথ সরকার কয়েক মাসের মধ্যেই গড়ে তুললেন 'নিউ থিয়েটার্স'। ১৯৬৩ সালে জমিদার হেমন্তকৃষ্ণ মিত্র কিনে ফেলেন এই প্রেক্ষাগৃহটি৷ 'চিত্রা' নামটি বদলে প্রেক্ষাগৃহের নামকরণ করা হয় 'মিত্রা'।
প্রায় ৮৮ বছর ধরে উত্তর কলকাতার সাবেকিয়ানার সাথে মিশে গিয়েছিল 'মিত্রা'। রবিবার ও অন্যান্য ছুটির দিনে এখানে ছবি দেখার জন্য লম্বা লাইন লেগে যেত৷ উত্তর কলকাতার কলেজ পড়ুয়াদের কাছে তীর্থক্ষেত্র ছিল এই স্থান। আলু চিপস, পপকর্ণ খেতে খেতে প্রেক্ষাগৃহের লাল চেয়ারে ছবি দেখার এখানে আলাদা মজা ছিল। উত্তম-সূচিত্রা থেকে প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণা, পরমব্রত-রাইমা প্রত্যেকের ছবি প্রদর্শিত হয়েছে এখানে।
সময়ের সাথে সাথে সবকিছু পরিবর্তিত হয়। মাল্টিপ্লেক্সের কাছে সিঙ্গেল স্ক্রিন পরিকাঠামো দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়ে। মাল্টিপ্লেক্সে যত ভিড় বাড়ছে তত সিঙ্গেল স্ক্রিনে লোকেদের আসা-যাওয়া কমছে। সিঙ্গেল স্ক্রিনে ব্যয় বহন করা কঠিন হয়ে পড়ছে। 'মিত্রা' হল কর্তৃপক্ষ উক্ত সমস্যায় পড়ে। সঠিক পরিকাঠামোর অভাবের জন্য লোকেদের আনাগোনা কমে আসতে থাকে। মাল্টিপ্লেক্সের সমতুল্য পরিকাঠামো গড়ে তুলতে তারা ব্যর্থ হন। অতিরিক্ত ব্যয় বহন করা তাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাই ২০১৯ সালের এপ্রিলে 'মিত্রা' হলের কর্তৃপক্ষ হলটি বিক্রি করে দেন।
বৈদেশিক মল কালচারের আক্রমণে এভাবে একটা একটা করে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে বাংলার ঐতিহ্যবাহী স্থান। সুভাষচন্দ্র বসুর হাত ধরে যে প্রেক্ষাগৃহ উদ্বোধন হলো তাকে বাঁচিয়ে রাখতে উদ্যোগ নেয়নি কোনো বাঙালি। এই প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ হওয়ার ফলে উত্তর কলকাতার বহু মানুষ ভুলতে পারছেন না পুরানো দিনের স্মৃতিগুলো। কলকাতার বাঙালি ব্যবসাবিমুখ হওয়ার জন্য ভিনরাজ্যের ব্যবসায়ীদের হাতে চলে যাচ্ছে এক একটা ঐতিহ্য। 'মিত্রা' হলটি বিক্রি হওয়ার পর খুব শীঘ্রই তা ভেঙ্গে তৈরি হবে শপিং মল। মুছে যাবে উত্তর কলকাতার এই প্রেক্ষাগৃহের সাথে জড়িত থাকা সাবেকি স্মৃতিগুলো। বাঙালির অসচেতনতার দোষে বাঙালি 'মিত্রা'র মতো এক ঐতিহ্যমণ্ডিত দ্রষ্টব্য স্থান হারালো। এভাবে বাঙালি ক্রমশ হেরে যাচ্ছে সমস্ত দিক দিয়ে।
প্রতিবেদন- সুমিত দে
Post a Comment