ফর্মুলা ওয়ানে অংশ নেওয়া এক বাঙালি বাবা ও ছেলে সামিল যখন গতির লড়াইতে
পৃথিবীর এক রূদ্ধশ্বাস মোটর স্পোর্টস হলো ফর্মুলা ওয়ান। একটি লম্বা-চওড়া ট্র্যাকের মধ্যে দ্রুতগতিসম্পন্ন গাড়িদের দৌড়। গভীর দৃষ্টিশক্তি, ইস্পাতসম মনোবল ও দুর্ধর্ষ সাহস না থাকলে এই খেলাতে অংশ নেওয়া যাওয়া যায়না। কেবল ক্ষমতা বা মনোবল থাকলেই হবে না, সাথে দরকার মোটা টাকাও। বিশ্বের মধ্যে সর্বাধিক ব্যয়বহুল খেলা হলো ফর্মুলা ওয়ান রেস।
দেশ-বিদেশের বড়ো বড়ো মেট্রোপলিটন ও স্মার্ট সিটিতে বিশাল জায়গা জুড়ে রয়েছে ফর্মুলা ওয়ান রেসের স্টেডিয়াম। হাজার হাজার গাড়ি ট্র্যাকের মধ্যে প্রবল গতিতে ছুটে চলে। কে প্রথম হবে আর কারা ট্র্যাক সম্পূর্ণ করবে এই নিয়ে চলে দর্শকদের উত্তেজনা। স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে দর্শকদের আওয়াজ ও গাড়ির শব্দে যেন ভূমিকম্প হওয়ার উপক্রম। ট্র্যাকে গাড়ির একটু গোলমাল হলেই ভয়াবহ বিপদের সম্ভাবনা। ফর্মুলা ওয়ান রেসারদের প্রতিযোগিতাতে অংশ নেওয়ার সময় সামান্য অসাবধান হলেই মৃত্যুরও আশঙ্কা থাকে। পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে বহু ফর্মুলা ওয়ান রেসারদের।
সালটা ২০১১, দিল্লির বুদ্ধ ইন্টারন্যাশনাল কোর্টে আয়োজিত হয় ফর্মুলা ওয়ান রেস। সেবাস্টিয়ান ভেটেল থেকে মাইকেল শুমাখারদের মতো তাবড় তাবড় খেলোয়াড় তাতে অংশ নিয়েছেন। তাদেরকে লাল কার্ড দেখানোর জন্য ট্র্যাকের পাশে মার্শালের ভূমিকায় দাঁড়িয়ে এক বাঙালি। তিনি হলেন দেবদত্ত মুখোপাধ্যায়। যাকে সকলে জন মুখোপাধ্যায় নামেই চেনেন৷
ফর্মুলা ওয়ান রেসে জন মুখোপাধ্যায়ই হলেন একমাত্র বাঙালি মার্শাল। এর আগে কোনো বাঙালিকে এই মোটর স্পোর্টসে দেখা যায়নি। ক্রিকেটে যেমন অ্যাম্পায়ার, ফুটবলে যেমন রেফারি ঠিক তেমনই ফর্মুলা ওয়ান স্পোর্টসে মার্শাল। ২০১১ সালে তিনি চণ্ডীগড় থেকে ফর্মুলা ওয়ান রেসে মার্শাল হিসেবে অংশ নেন। কলকাতা নিবাসী হলেও বিশেষ কারণবশত তাকে চণ্ডীগড় থেকে নাম দিতে হয়েছিল। এই ব্যাপারটা জনবাবুকে প্রচণ্ড কষ্ট দেয়।
জন মুখোপাধ্যায়ের ছেলে তথাগত মুখোপাধ্যায় ওরফে তুন্নার কাছে তার ফর্মুলা ওয়ান সম্পর্কে নেশা জাগে। তথাগত মুখোপাধ্যায় কলকাতার একজন স্বনামধন্য মোটর স্পোর্টসম্যান। মাত্র ছয় বছর বয়সের তুন্নার মোটর স্পোর্টসে হাতেখড়ি হয়। ঐ বয়সে ব্যাঙ্কক ও সিঙ্গাপুরের মতো জায়গার রাস্তাতে গাড়ি চালিয়েছিলেন তিনি। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় চেন্নাইতে অনুষ্ঠিত এক মারুতি রেসিং প্রতিযোগিতায় তিনি ষষ্ঠ হন। ছেলের এমন ক্ষমতা দেখে তিনি বারবার মুগ্ধ হতেন। ছেলেকে দেখে মোটর স্পোর্টসের প্রতি তার আগ্রহ জন্মাতে থাকে। বিভিন্ন সংবাদপত্র ও বই পড়ে ফর্মুলা ওয়ান স্পোর্টস সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করেন তিনি।
বাঙালির ওপর যে সাধারণ অপবাদ জুড়ে দেওয়া হয় তা হলো বাঙালিরা নাকি ভীতু। এই অপবাদের ভুল প্রমাণের চেষ্টাতে তিনি লড়ে যাচ্ছেন। তার ছেলে ফর্মুলা ওয়ানে নাম লেখালে তাকে আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী প্রশ্ন করতে থাকে যে এই কঠিন খেলাতে তিনি কেন তার ছেলেকে পাঠিয়ে বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছেন? এর জবাবে তিনি বলেন জীবনে বিপদের সম্মুখীন না হলে বা রিস্ক না হলে বড়ো কিছু করা যায়না। তাই তিনি যা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সবই সঠিক৷
ভারতের সর্বকনিষ্ঠ ফর্মুলা ওয়ান রেসার হিসেবে তেরো বছর বয়সে ফর্মুলা ওয়ান রেসিং এ নামেন তার ছেলে তুন্না৷ তিনি ছাড়া আর কোনো বাঙালি ফর্মুলা ওয়ান রেসিং এ অংশ নিচ্ছেন না৷ যার প্রসঙ্গে অনেকে বলতে থাকেন বাঙালিদের দিয়ে নাকি ফর্মুলা ওয়ান রেসিং হবে না। জন মুখোপাধ্যায় মনে করেন ওটা বাঙালির দোষ না। বাংলাতে ফর্মুলা ওয়ানের জন্য পরিকাঠামো না গড়ে তুললে বাঙালি পারবে কী করে?
একবুক স্বপ্ন নিয়ে দিন কাটে জনবাবুর প্রতিদিন। যিনি চান বাঙালিরা মোটর স্পোর্টসের মতো খেলাতে বেশি করে নাম লেখাক। তার ছেলেরও একই কথা যে বাঙালিদের শুধু ক্রিকেট ও ফুটবল নিয়ে থাকলেই হবে না মোটর স্পোর্টসেও আগ্রহ তৈরি করতে হবে৷ জনবাবুর স্বপ্ন কিছুটা হলেও সত্যি হতে চলেছে কারণ কলকাতার বুকে তৈরি হচ্ছে জোবা রেসিং বা কেজেআর৷ তার উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে ফর্মুলা ওয়ান রেসিং প্রতিযোগিতা। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো ঐ প্রতিযোগিতায় থাকছে না কোনো বাঙালি।
প্রতিবেদন- সুমিত দে
Post a Comment