Header Ads

উৎসবের প্রয়োজনীয়তা, সামাজিকতা ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব


১৩ ই আশ্বিন, ১৪২৭, বুধবারঃ- আমাদের ক্ষুদ্র জীবন। এই জীবনকে উপভোগ করার জন্য প্রয়োজন হয় নানান উপকরণের। জীবনকে আরো বেশি আনন্দদায়ক করে তোলে উৎসব। লাখ লাখ বা কোটি কোটি টাকা খরচ করে আয়োজন করা হয় এক একটা উৎসবের৷ কোনো উৎসব চারদিনের হয়, কোনো উৎসব একদিনেরও হয়, কোনো উৎসব দুইদিনেরও হয়৷ উৎসবে আমরা সকলে হৈ-হুল্লোড় করি৷ উৎসব আসা মানেই কেমন যেন একটা উত্তেজনা কাজ করে বুকের মধ্যে। 


একঘেঁয়েমি জীবন থেকে বাঁচতে মাঝে-মধ্যে উৎসবের যথেষ্ট প্রয়োজন আছে। যে সমস্ত বাঙালিরা বলেন উৎসব করে কী হয়? কী হবে বেকার বেকার লাখ লাখ টাকা খরচ করে? তাদের জন্য আজকের এই প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করছি। 

বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব হলো দুর্গোৎসব। তাছাড়াও আরো অনেক উৎসব হয় কিন্তু দুর্গোৎসবে খরচটা সবচেয়ে বেশি। চারদিন ধরে এই পুজো হয়। মণ্ডপ, প্রতিমা,  লাইট, পুজোর উপকরণ মিলিয়ে লাখ টাকা লেগে যায় এই পুজো করতে। পাড়ায়, ক্লাবে, শহরে-গ্রামাঞ্চলে বিভিন্ন সার্বজনীন পুজো কমিটি দুর্গাপুজোর আয়োজন করে থাকে। 

অনেক মানুষ থাকেন যারা পুজোর জন্য একটাকাও খরচ করতে চাননা। পুজোতে চাঁদা দিতে চাননা। তারা ভাবেন যে পূজোতে চাঁদা দিলে তাতে আমার কী লাভ হবে? তাঁরা কেবল নিজেদের স্বার্থটাই দেখে। কিন্তু কখনো ভাবেন না যে এ টাকাতে একজন গরীব মানুষের পেট ভরবে। তবে কিছু জায়গায় জোর করে চাঁদা তোলার মতো বিক্ষিপ্ত ঘটনাও ঘটে থাকে। যদিও সব জিনিসেই ভালো-খারাপ দিক রয়েছে। তা নিয়ে বিস্তারিত যাচ্ছিনা। কারণ সোনালি চাঁদেও কলঙ্কের দাগ রয়েছে। তবে অনেক ভালো মনের মানুষ নিজেদের পকেট থেকে চাঁদা দিয়ে পাড়াতে পুজোর আয়োজন করেন। এই চাঁদার বিনিময়ে কিন্তু বহু দিন আনি দিন খাই মানুষ ও নিম্নবিত্ত মানুষদের পেট চলে৷ 

যারা মণ্ডপ বানাচ্ছেন তারা বিভিন্ন গ্রামাঞ্চল থেকে আসছেন। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার বন্যাপ্রবণ এলাকার মানুষ বন্যাতে যাদের ঘর ভেসে যায়, তারা দু'মুঠো খাবারের জন্য প্রতিমা গড়ে ও থিমের মণ্ডপ তৈরি করেন। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার পটশিল্পীদের আয়ের সংস্থান হয়। বাঁকুড়া ও দুই বর্ধমানের ডোকরা শিল্পীদের মোটা টাকা আসে। হাওড়ার জরি শিল্পীরা প্রচণ্ড লাভের মুখ দেখে৷ কুমোরটুলির মৃৎশিল্পীরা সুখে বেঁচে থাকার সুযোগ পায়। চন্দননগরের লাইট ব্যবসায়ীদের রোজগার হয়। হুগলিতে যারা পাটের কাজ করে ও শন থেকে যারা প্রতিমার জন্য চুল তৈরি করে তাদের মুখে হাসি ফোটে। রাজ্যের বহু জেলাতে ফুল চাষ হয়, সেই ফুল পুজোর কাজে লাগে। ফলে ফুল ব্যবসায়ীদেরও রোজগার হয়। ডেকোরেটার্সদের মণ্ডপসজ্জার জন্যও অর্থ উপার্জন হয়।  

যে সব চাষীরা বাঁশ চাষ করেন তারাও রোজগারের সুযোগ পায়। পুজোতে ঘট, কলাপাতা রাখার পাত্র, মাটির প্রদীপ, সরা ব্যবহৃত হয় যা কুমোররা তৈরি করে ভালো রোজগারের সুযোগ পায়৷ পুজোতে আমরা সকলে নতুন নতুন জামাকাপড় কিনতে দোকানে ভিড় করি। সকলে নতুন জামাকাপড় কেনাকাটা করার ফলে তাঁতি, দোকানদারদের লাভ হয়।

পুজোতে আজকাল ছেলেমেয়েদের নানারকম ভাবে সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য পুজো স্পেশাল ফ্যাশনের একটা ট্রেন্ড এসেছে। যার জন্য তারা পার্লার, সেলুনে ভিড় জমায়, এতে নাপিত, বিউটিশিয়ান, প্রফেশনাল হেয়ার স্টাইলিস্ট, মেকআপ ম্যানদের রোজগার হয়। অনেক মানুষ পুজোর আগে বাড়িতে নতুন করে চুনকাম করে, অনেক মণ্ডপেও রঙ করা হয়, এতে রঙ ব্যবায়ীদেরও রোজগার হয়। কুটিরশিল্প থেকে শুরু করে হস্তশিল্প, গহনা শিল্প প্রত্যেক খাতে অসংখ্য রোজগার হয়। 

দুর্গাপুজোতে ফার্স্টফুডের দোকান থেকে মিষ্টান্ন দোকানগুলোতে ভিড় জমে যায়। খাবার দোকান থেকে হোটেলগুলোতে প্রচুর টাকা আসে। এছাড়াও দুর্গাপুজোর জন্য বিভিন্ন কোম্পানি লক্ষ লক্ষ টাকা স্পনসর করে পাড়ার পুজোর জন্য। ফিল্ম থেকে শুরু করে মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি আমজনতার জন্য প্রচুর পরিমাণে নিত্যনতুন গান ও সিনেমা বানায়। এই মরসুম মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি ও সিনেমার জন্যও একটা রমরমা সময়।

মিউজিক ও সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি ছাড়াও লাভবান হয় পাবলিশিং হাউস ও প্রিন্টিং হাউসগুলো। প্রিন্টিং হাউস থেকে পুজোর ব্যানার, কার্ড, বিভিন্ন সংঘ ও পুজো কমিটির ম্যাগাজিন ছাপানো হয়। পাবলিশিং কোম্পানিগুলো পুজো সংখ্যার জন্য পত্রিকা প্রকাশ করে যা কেনার জন্য বই দোকানগুলোতে পাঠকদের ভিড় জমে যায়।

আবার দুর্গাপূজাতে বাংলার প্রত্যেক স্থানে লোকগান, ব্যালে, কীর্তন, কবি গান, সুফি গান, নাটক, বাউল, যাত্রাপালা, নৃত্যানুষ্ঠান, ম্যাজিক শো, ছৌ নাচ, মূকাভিনয়, সঙ্গীতানুষ্ঠান, যোগব্যায়াম, গল্প পাঠ ও শ্রুতিনাটক ও অর্কেস্ট্রার আসর বসে৷ যে কারণে সব রকমের সৃজনশীল মানুষ, পেশাগত শিল্পী ও স্থানীয় শিল্পীরা মনোরঞ্জনের ব্যাপক সুযোগ পেয়ে থাকেন৷ শুধু তাই নয়, দুর্গাপুজোতে দীনদুঃখী মানুষদের বস্ত্র বিতরণ করা হয়, নর-নারায়ণের সেবা করে গরীব মানুষদের খাওয়ানো হয়। কোথাও কোথাও আবার দুঃস্থ ছাত্র-ছাত্রীদের বই-খাতা বিতরণ করা হয়।

এককথায় বলতে গেলে দুর্গাপুজোর মতো প্রত্যেকটা উৎসব গরীব-আর্তপীড়িত মানুষদের মুখে অনেকটাই হাসি নিয়ে আসে। উৎসবকে কেন্দ্র করে মানুষের একটা  মিলনক্ষেত্র তৈরি হয় যেখানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষ এক হয়ে আনন্দযজ্ঞে মেতে ওঠে। মানুষের কাছে সবচেয়ে বড়ো জিনিস হলো মন৷ এই মনের মিলনও উৎসবের মাধ্যমেই ঘটে। অতএব উৎসব কখনোই তুচ্ছ বস্তু নয়। 

উৎসব নিয়ে যারা নানা প্রকার বাজে কথা বলেন যেমন উৎসবে মদের আখড়া বসে, জুয়া চলে, দু'একটা পুজো কমিটি অনেক মানুষের সাথে অশালীন আচরণ করে। এ প্রসঙ্গেও বলা ভালো আমরা অযথা খারাপটা নিয়ে কেন মাথাব্যথা করবো? যারা অমানবিক স্বভাবের হয় তারা সব জায়গাতেই তাদের স্বভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটাবে এটাই স্বাভাবিক। উৎসবে কোনো রকম অশান্তি ঘটলে তা নিয়ন্ত্রণের জন্য পুলিশ, প্রশাসন থাকে। তারা সেগুলো বুঝে নেবে৷ আমাদের মনে রাখতে হবে বাঙালির কাছে উৎসব হলো সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। একটা উৎসবই পারে সকল মানুষকে একসূত্রে গ্রথিত করতে৷ 

প্রতিবেদন- সুমিত দে

No comments