এক হাতে বাইসনকে হত্যা করা রানী ভবশঙ্করীকে ভয় পেত পাঠান ও মোগলরা
প্রতি বছর হাওড়ার উদয়নারায়নপুরে রায়বাঘিনী রানী ভবশঙ্করী মেলা হয়৷ নাট্যকার দীনেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত তাঁর জীবন নিয়ে ঐতিহাসিক নাটক 'রানী ভবশঙ্করী' রচনা করেছেন। বাঙালি হয়তো এই নাটকের কথাও ভুলে গেছে। বেশিরভাগ বাঙালি নিজের জাতির বীরেদের নিয়ে ভুলে যাচ্ছে গর্ব করতে। অনেক বাঙালি দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থে বাঙালির গৌরবময় ইতিহাসকে জ্বলাঞ্জলি দেওয়ার জন্যও প্রস্তুত। হীনমন্যতায় ভোগা বাঙালিকে বারবার জানতে হবে রানী ভবশঙ্করীদের কথা।
সোশ্যাল মিডিয়াতে একটা ছবি খুব ভাইরাল হয়েছে। যে ছবিতে মারাঠা, শিখ ও রাজপুতদের ক্ষমতার কথা সহজে বোঝানোর জন্য তরয়ালের ছবি আঁকা আছে তাদের জাতির নামের পাশে। আর এই ছবিতে বাঙালির ক্ষমতা কলমের ছবির মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে। বাঙালি লেখালেখিতে পঁটু, বাঙালি প্রতিবাদ করলে তার প্রতিবাদের ভাষা উঠে আসে গল্প-কবিতা-উপন্যাস ও নাটকের মাধ্যমে। কলমকে বাঙালি শক্তিশালী অস্ত্র মনে করে। এই কলমই পারে শত্রুদের মুখোশ খুলে দিতে। তবে বাঙালি যে যুদ্ধ-বিদ্যায় পারদর্শী নয় একথা ভুল। বাঙালির পরিচয় কেবল কলম দিয়ে বোঝানো যায় না ৷
ভুলে গেলে চলবে না অলিন্দ যুদ্ধে বিনয়-বাদল-দীনেশ এই তিন বিপ্লবীর সাথে ঝাঁক ঝাঁক পুলিশও পেরে উঠতে পারছিল না গুলির লড়াইতে৷ মোগলদের আক্রমণ থেকে কীভাবে বারো ভুঁইয়ারা বাংলাকে রক্ষা করেছিল বা বর্গী আক্রমণকে বাংলার রাজারা কীভাবে প্রতিহত করেছিল, বাঙালিদের বীরত্বের এই কাহিনী আমরা সকলেই জানি।
নারী বলুন বা পুরুষ উভয়লিঙ্গের বাঙালি সকলেই অসীম বুদ্ধিমত্তা ও ক্ষমতার অধিকারী। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের কাহিনী, বাংলার ডাকাত রাণী দেবী চৌধুরাণীর কথা, মাতঙ্গিনী হাজরার কথা, কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের বেড়ে ওঠার গল্প প্রমাণ করে বাঙালি মেয়েরাও কোনো অংশে কম নয়। আজ এমনই একজন বীরাঙ্গনার কথা বলবো যার কথা হয়তো অনেক বাঙালিই জানেন না।
এক বাঙালি বীরাঙ্গনা যিনি জীবনযুদ্ধে কখনো হার স্বীকার করেননি। মোগল ভীতও নড়ে যেত তাঁর ভয়ে। তিনি ছিলেন ভূরিশ্রেষ্ঠ রাজ্যের শাসক। যা অধুনা হাওড়া, হুগলি, বর্ধমান এবং মেদিনীপুরের বিস্তৃত অংশ নিয়ে গড়ে উঠেছিল। তিনি পাঠান ও মোগলদের ভয়ের কারণ হয়ে উঠেছিলেন। তিনি হলেন রায়বাঘিনী ভবশঙ্করী।
বাংলাতে তখন চলছে মোগল ও পাঠানদের ক্ষমতা দখলের লড়াই। দিল্লির মসনদে রাজত্ব চালাচ্ছেন সম্রাট আকবর। এক মহিলার রণশক্তির ভয়ে ধরি মাছ নাছুঁই পাণির মতো অবস্থা মোগল ও পাঠানদের। রানী ভবশঙ্করীর নাম শুনলেই চমকে উঠতে থাকে মোগল ও পাঠানরা। কারণ তারা ভালোভাবে জানতো রানী ভবশঙ্করী একবার আক্রমণ করলে বেঁচে ফেরার উপায় নেই কারো। ভবশঙ্করীর মধ্যে কী কেমন অসীম ক্ষমতা ছিল যে মোগল ও পাঠানদের মতো শক্তিশালী সাম্রাজ্যবাদীরাও ভয়ে লুটিয়ে পড়তো? সেই কথাতেই এবার আসি৷
ভূরিশ্রেষ্ঠ রাজ্যের পেঁড়ো গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন রানী ভবশঙ্করী৷ তাঁর পিতা ছিলেন দীননাথ চৌধুরী। পেঁড়োর জমিদারের অধীনস্থ দূর্গের সেনাপতি ছিলেন দীননাথ চৌধুরী৷ ভূরিশ্রেষ্ঠ রাজ্যের এক গণ্যমান্য ব্যক্তি হিসেবে তাঁর নামডাক ছিল। দীননাথ চৌধুরীর ছিল দুই সন্তান। তাদের মধ্যে ভবশঙ্করী বড়৷ ভবশঙ্করীর ভাই জন্মানোর সময় মারা যান তাঁর মা। এরপর থেকেই পিতার আদর্শে বড়ো হতে থাকেন ভবশঙ্করী। পিতার সাহচর্যে তিনি অশ্বচালনা, কুস্তি, অস্ত্রবিদ্যা ও তীর চালনাতে দক্ষ হয়ে ওঠেন। এমনকি কূটনীতি, রাজনীতি, সমাজতত্ত্ব ও দর্শনের পাঠও নেন।
ভবশঙ্করী পিতার পরামর্শে একজন সাহসিনী নারী হয়ে ওঠেন। দামোদরের তীরে একবার তিনি শিকারে যান যেখানে তিনি দেখেন একটি বুনো বাইসন একটি হরিণকে আক্রমণ করছে। এই দৃশ্য দেখে তিনি হরিণটিকে বাঁচাতে বুনো বাইসনের ওপর লাফিয়ে পড়ে এক হাতে হত্যা করলেন বুনো বাইসনটিকে।
বাইসনকে হত্যা করার সময় দামোদর নদীতে নৌকা ভিড়িয়ে কাষ্ঠসাংড়ার দিকে যাচ্ছিলেন ভূরিশ্রেষ্ঠ রাজ রুদ্রনারায়ণ। যিনি ভবশঙ্করীর এমন সাহস দেখে তাঁকে বিয়ে করবেন বলে ঠিক করলেন। হরিদেব ভট্টাচার্যের পৌরহিত্যে রাজা রুদ্রনারায়ণের সাথে বিবাহ সম্পন্ন হলো ভবশঙ্করীর। বিয়ের পর দামোদর নদীর তীরে ভবানীপুর দূর্গ নামের এক নতুন রাজবাড়ি তৈরি হয়। রুদ্রনারায়ণকে বিয়ে করে তিনি হয়ে গেলেন রানী ভবশঙ্করী। তিনি চণ্ডী পুজো করতে ভালোবাসতেন। তাই রাজবাড়ির পাশে স্থাপিত হলো একটি চণ্ডী মন্দির৷ শুধু ভবানীপুরেই নয়, রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় বহু চণ্ডী মন্দির নির্মাণ করলেন তিনি।
রানী ভবশঙ্করী সামাজিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি জোর দিতে লাগলেন রাজ্যের নিরাপত্তার দিকে। তমলুক, আমতা, উলুবেড়িয়া, নস্করডাঙ্গা, খানাকুল ও ছাউনপুরে বিভিন্ন সামরিক দূর্গ নির্মাণ করেন। সাথে সাথে রাজ্যের যুবকদের সামরিক প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করা হয়।তিনিই প্রথম ভূরিশ্রেষ্ঠ রাজ্যে মহিলাদের সামরিক বাহিনীতে যুক্ত করেছিলেন। তিনি নিয়ম করে রাজ্যের প্রতিটি পরিবারকে সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে রাজ্যকে বহিরাগত শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করতে শক্তিশালী করে তুললেন।
রানী ভবশঙ্করী রাজ্যকে ক্ষমতাশালী করতে নৌবাহিনীও গড়ে তুললেন। এই সময়কালে মোগলদের লুটেরা বাহিনীরা চারিদিকে নানাভাবে অত্যাচার করতো। তখন গৌড়ের শাসক ছিলেন পাঠান বংশীয় সুলেমান কারী৷ যিনি ছিলেন এক অত্যাচারী শাসক। যাকে সিংহাসনচ্যুত করার জন্য রানী ভবশঙ্করী ওডিশার রাজা মুকুন্দদেবের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করেন। ১৫৬৫ সালে ত্রিবেণির যুদ্ধে ভূরিশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের রানী ভবশঙ্করী এবং মুকুন্দদেবের মিলিত সৈন্যদল সুলেমান কারীকে পরাস্ত করেন। এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মুকুন্দদেবের সেনাপতি রাজীবলোচন রায় যিনি কালাপাহাড় নামে পরিচিত ৷
সুলেমান কারীর মৃত্যুর পর গৌড়ের শাসক হলেন দাউদ খান। তিনি মোগলদের পরাস্ত করার জন্য রাজা রুদ্রনারায়ণের সাহায্য চান। কিন্তু রানী ভবশঙ্করী তা নাকচ করে দেন। আর এতেই চটে যান দাউদ খান। তিনি নিজের সেনাপতি কালটু খানকে নির্দেশ দেন রানী ভবশঙ্করীকে বিনাশ করার জন্য। কালটু খান দাউদ খানের আদেশমতো সৈন্য সমাবেশে ভূরিশ্রেষ্ঠ রাজ্য আক্রমণ করলেন। আবারো ভবশঙ্করীর ক্ষমতার কাছে হার মানতে হলো তাদের। ভবশঙ্করীর সামরিক বাহিনীর আঘাতে পাঠানরা পরাজিত হয়ে রাজ্য পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
রানী ভবশঙ্করীর বীরত্বের পরিচয় পেয়ে মোগলরা ভবশঙ্করীর সাথে যুদ্ধ করার কথা না ভেবে মোগল সুলতান আকবর ভবশঙ্করীকে রায়বাহাদুর সম্মানে ভূষিত করলেন। ইতিহাস মনে রেখেছে রানী ভবশঙ্করীকে। কিন্তু বাঙালি আজ ভুলতে বসেছে রানী ভবশঙ্করীকে।
Post a Comment