রামমোহন রায়ের স্বপ্ন সত্যি না হলেও সত্যি হয়েছে দ্বারকানাথের উপলব্ধি
১১ ই আশ্বিন, ১৪২৭, সোমবারঃ- প্রখ্যাত সাহিত্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা 'অপরাজেয় রামমোহন' নাটকের একটি অংশে দ্বারকানাথ ও রামমোহনের কথোপকথনে উঠে আসে রামমোহন রায়ের স্বপ্নের কথা ও দ্বারকানাথের রামমোহনকে নিয়ে ভবিষ্যৎ উপলব্ধির কথা। সেই নাটকের একটি অংশ তুলে ধরা হলো। বর্তমান যুগের সাপেক্ষে যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক এই কথোপকথনটি৷
দ্বারকানাথ- এইটিই তো আপনার পালিত পুত্র রাজারাম?
রামমোহন- হাঁ৷ সিভিলিয়ন ডিক সাহেব ওকে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন হরিদ্বারের মেলায়। বিলেত যাওয়ার সময় আর কার হাতে তুলে দেবেন- আমিই ভার নিলাম।
দ্বারকানাথ- শুনেছি, মুসলমানের ছেলে৷
রামমোহন- হয়তো। আর এই অপরাধে যাঁরা বাকি ছিলেন, তাঁরাও আমাকে ত্যাগ করেছেন৷ কিন্তু কে তাঁদের বোঝাবে, শিশুর কোনো জাত নেই, সে সব জাতের ঊর্ধ্বে! হাঁ- কী বলছিলে যেন? সেই দিল্লির বাদশার ব্যাপারটা তো? ওঁর কেসটা খুবই জেনুইন। অন্যায়ভাবে কোম্পানি ওঁকে পাওনা থেকে ঠকাচ্ছে। আমাকে দূত করে বিলেত পাঠাতে পারলে সুবিধে হবে আশা করছেন। আর আমার কথা তো জানোই৷ ওঁর কাজটা ছাড়াও প্রিভি- কাউন্সিলে সতী-বিল নিয়ে লড়তে হবে। আর ভালো করে জানতে হবে সভ্যতার তীর্থ ইউরোপকেও। সে আমার কতদিনের স্বপ্ন।
দ্বারকানাথ- ধর্মসভার দরখাস্ত নিয়ে বেথি সাহেব বিলেত রওনা হয়ে গেছে।
রামমোহন- যাক্। আমিও যাচ্ছি৷
দ্বারকানাথ- গণ্ডগোলটার কী হলো?
রামমোহন- কোম্পানির সঙ্গে কোনো Settlement সম্ভব নয়। তারা এখন দেশের মালিক, বাদশার দূতকে দূত বলেই মানে না। তাছাড়া দ্বিতীয় আকবর আমাকে যে 'রাজা' উপাধি দিতে চাইছেন, তা-ও তারা স্বীকার করে না।
দ্বারকানাথ- তবে তো মুশকিল হলো!
রামমোহন- (হাসলেন) মুশকিল কিছু নেই। চাল চালতে আমিও জানি। সাধারণ মানুষ হিসেবেই পাশপোর্ট জোগাড় করব আমি। তারপর ইংলন্ডের মাটিতে পা দিয়েই ঘোষণা করব, আমি শুধু রামমোহন নই- রাজা রামমোহন রায়। দিল্লীশ্বর দ্বিতীয় আকবরের মহামান্য রাজদূত।
দ্বারকানাথ- (মুগ্ধ কণ্ঠে) ইচ্ছে করলে আপনি সব পারেন দেখছি।
রামমোহন- (বিষণ্ণভাবে হাসলেন) সব পারি? না বন্ধু, কিছুই পারিনি। এত কাজ ছিল, এত সমস্যা ছিল। কতটুকু এগিয়েছি সে সব নিয়ে? যে মহাজাতি আমি গড়তে চেয়েছিলাম, সে সাধনা আমার কতটা সফল হল? আজও ধর্মভেদ- বর্ণভেদ। আজও অশিক্ষার অন্ধকার। আজও শাসন পরিষদে আমাদের Representation নেই, আজও আমরা জানতে শিখিনি 'India for Indians' দ্বারকানাথ, আমার সে Industrial India -র কল্পনা এখনো তো আকাশ-কুসুম৷ হল না- কিছুই হল না। অথচ জানি, জীবন বড় তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায়, শুরুতেই আসে শেষের পালা! যদি সেকালের ঋষিদের মতো আমি শক্তি পেতাম-
যদি হাজার হাজার বছর বাঁচতে পারতাম, East -এর সঙ্গে West -কে মিলিয়ে সেরা দেশ গড়ে দিয়ে যেতাম আমার ভারতবর্ষকে-!
দ্বারকানাথ- আপনার আদর্শ মিথ্যে হবে না। নতুন কাল আসছে, আপনার অসমাপ্ত সাধনা সে- যুগ মাথায় তুলে নেবে।
রামমোহন ভারতবর্ষকে সেরা দেশ গড়তে চাইলেও সেই স্বপ্ন আজ ব্যর্থ হয়ে গেছে। ভারত বহু জাতিক ও বহু ভাষাভাষীর দেশ। এ দেশে বর্তমানে হিন্দি সাম্রাজ্যবাদকে ভারতের সকল রাজ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে হরণ করা হচ্ছে অহিন্দি জাতিদের স্বাধীনতা। আমাদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। মাতৃভাষার অধিকার আমরা কোনো অহিন্দি জাতি পাচ্ছি না। ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার এক দেশ এক ভাষা নীতি আরোপ করে দেশের প্রতিটি রাজ্যে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিচ্ছে।
নতুন ভারত গড়ার থেকেও আমাদের কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো বাংলার সকল অংশগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে বাংলা ভাষার অধিকার অর্জন করা। সেইদিন নতুন ভারত তৈরি হবে যেদিন ভারতের প্রতিটি অহিন্দি রাজ্যগুলো নিজেদের ভাষার অধিকার পাবে। সময় অনুযায়ী সর্বদা চিন্তা বদলায়। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো না থাকলে এ দেশের উন্নতি হওয়া অসম্ভব। রামমোহন রায়ের স্বপ্ন সত্যি না হলেও দ্বারকানাথের উপলব্ধি সত্যি হয়েছে। রামমোহন রায়ের আদর্শ মিথ্যে হয়নি৷ গোটা দেশ রামমোহনকে মনে না রাখলেও আজও বাঙালি জাতি রামমোহনকে মাথায় করে রেখেছে। তাই বাঙালিকে ভারতের কথা এখন তেমন ভাবে না চিন্তা করে বাংলার বুকে নতুন করে নবজাগরণ ঘটানোর চিন্তা করতে হবে।
প্রতিবেদন- নিজস্ব সংবাদদাতা
Post a Comment