বাংলার 'আয়রন ম্যান', যিনি গোটা বাংলাকে চেনালেন যোগ ব্যায়াম
হলিউডের আয়রন ম্যানকে তো আপনারা সকলেই চেনেন কিন্তু বাংলার আয়রন ম্যানকে কী চেনেন? বাংলার আয়রন ম্যান কথাটা শুনে অনেকের চমকে যাওয়ার জোগাড়। না না চমকানোর কিছু নেই এটা সত্যি। যারা বলেন যে বাঙালিরা শক্তিশালী নয় বা বাঙালিদের বডি বিল্ডার নেই তাদেরকে বাংলার আয়রন ম্যানের কথা সবার প্রথমে জানতে হবে৷
তাঁর সারাটা জীবন ছিল রোমাঞ্চে ভরা। প্রথমে জীবনে তিনি ছিলেন একদম রোগা-পাতলা। শরীরে কোনো বল নেই। স্বভাবে একেবারেই দুর্বল। সামান্য খেলাধূলো করলে হাঁপিয়ে যান তিনি৷ দশ থেকে পনেরো মিনিট ছোটাছুটি করলেই তিনি ঝিমিয়ে পড়েন। একবার বাগমারির মল্লিক লজের মাঠে তাঁর দলের সাথে অন্য একটি দলের ফুটবল ম্যাচ হচ্ছিল। যে ম্যাচে তিনি ছিলেন ক্যাপ্টেন। এই ম্যাচে তাঁরা জিতে যান। ম্যাচ জেতার পর দুপক্ষের মধ্যে তর্কাতর্কি ও মারপিট শুরু হয়। তাঁর দল সবচেয়ে মার খায়। তাঁর দলের সকলে পালিয়ে যান। তিনি শেষমেশ একা হয়ে পড়লেন। প্রাণভয়ে তিনি আর্তনাদ করতে থাকেন। তাঁর আর্তনাদ এসে পৌঁছায় মাঠের পাশে থাকা কুস্তির আখড়াতে কুস্তিগিরদের কানে। তাঁকে যারা মারতে আসেন তাদের উচিৎ শিক্ষা দেন কুস্তিগিররা। আখড়ার ঋষি ঘোষ নামের এক কুস্তিগির তাঁর রোগা-পটকা চেহারা দেখে বললেন "এই রোগা পটকা শরীর নিয়ে ফুটবল খেলতে এসেছো? আগে শরীর মজবুত করো। ব্যায়াম করে কুস্তি করে শরীরটা তৈরি করো, তবে তো লড়তে পারবে৷ দুই খেলে দশ দেবে।"
কুস্তিগির ঋষি ঘোষের মুখে শোনা কথাটা মন্দ লাগেনি তাঁর। তিনি স্পষ্টতই বুঝতে পারলেন শরীর গঠনের প্রয়োজনীয়তা। শুরু হলো শরীর গঠনের জন্য চরমতর অনুশীলন। ধীরে ধীরে দুর্বল থেকে এক শক্তিশালী সিংহপুরুষ হতে শুরু করলেন তিনি। খুব শীঘ্রই হয়ে উঠলেন একজন পালোয়ান। রোগা-পটকা চেহারা থেকে তাঁর পালোয়ান হওয়া দেখে সেকেলের বাংলার লোকেরা আকাশ থেকে হামলে পড়তো। যারা রোগা হওয়া নিয়ে চিন্তা করেন তাদের এই ব্যক্তিটিকে বারংবার স্মরণ করা উচিৎ। আজকে যারা যোগ ব্যায়াম নিয়ে চর্চা করছে বা যোগ ব্যায়াম নিয়ে দেশজুড়ে যে প্রচার চলছে সেই প্রচারের আলোতে একবারও নিয়ে আসা হয়নি এই মানুষটির নাম। তিনি যোগ ব্যায়ামকে সুন্দর করে বিশ্বকে চেনানোর পরও ব্রাত্য তাঁর নাম। তিনি হলেন নীলমণি দাশ৷
সকলের অলক্ষ্যে একদিন হঠাৎ করেই শরীরচর্চার কাজ আরম্ভ করে দেন। তাঁর বাবার একজোড়া লোহার ডাম্বেল ছিল। তাই দিয়ে তাঁর বাবার কাছে ব্যায়াম করতে লাগলেন। তিনি সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় ক্যালকাটা অ্যাকাডেমির শরীর শিক্ষক সুবল বিশ্বাসের অধীনে কিছুদিন শরীরচর্চা করেন। এরপর তিনি সিমলা ব্যায়াম সমিতিতে ভর্তি হয়ে ব্যায়াম শিক্ষক ডাঃ নারায়ণচন্দ্র দাসের অধীনে ব্যায়াম শিক্ষা অর্জন করেন। সিমলা অনুশীলন সমিতিতে ব্যায়াম অনুশীলনের শিক্ষক হিসেবে ঋষি ঘোষ ও প্রকাশ ঘোষকে পান।
সিমলার অনুশীলন সমিতিতে থাকার সময় ডাঃ নিবারণচন্দ্র ঘোষের মাধ্যমে তিনি তাঁর গুরু মেজর ডাঃ ফণীন্দ্রকৃষ্ণ গুপ্তের সংস্পর্শে আসেন৷ প্রথম সাক্ষাতেই তিনি ফণীন্দ্রকৃষ্ণ গুপ্তকে নিজের গুরুর আসনে অধিষ্ঠিত করলেন। তিনি নীলমণি দাশকে শেখালেন যে শুধু ব্যায়াম করলেই মন সতেজ থাকে না। মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে বই পড়া খুব দরকার। তাই তিনি গুরুর কথামতো বিভিন্ন রকম বই পড়তে থাকেন৷ তাঁর গুরু তাঁকে বিভিন্ন বই দিতে থাকেন। এমনকি গ্রন্থাগারেও তাঁর বই পড়ার ব্যবস্থা করেন। তিনি অতিরিক্ত পড়াশোনা করার জন্য সপ্তম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। সপ্তম শ্রেণীতে প্রথম হওয়ার ফলে তাঁর স্কুলের প্রধান শিক্ষক পরাণ ভট্টাচার্য তাঁকে অর্ধ অবৈতনিক করে দেন।
ব্যায়ামের পাশাপাশি সাঁতার, মুষ্টিযুদ্ধ, লাঠিখেলা ও জিমন্যাস্টিক শিখে ফেললেন। বঙ্গীয় ব্যায়াম সমিতির প্রতিষ্ঠাতা বিপ্লবী পুলিনবিহারী দাস ও সিমলা ব্যায়াম সমিতির অমল বসু কাছে লাঠিখেলা শেখেন। হেদুয়ার সেন্ট্রাল সুইমিং ক্লাবে সাঁতার শেখেন। তিনি স্কুল অফ ফিজিক্যাল কালচারের প্রতিষ্ঠাতা জগৎকান্ত শীল ও কেমব্রিজ ব্লুর অশোক চ্যাটার্জির কাছে শেখেন মুষ্টিযুদ্ধ। বিখ্যাত ফুটবলার বলাই চ্যাটার্জির কাছে ফুটবল শিখলেন।
লেখাপড়া হোক বা খেলাধূলা সবেতেই স্কুলের শিক্ষকদের কাছে তিনি প্রিয় হয়ে ওঠেন। ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার সময় ক্যালকাটা অ্যাকাডেমির বেশিরভাগ শিক্ষক তাঁকে সাহায্য করতে থাকেন। এক প্রতিবেশিনী তাঁকে ম্যাট্রিক পরীক্ষার জন্য ঘর পর্যন্ত ছেড়ে দেয়। গৃহশিক্ষক নিবারণচন্দ্র তাঁকে অঙ্ক ও ইংরেজি পড়াতে থাকেন। ১৯৩০ সালে তিনি চারটে বিষয়ে লেটার নিয়ে ম্যাট্রিকে উত্তীর্ণ হন। শরীরচর্চা ও খেলাধূলো ছাড়াও তিনি এন.সি.সি, রেড ক্রশ ও সিভিল ডিফেন্সেও সাফল্যের সঙ্গে অংশ নিতে থাকেন।
তাঁর জন্ম নিয়ে সেকেলের অনেক পত্রিকা দ্বিমত তৈরি করলেও তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৯১১ সালের ৩ রা মার্চ অবিভক্ত বাংলার কলকাতায়৷ তাঁর আদি নিবাস ছিল হুগলীতে। ১৮৭৩ সালে তাঁর পিতামহ মতিলাল দাশ ম্যালেরিয়ার উপদ্রব থেকে বাঁচার জন্য কলকাতায় উঠে আসেন। ম্যাট্রিক পাস করার পর তিনি ভর্তি হন বঙ্গবাসী কলেজে। উচ্চশিক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর তাঁর খুব ইচ্ছে ছিল ডাক্তারি পড়বার কিন্তু তাঁর বাবার সেই সামর্থ্য না থাকার ফলে তিনি বি.এ তে ভর্তি হন। কলেজজীবন শেষ করে তিনি বাংলার বিভিন্ন জায়গাতে যুবকদের ব্যায়াম শেখাতে থাকেন। ক্যালকাটা অ্যাকাডেমিতে তিনি দশ টাকা মাইনেতে ব্যায়াম শিক্ষকের চাকরি করতে থাকেন৷ তারপর বঙ্গবাসী কলেজে পঁয়তাল্লিশ টাকা বেতনে ব্যায়াম শিক্ষকের চাকরি করতে থাকেন৷ পরবর্তীকালে রাজাবাজার বিজ্ঞান কলেজের পাশ্ববর্তী পার্শীবাগানে তিনি তাঁর বন্ধুদের নিয়ে 'শক্তি সমিতি' নামে একটি ব্যায়াম কেন্দ্র গড়ে তোলেন৷
১৯৩৫ সালে বিপ্লবী পুলিনবিহারী দাস তাঁকে বঙ্গীয় প্রাদেশিক হিন্দু মহাসভার সম্মেলনের এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে দেহ সৌষ্ঠবের খেলা দেখানোর জন্য আহ্বান জানালেন। পুলিনবাবুর সাথে তাঁকে যেতে হলো মালদা৷ বলদেবানন্দ গিরি মহারাজর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠান সূচিত হয়। পুলিনবিহারী দাসের নেতৃত্বে লাঠিখেলার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। তিনি খেলার মাঠে সৌষ্ঠব প্রদর্শন, বিম ব্যালেন্সিং ও লোহা বাঁকিয়ে দেওয়ার মতো দুঃসাহসিক শক্তি প্রদশর্ন করেন। সমগ্র অনুষ্ঠানের অবসানের পর বলদেবানন্দ গিরি মহারাজ তাঁকে 'আয়রন ম্যান' উপাধিতে ভূষিত করেন।
বলদেবানন্দ গিরি মহারাজ 'আয়রন ম্যান' উপাধি দেওয়ার কিছুদিন পর 'প্রবাসী' ও 'মডার্ন রিভিউ' পত্রিকাও তাঁকে 'আয়রনম্যান' উপাধিতে ভূষিত করে। শরীর ও স্বাস্থ্য নিয়ে প্রায় কুড়িখানা বই লিখলেন তিনি। তাঁর অনুপ্রেরণায় বাংলার ঘরে ঘরে শরীরচর্চার ঢেউ ওঠা শুরু হয়। তাঁকে নিয়ে হাজার হাজার কপির বই ছাপা হতে থাকে ও নিমেষে তা বিক্রিও হতে থাকে। চারিদিকে ঝুলতে থাকে তাঁর বানানো ব্যায়ামের চার্ট৷ প্রত্যেক বছর কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলাতে তাঁর যোগব্যায়ামের বই বিক্রি হয় পঁচাত্তর হাজারেরও বেশি। যোগব্যায়ামের বই কিনতে লম্বা লাইন পর্যন্ত লেগে যায়। তারপরও আর্মহাস্ট রোরের অনেকেই চেনেন না নীলমণি দাশকে। অথচ ইনিই প্রথম বাংলার ঘরে ঘরে যোগব্যায়াম পৌঁছে দিয়েছেন৷
মেয়েদের শরীরচর্চা প্রশিক্ষণেও অবদান ছিল তাঁর। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'দেবী চৌধুরানী' উপন্যাসটি তাঁকে নারীদের শারীরিক প্রশিক্ষণের জন্য অনুপ্রাণিত করে। 'ভারতবর্ষ' পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর এক নিবন্ধেও তিনি নারীদের শরীরচর্চার বিষয়টি তুলে ধরেন। তিনি নারীরা যাতে ব্যায়াম, কুস্তি শেখাতে বেশি বেশি করে জোর দেয় তার জন্যও সোচ্চার হন।
১৯৯১ সালে ৮০ বছর বয়সে তিনি পরলোক গমন করেন৷ তাঁর মৃত্যুর পর প্রিয় শিক্ষক সুবল বিশ্বাস তাঁকে স্মরণ করে লেখেন "১৯২৭ সালের শেষভাগে একটি ১৬ থেকে ১৭ বয়সের কালো রঙের সুশ্রী ও রোগা যুবক আমার নিকট আসিয়া প্রণাম করিয়া ব্যায়াম শিক্ষা করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিল। নীলমণির নিয়মনিষ্ঠা ও আগ্রহ দেখিয়া তাহার উপর মনোযোগ দিই। নীলমণি আমার প্রিয় ছাত্র ও শেষ ছাত্র। ও একজন প্রথম সারির ব্যায়ামবিদ।"
তথ্যসূত্র- বঙ্গদর্শন, সংসদ বাঙালি চরিতাবিধান
Post a Comment