বাঁশবেড়িয়ার হংসেশ্বরী মন্দির যার আড়ালে লুকিয়ে আছে বাংলার এক অজানা ইতিহাস
পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার বাঁশবেড়িয়া নামক স্থানে অবস্থিত হংসেশ্বরী কালীমন্দির হলো একটি বিখ্যাত কালী মন্দির। এই মন্দির এতটাই অনন্য এবং রাজকীয় যা আমাদের সবাইকে সম্পূর্ণ সম্মোহিত করে তোলে। এটি হলো কলকাতার নিকটস্থ অত্যন্ত জনপ্রিয় মন্দির।
১৯ শতকের প্রথম দিকে নির্মিত, এই মন্দির দেবী হংসেশ্বরী কে নিবেদন করা হয় যা দেবী কালীরই একটি রূপ। এই মন্দিরের স্থাপত্যটি সবদিক দিয়ে সত্যিই অসাধারণ, যা এই স্থানের প্রধান পর্যটন আকর্ষণ।
মুঘল আমলের দুর্গ- নগর বংশবাটী বাঁশবেড়িয়া কালের নিয়মে আজ হৃত গৌরব হলেও আমরা মূলত যে সময়ের কথা বলছি, সে সময় প্রসিদ্ধ জনপদ হিসাবে বংশবাটী বেশ খ্যাতি ছিল। প্রজাবৎসল হিসাবে খ্যাতি ছিল এখানকার রাজপরিবারেরও।
বাঁশবেড়িয়া রাজপরিবার দত্তরায়দের আদি নিবাস ছিল বর্ধমানের পাটুলি তে। পরিবারটি বরাবর মুঘল সম্রাটদের বিশ্বাস ভাজন কর্মচারী হিসেবে কাজ করে এসেছে এবং ফল স্বরূপ মুঘল সম্রাট আকবরের কাছ থেকে 'রায়' এবং তাঁর পুত্র জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে 'মজুমদার' উপাধি লাভ করে। সে যুগে বাংলায় মাত্র চারটি মজুমদার উপাধি যুক্ত পরিবার ছিল, যার মধ্যে পাটুলির দত্তরায় ছাড়া নদীয়ার কৃষ্ণনগর রাজপরিবারের পূর্বপুরুষ ভবানন্দের নাম উল্লেখযোগ্য।
পাটুলির দত্তরায় পরিবারের আদি পুরুষ রাঘব দত্ত রায় ১৬৫৬ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট শাহজাহানের কাছ থেকে তৎকালীন সাতগাঁও এর ( বর্তমান সপ্তগ্রাম ) ২১ টি পরগণার জমিদারির জায়গীর লাভ করেন। এর কিছুকাল পরে তাঁর পুত্র রামেশ্বর রায় পাটুলির পিতৃপুরুষের ভিটে ছেড়ে পাকাপাকিভাবে বংশবাটী তে চলে আসেন। তিনি বাংলার বিভিন্ন স্থান থেকে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, কায়স্থ, বৈদ্য ও অন্যান্য প্রায় ৩৬০ টি পরিবারকে নিয়ে এসে বংশবাটীতে বসতি স্থাপন করেন। সেই সঙ্গে তিনি বেশ কিছু পাঠান যোদ্ধাদের নিয়ে আসেন যাদের ওপর প্রতিরক্ষার দায়িত্ব ছিল। সেকালে বাংলার শাসনতন্ত্রে নানা রকম বিশৃঙ্খলা ছিল। দিল্লীতে ঠিকমতো রাজস্ব দেওয়ার ব্যাপারে বহু জমিদারেরই গাফিলতি ছিল। রামেশ্বর এই ব্যাপারটি নিয়ে দিল্লির সম্রাট আওরঙ্গজেবের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং সঠিক রাজস্ব ব্যবস্থা প্রণয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। ফলে সম্রাট ঔরঙ্গজেব খুশী হয়ে রামেশ্বরের পরিবারকে পঞ্জ-পর্চা খেলাৎ ও বংশানুক্রমিক "রাজা-মহাশয়" উপাধি প্রদান করেন।
রামেশ্বর রায় বাঁশবেড়িয়ার জমিদার থাকাকালীন গোটা বাংলা বর্গী ( মারাঠা ) আক্রমণে বিপর্যস্ত শ্মশানে পরিণত হয়। শোনা যায় মারাঠা শত্রুদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য রাজা রামেশ্বর একটি বাঁশবন পরিষ্কার করে এক মাইল জায়গাজুড়ে পরিখা বেষ্টিত এক দুর্গ বানিয়েছিলেন, যা থেকে এই অঞ্চলটির নাম হয় বাঁশবেড়িয়া। দুর্গটি লোকমুখে গড়বাটী নামে প্রসিদ্ধ। রামেশ্বরের বিশ্বস্ত পাঠান যোদ্ধারা এই দুর্গের প্রতিরক্ষার দায়িত্বে ছিলেন। এদের কোন কোন পরিবার এখনও বাঁশবেড়িয়া তেই বসবাস করেন। রামেশ্বর রায় বাঁশবেড়িয়ায় একটি টেরাকোটার কারুকার্য খচিত বিষ্ণু মন্দির নির্মাণ করান, যেটি অনন্ত বাসুদেব মন্দির নামে পরিচিত এবং হংসেশ্বরী মন্দিরের পূর্ব দিকে বর্তমানে রয়েছে।
রামেশ্বরের পুত্র রঘুদেব, রঘুদেবের পুত্র গোবিন্দ দেব, গোবিন্দ দেব আর হংসেশ্বরী দেবীর পুত্র নৃসিংহদেব। এই হংসেশ্বরী দেবীর নামেই বাঁশবেড়িয়ার হংসেশ্বরী মন্দির। নৃসিংহদেবই হংসেশ্বরী মন্দিরের প্রতিষ্ঠারম্ভ করেন।
গোবিন্দ দেব মারা যাবার তিন মাস পর জন্ম হয় নৃসিংহদেবের। গোবিন্দ দেব নিঃসন্তান অবস্থায় মারা গেছেন এই অজুহাতে তাঁর সমস্ত সম্পত্তি নবাব আলীবর্দী অন্য জমিদারদের বন্দোবস্ত করে দেন । রাজা নৃসিংহদেব সেজন্য শৈশবে খুবই আর্থিক দুরবস্থার মধ্যে পড়েন। পলাশীর যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পর বাংলায় 'কোম্পানি' র শাসন কায়েম হলে রাজা নৃসিংহদেব ওয়ারেন হেস্টিংস কে তাঁর পৈতৃক সম্পত্তি ফিরিয়ে দেওয়ার আবেদন করেন। হেস্টিংস নৃসিংহ দেব কে তাঁর পিতার সম্পত্তির ২৪ পরগণা ফিরিয়ে দেন। তারপর ১৭৫৯ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কর্নওয়ালিসের নিকট প্রার্থনা করে আরও তিনটি পরগণা লাভ করেন।
কিন্তু এই সময় তৎকালীন রাজা নৃসিংহদেব কাশী চলে যান এবং ১৭৯২ থেকে ১৭৯৯ সাল পর্যন্ত তিনি কাশীতে থেকে তন্ত্র চর্চা করেন ও 'উড্ডীশতন্ত্র' নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি কাশী থেকে ফিরে আসেন এবং জমিদারির মালিকানা উদ্ধারের পরিবর্তে তাঁর লন্ডন যাওয়ার উদ্দেশ্য জমানো অর্থ দিয়ে তন্ত্র মতে একটি মন্দির স্থাপনার কথা ভাবেন। প্রপিতামহের তৈরি অনন্ত বাসুদেব মন্দিরটির ক্ষয়প্রাপ্ত অবস্থা দেখে তিনি ঠিক করেন পোড়ামাটির মন্দির না বানিয়ে পাথরের মন্দির বানাবেন।
হংসেশ্বরী মন্দিরের অনুরূপ মন্দির বাংলায় আর নেই। এর স্থাপত্য অনবদ্য। তান্ত্রিক রাজা নৃসিংহদেব ১৮০২ খ্রীস্টাব্দে মন্দিরের নির্মাণ শুরু করেন। তাঁর অকাল প্রয়াণে মন্দির নির্মাণের কাজ সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। পরে তাঁর পত্নী রাণী শঙ্করী পুনরায় মন্দির নির্মাণ শুরু করেন এবং ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দে নির্মাণ শেষ করেন। খরচ হয়েছিল ৫ লক্ষ টাকা। মন্দিরের গায়ে লাগানো একটি ফলকে এই শ্লোকটি খোদাই করা আছেঃ
"শাকাব্দে রস-বহ্ণি-মৈত্রসনিতে শ্রীমন্দিরং মন্দিরং।
মোক্ষদ্বার চতুর্দ্দশেশ্বর সমং হংসেশ্বরী রাজিতং।।
ভূপালেন নৃসিংহদেব কৃতি নারব্ধং তদাজ্ঞানুগা।
তৎপত্নী গুরুপাদপদ্মনিরতা শ্রীশঙ্করী নির্মমে"।।
শকাব্দ ১৭৩৬ (অর্থাৎ, চতুর্দ্দশ মক্ষদ্বার রূপী ( চতুর্দশ ) শিবের সহিত হংসেশ্বরী কর্তৃক বিরাজিত গৃহ এই শ্রীমন্দির যাহা কৃতী নৃসিংহদেব ভূপাল কর্তৃক আরদ্ধ হয় তাহা ১৭৩৬ শকাব্দে তাঁহার আজ্ঞানুগা পত্নী গুরুপাদপদ্মনিরতা শ্রীশঙ্করী নিম্মান করিয়াছেন )।
ইম্পিরিয়াল গেজেটিয়ার প্রভৃতি সরকারি বহু পুস্তকে এই মন্দিরের উল্লেখ আছে। এটির স্থাপত্য পরিদর্শনের জন্য বহু শিল্পী বাঁশবেড়িয়ায় আসেন।
হংসেশ্বরী মন্দিরটি দক্ষিণমুখী, উচ্চতা ৭০ ফুট। এই মন্দিরটি বারানসীর স্থাপত্য শিল্পের আদর্শে নির্মিত। আর তেরোটি চূড়া বিশিষ্ট। সমগ্র মন্দিরটি ইঁট ও পাথর দিয়ে তৈরি। এর পাথর এসেছিল চুনার থেকে, আর কারিগরেরা এসেছিলেন জয়পুর থেকে। মন্দিরের চারিদিকে বারান্দা এবং মন্দিরের সামনে খোলা বাঁধানো প্রশস্ত চত্বর আছে। চূড়াগুলি পদ্মকোরকাকৃতি। গঠনপ্রণালীতে যৌগিক ষটচক্রভেদের রহস্য প্রকাশিত হয়েছে।
নরদেহে ষটচক্রভেদে ইড়া, পিঙ্গলা, বজ্রাক্ষ, সুষুম্না, ও চিত্রিনী নামে যে পাঁচটি নাড়ী আছে, সে রূপ এই মন্দিরে উহাদের প্রতীক, পাঁচটি তলা এবং হংসেশ্বরী স্বয়ং কুলকুন্ডলিনী রূপে অবস্থিতা। হংসেশ্বরী দেবীর মূর্তি নিমকাঠ দ্বারা প্রস্তুত। দেবীর বর্ণ নীল। পঞ্চমুন্ডির বেদির ওপর স্থাপিত সহস্রদল পদ্মের ওপর শবরূপে শায়িত শিবের নাভি থেকে ওঠা দীর্ঘ মৃনালসহ ফোটা পদ্মের ওপর দেবী হংসেশ্বরী বাঁ পা মুড়ে এবং ডান পা ঝুলিয়ে বসে আছেন। মন্দিরের বিভিন্ন কক্ষে শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত আছে। বর্তমানে মন্দিরটি ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ, কলকাতা মন্ডল দ্বারা সংরক্ষিত। মন্দিরের উপর তলে ওঠা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। লোকসংস্কৃতি গবেষক ও সমাজতান্ত্রিক বিনয় ঘোষ তাই এই মন্দির সম্পর্কে যথার্থই বলেছেন, "তান্ত্রিক যোগসাধনার প্রত্যক্ষ স্থাপত্যরূপ হল হংসেশ্বরী মন্দির"।
হংসোপনিষদ অনুসারে, "অহমিতি বীজম্। স ইতি শক্তিঃ। সোহহমিতি কীলকম্"। অর্থাৎ 'হং' বীজস্বরূপ, 'সঃ' শক্তি স্বরূপ, এবং 'সহং' কীলক বা উপায়। এই মন্ত্রের সাহায্যেই হৃদয়ের অষ্টদল পদ্মের মধ্যস্থিত হংসাত্মাকে দেখা যায়। বাঁশবেড়িয়ার হংসেশ্বরী মূর্তিতে এই ভাবনারই প্রত্যক্ষ রূপ লক্ষ্য করা যায।
দেবীর প্রধান বাৎসরিক পুজো হয় কার্তিক অমাবস্যায় দীপান্বিতা তিথিতে। বছরে ৩৬৪ দিন দেবীর শান্তমূর্তি, কিন্তু দীপান্বিতা অমাবস্যার একটি রাতের জন্য দেবীর এলোকেশী রূপ। সেদিন সন্ধ্যারতির পর দেবীর মুখে পরিয়ে দেওয়া হয় রূপোর মুখোশ ও সোনার জিভ। গায়ের বস্ত্র খুলে কেবল ফুল- অলংকার সজ্জিত রাজবেশ পরানো হয়। আর বছরের অন্যদিনগুলোতে দখিণা কালীকা মতে পুজো হলেও বছরের এই একটি দিন তান্ত্রিক মতে পুজো হয়।
মন্দিরটি খোলা থাকে সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২:৩০ মিঃ এবং বিকেল ৪টা থেকে ৬:৩০ মিঃ পর্যন্ত। মন্দিরে নিত্য পূজা ছাড়াও বিভিন্ন উৎসবে বিশেষ পূজা অনুষ্ঠিত হয়। অন্নভোগ প্রসাদের জন্য সকাল ১০ কার মধ্যে দক্ষিনার বিনিময়ে কুপন সংগ্ৰহ করতে হয়। আর অন্নভোগ বিতরণ শুরু হয় ১২:৪৫ মিঃথেকে।
এছাড়াও প্রতি অমাবস্যায় ও স্নানযাত্রার দিন দেবীর বিশেষ পুজো হয়। দেবীর নিত্য পুজো ও অন্নভোগের ব্যবস্থা আছে। প্রতি ১২ বছর বা একযুগ অন্তর দেবীর অঙ্গরাগ করা হয়। ১৮২০ সাল নাগাদ দেবীর অলংকার চুরি হয়ে যায়। পরবর্তীকালে মন্দিরটি আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার তত্ত্বাবধানে চলে এলেও দেবী মূর্তি, অলংকার ও মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব এখনোও পাশের রাজবাড়ীর সদস্যদের তত্ত্বাবধানে রয়েছে।
তথ্যসূত্রঃ- (১) জগজ্জননী হংসেশ্বর ; তপন চট্টোপাধ্যায়; সবিতা প্রকাশনী , বাঁশবেড়িয়া।
(২) তিন তীর্থে, শিবশঙ্কর ভারতী, সাহিত্যম, ১৮ বি, শ্যামাচরণ দে স্ট্রীট, কলকাতা ৭৩, প্রথম প্রকাশ ১৮ ই জানুয়ারি ২০০১।
(৩) The Bansberia Raj : Shumbhboo chunder Dey.
(৪) পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি : বিনয় ঘোষ।
(৫) পশ্চিমবঙ্গের পূজা-পার্বণ ও মেলা (২য় খন্ড) : অশোক মিত্র সম্পাদিত।
(৬) হুগলী জেলার পুরাকীর্তি : নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য।
(৭) হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ (২য় খন্ড ) : সুধীর কুমার মিত্র।
(৮) শাস্ত্র মূলক ভারতীয় শক্তি সাধনা : উপেন্দ্রকুমার দাস।
খুব সুন্দর প্রতিবেদন, ধন্যবাদ।।
ReplyDeleteখুব বিস্তারিত প্রতিবেদন।
ReplyDeleteখুব ই সুন্দর প্রতিবেদন
ReplyDelete