Header Ads

বুর্জ খলিফা, পেট্রোনাস টাওয়ারের মতো উচ্চতম বাড়িগুলি নির্মিত হয়েছে বাঙালি বিজ্ঞানী এফ আর খান আবিষ্কৃত টিউব স্ট্রাকচার টেকনোলজিতে


বিজ্ঞান থেকে সাহিত্য বা বীরত্বের কাহিনী বাঙালি কোনো ক্ষেত্রেই কোনো কালে পিছিয়ে থাকেনি। বলতে গেলে সারা বিশ্বকে পথ দেখিয়েছে বাঙালি। স্থাপত্য শিল্পেও বাঙালি অসাধ্য সাধন করেছে। রাজেন্দ্রনাথ মুখার্জীর নেতৃত্বে হাওড়া ব্রিজ, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল তৈরি হয়, বিদ্যাধর ভট্টাচার্যের স্থাপত্যবিদ্যায় ভারতের প্রথম পরিকল্পনামাফিক শহর জয়পুর তৈরি হয়। 


আমরা সিয়ার্স টাওয়ার, বুর্জ খলিফা, ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার, পেট্রোনাস টাওয়ারের মতো উচ্চতম বাড়ি গুলো বরাবরই সারা বিশ্বের কাছে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু এই বাড়িগুলি তৈরির পিছনে রয়েছে স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং। এই উন্নতির পিছনে রয়েছে দেশ বিদেশের ইঞ্জিনিয়ারদের ভূমিকা। আমরা অটো ক্যাড বা কম্পিউটার এইডেড ডিজাইন কথাটা প্রায়ই শুনে থাকি। এগুলো সব তৈরি হয়েছে বিশ্ববিখ্যাত স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য। কয়েক দশক আগেই বুর্জ খলিফার মতো উচ্চতম ভবন কল্পনাই করা যেত না। এই বিল্ডিংগুলি তৈরি করা যাচ্ছে টিউব স্ট্রাকচার টেকনোলজি আবিষ্কারের পর। বর্তমানে পৃথিবীর সব উচ্চতম বিল্ডিং এই টেকনোলজিতে তৈরি হয়।  ১৯৬০ এর পর থেকে তৈরি হওয়া পৃথিবীর ৪০ তালার বেশি প্রায় সব বাড়িই টিউব স্ট্রাকচার টেকনোলজিতে তৈরি। এই টেকনোলজি আবিষ্কার করেন বিশ্ববিখ্যাত স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার ফজলুর রহমান খান। যে কারণে ওনাকে টিউবিউলার ডিজাইনের জনক বলা হয়। এই আবিষ্কার স্থাপত্যশিল্পের জন্য ছিল একটি বিপ্লব যে কারণে এফ আর খানকে স্থাপত্যবিদ্যার আইনস্টাইন বলা হয়। ওনাকে বিংশ শতকের শ্রেষ্ঠ প্রকৌশলিও বলা হয়ে থাকে।

বর্তমানে পৃথিবীর উচ্চতম বিল্ডিং তৈরির ক্ষেত্রে এফ আর খানের এই পদ্ধতির তুলনা নেই। এক কথায় এই পদ্ধতি আবিষ্কার হওয়ার আগে বেশি উচ্চতার বাড়ি তৈরির কথা ভাবাই দুষ্কর ছিল। সি.এ.ডি (CAD ) তৈরির জন্যও তিনি ছিলেন পথপ্রদর্শক। বর্তমানে ক্যাড, অটোক্যাডের মতো সফটওয়্যার যা সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এবং স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর ক্ষেত্রে অপরিহার্য। 

তিনি চিকাগোতে অবস্থিত ১১০ তলা সিয়ার্স টাওয়ার যা বর্তমানে উইলস টাওয়ার নামে পরিচিত তার নকশা বানিয়েছিলেন, যা ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত ছিল পৃথিবীর উচ্চতম বিল্ডিং যার উচ্চতা ৫২৭ মিটার। এছাড়াও ৩৪৩ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট ১০০ তলা বাড়ি জন হ্যাঙ্কক টাওয়ারের নকশাও ছিল তাঁরই বানানো। ১৯৬৮ সালে জন হ্যাঙ্কক টাওয়ার ছিল পৃথিবীর দ্বিতীয় উচ্চতম বাড়ি।

ফজলুর রহমান খান ১৯২৯ সালের ৩ রা এপ্রিল অবিভক্ত বঙ্গের ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। আরমানিটোলা গর্ভমেন্ট হাই স্কুল থেকে তিনি ম্যাট্রিক পাশ করেন। তারপর তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হন। তারপর তিনি আমেরিকার ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিন বছরে একত্রে দুটি বিষয়ে স্নাতকোত্তর লাভ করেন স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং এবং থিয়োরিটিক্যাল এন্ড অ্যাপ্লায়েড ম্যাকানিক্সে। ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং তে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন।

তাঁর আবিষ্কৃত টিউব স্ট্রাকচার টেকনোলজি প্রথম ব্যবহৃত হয় চিকাগোতে অবস্থিত চেস্টনাট ডা-উইট অ্যাপার্টম্যান্ট বিল্ডিং তৈরিতে। তিনি স্থাপত্য নির্মাণের সাথে সাথে সামাজিক কাজেও বার বার যুক্ত থেকেছেন। রবীন্দ্র ভাবনায় তিনি বরাবরই আকৃষ্ট হয়েছেন বিদেশের মাটি থেকেও। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তিনি মোটা অঙ্কের অর্থ সাহায্য করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের। তিনি বহু দেশ থেকেই সন্মানসূচক নাগকরিকত্ব পেয়েছিলেন। 


এক্স-ব্রেসিং, ট্রাসড টিউব, ফ্রেমড টিউব, টিউব ইন টিউব, বান্ডেল্ড টিউব, কংক্রিট টিউব স্ট্রাকচার টেকনোলজিও ছিল ওনার আবিষ্কার। এফ আর খান আবিষ্কৃত ফ্রেমড টিউব টেকনোলজিতে তৈরি হয় নিউইয়র্কের ১১০ তলা টুইন টাওয়ার ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার, চিকাগোর ৮৩ তলা অ্যাওন টাওয়ার। এফ আর খান আবিষ্কৃত টিউব ইন টিউব টেকনোলজিতে নির্মিত হয় মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে অবস্থিত ৯৩ তলা টুইন টাওয়ার পেট্রোনাস টাওয়ার, ম্যানহাটনের ৫০ তলা দ্য ৭৮০ থার্ড অ্যাভিনিউ বিল্ডিং, টেক্সাসের ৫০ তলা ওয়ান শেল প্লাজা। এফ আর খান আবিষ্কৃত ট্রাসড টিউব টেকনোলজিতে নিউইয়র্কের ৫৯ তলা সিটিগ্রুপ টাওয়ার, হংকং এর ৭২ তলা ব্যাঁঙ্ক অফ চায়না টাওয়ার। এফ আর খান আবিষ্কৃত ফ্রেমড টিউব টেকনোলজিতে তৈরি হয় ১১০ তলা  চিকাগোর সিয়ার্স টাওয়ার, ৫৭ তলা চিকাগোর ওয়ান ম্যাগনিফিস্যান্ট মাইল। এফ আর খান আবিষ্কৃত কংক্রিট টিউব স্ট্রাকচার টেকনোলজিতে নির্মিত হয় ৬০ তলা চিকাগোর অন্টেরি টাওয়ার, নিউইয়র্কের ৫৮ তলা ট্রাম্প টাওয়ার। এছাড়াও স্টিল টিউব টেকনোলজিতে নির্মিত হয় রাশিয়ার ল্যাটিস টাওয়ার ইউ.এ.ই-র ওয়ারশ রেডিও মাস্টের মতো উচ্চতম রেডিও টাওয়ার। এফ আর খান আবিষ্কৃত ফ্রেমড টিউব টেকনোলজিতে নির্মিত হয় পৃথিবীর উচ্চতম বাড়ি ১৫৪ তলা বুর্জ খলিফা। তিনি ঢাকাতে ছড়িয়ে থাকা অঙ্কুরিত বাঁশ দেখেন এবং তিনি চিন্তা করেন  যে এরকম ভাবে তো উঁচু বাড়িও তৈরি করা যেতে পারে।

এক কথায় স্থাপত্যবিদ্যার নবজাগরণ ঘটান এফ.আর. খান। তিনি মাঝারি উচ্চতার বিল্ডিং এর জন্যও শিয়ার ওয়াল ফ্রেম ইন্টারেকশন সিস্টেম যা ৭০ তলা পর্যন্ত উচ্চতার বাড়ির ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়। এছাড়াও তিনি মার্ক ফিনটেলের সাথে ভূমিকম্প নিরোধক বাড়ি তৈরির জন্য শক অ্যাবজর্বিং সফ্ট স্টোরিস নামে একটি কনসেপ্ট আবিষ্কার করেন, যা ছিল বর্তমানের সিসমিক আইসোলেশন সিস্টেমের পূর্বসূরী। 

শুধু উচ্চতম বাড়িই নয় এছাড়াও ওনার নকশাতে তৈরি হয়েছে অ্যারিজোনার ম্যাকম্যাথ-পিয়ার্স সোলার টেলিস্কোপ, জেদ্দা ইন্টারন্যাশানাল এয়ারপোর্ট, সৌদি আরবের কিং আবদুল্লাজিজ বিশ্ববিদ্যালয়, আমেরিকার মিনেয়াপোলিশে অবস্থিত হাবার্ট এইচ. হামফ্রেই মেট্রোডোম ফুটবল স্টেডিয়াম। এফ.আর. খান হলেন পৃথিবীর একমাত্র ব্যক্তি যিনি পাঁচবার স্থাপত্য শিল্পে সবচেয়ে বেশি অবদানকারী ব্যক্তিত্ব হবার গৌরব অর্জন করেন। ১৯৭৩ সালে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল একাডেমি অফ ইঞ্জিনিয়ারিং এর সদস্য নির্বাচিত হন। ওনার ৮৮ তম জন্মদিনকে গুগল ডুডলের মাধ্যমে সন্মানিত করে। ইলিনয়ের নর্থ-ওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়, পেনসিলভানিয়ার লেহাই বিশ্ববিদ্যালয়, সুইস ফেডারেল ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি জুরিচ থেকে তিনি সান্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি আগা খান আর্কিটেকচার অ্যাওয়ার্ডের মতো পৃথিবীর প্রায় সব আর্কিটেকচারাল অ্যাওয়ার্ড জিতেছেন। ওনার নামে বিভিন্ন রকমের আন্তর্জাতিক স্তরের আর্কিটেকচারাল অ্যাওয়ার্ডও দেওয়া হয়ে থাকে বর্তমানে। ইন্টারন্যাশানাল অ্যাসোসিয়েশন ফর লাইফ সাইকেল সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং থেকেও ওনার নামে পুরষ্কার চালু করেছে। বারাক ওবামাও ওনার প্রশংসা করেছেন ২০০৯ সালে ওনার কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ের বক্তব্যে। সিয়ার্স টাওয়ারের পাশের ফ্রাঙ্কলিন সড়কের দক্ষিণ পার্শ্বের সংযোগস্থলটিকে নামকরণ করা হয়েছে ফজলুর আর. খান ওয়ে। ১৯৮২ সালের ২৬শে মার্চ জেদ্দায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন৷ মৃত্যুর পর তাঁর দেহ আমেরিকার শিকাগোর গ্রেসল্যান্ড সিমেন্ট্রিতে সমাহিত করা হয়। এক কথায় বলতে গেলে তিনি বাংলার গর্ব।



No comments