শ্রীলঙ্কা দখল করে রাজা হলেন বঙ্গসন্তান তবুও বাঙালি আত্মবিস্মৃতির খাতিরে সেই গৌরব মনে রাখেনি
প্রাচীন কাল হোক বা বর্তমান বাঙালির বিজয়রথের চাকা কোনোদিন থেমে থাকেনি। বাংলা সারা বিশ্বে তার ছাপ রেখেছে। যে আত্মবিস্মৃত জাতির অনেকেই আজ নিজেকে বাঙালি বলতে লজ্জা বোধ করেন, সেই হীনমন্য জাতির তার প্রাচীন ইতিহাস জানা উচিত।
বাংলার মানুষ এক কালে আরব, দক্ষিণ এশিয়া, আফ্রিকায় বাণিজ্য করেছে। ইউরোপীয়ানরা আফ্রিকা আবিষ্কারের যে গল্প শোনায় তার বহু আগে থেকে বাংলার মানুষ আফ্রিকার সাথে বাণিজ্যে লিপ্ত ছিল। ইংরেজ আসার পূর্বে বাংলার মসলিন, মেদিনীপুরের লবণ শিল্প সারা বিশ্বজোড়া খ্যাতি লাভ করেছিল। বাংলার ঢাকা, তাম্রলিপ্ত, হুগলি বন্দর ছিল বিশ্বের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ বাণিজ্য কেন্দ্র। উদাহরণস্বরূপ সুশীল চৌধুরী ওনার ‘ফ্রম প্রস্পারিটি টু ডিক্লাইন এইট্টিন্থ সেঞ্চুরি বেঙ্গল’ বইতে বাংলার বানিজ্য নিয়ে অসাধারণ সব তথ্য দিয়েছেন। ব্রিটিশ সময় থেকে স্বাধীন ভারত বাংলার রাজস্ব কিভাবে লুট হয়েছে সে নিয়েও আলোকপাত করেছেন বিখ্যাত গবেষক রণজিৎ রায় ‘অ্যাগোনি অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল’ বইতে। বিভিন্ন জায়গায় উল্লেখ করা হয় ভারত নাকি সোনার পাখি বাস্তবে ভারত সোনার পাখি কোনো কালেই ছিলনা বরং বাংলা সব সময় সোনার পাখি ছিল। বর্গীরা বার বার বাংলায় হানা দিয়েছে, দিল্লির সুলতানি আক্রমণ, ফরাসি, ব্রিটিশ, পর্তুগীজ, ডাচ, অস্ট্রিয়ান, ডানিশ উপনিবেশ সবই বাংলার মাটি লক্ষ্য করে হয়েছে।
বাঙালি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তকে সমৃদ্ধ করেছে সেটা কামরূপের চা বাগান তৈরি হোক বা শিবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে আফগানিস্থানে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীন সরকার তৈরি বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বেঙ্গল রেজিমেন্টের দুর্ধর্ষ যুদ্ধ, বাংলার মাটিতে ব্রিটেনের বিরুদ্ধে সতীশচন্দ্র সামন্তের নেতৃত্বে তৈরি তাম্রলিপ্ত স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠা বা জাপানে রাধাবিনোদ পালের ঐতিহাসিক কাজকর্ম বা নেতাজীর দুঃসাহসী যুদ্ধ এরকম বহু গৌরবের ইতিহাস রয়েছে বাঙালির।
এরকমই একটা ঐতিহাসিক ঘটনা হল তৎকালীন সময়ের রত্নদ্বীপ বা শ্রীলঙ্কায় এক বঙ্গসন্তানের রাজ্য স্থাপনও ছিল বাঙালির আর এক গৌরব। শ্রীলঙ্কায় রাজ্য স্থাপন করেছিলেন বিজয় সিংহ কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় সেই ইতিহাস নিয়ে বাঙালি গর্বিত হওয়া তো দূর কতজন জানেন সেটাই সন্দেহ। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ও সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ওনাদের কবিতায় বিজয় সিংহের বীরত্বকে স্থান দিয়েছেন কিন্তু বাঙালি আজও সেই গৌরব উপলব্ধি করতে পারেনি।
শ্রীলঙ্কার দুটি বিখ্যাত ঐতিহাসিক নথি 'মহা-বংশ' এবং 'দ্বীপ-বংশ' থেকে বিজয় সিংহ সম্পর্কে জানা যায়। তাছাড়া অজন্তা গুহাচিত্র এবং হিউএন সাং এর ভারত বৃত্তান্ত বা সিইউকি তেও এই ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। সুসিমা ছিলেন বাংলার অন্তর্গত একটি স্বাধীন প্রদেশের শক্তিশালী রাজকুমারী। তিনি তখনকার সময়ের স্বাধীনচেতা নারী ছিলেন তাই অসাধু সমালোচনার সন্মুখীন হয়ে ক্রোধে রাগে ও দুঃখে রাজ্য ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন অন্য বাসস্থানের সন্ধানে। তিনি যাত্রাপথে কয়েকজন ব্যবসায়ীর সাথে পরিচিত হন যারা মগধের উদ্দেশ্যে যাত্রা করছিল তিনি ঐ ব্যবসায়ীদের সাথে মগধের দিকে রওনা দেন। কিন্তু রাঢ় দেশে ওনাদেরকে আক্রমণ করেন এক ভয়ানক ডাকাত যিনি নিজেকে সিংহ নামে পরিচয় দিতেন। তখন সিংহ সুসিমাকে ধরে নিয়ে যান এবং জোর করে বিবাহ করেন এবং উনি এক পুত্র এবং এক কন্যার জন্ম দেন। কন্যার নাম ছিল সিংহসিবলী এবং পুত্র নাম ছিল সিংহবাহু।
একদিন সুসিমা তাঁর ছেলে মেয়েকে নিয়ে দৌড়ে আবার নিজের রাজ্যে ফিরে যান। কিন্তু ততদিনে তাঁর বাবা বঙ্গেশ্বর মারা গেছেন ফলে বঙ্গেশ্বরের এক ভাইপো তখন বাংলার রাজা হলেন। সুসিমা তাঁকে বিয়ে করে বাংলার রানি হলেন। সিংহও তখন সুসিমার খোঁজে বাংলায় উপস্থিত হন তখন সুসিমার ছেলে ছেলে সিংহবাহু ওনাকে হত্যা করে রাঢ় দখল করেন। অর্থাৎ সিংহকে মরতে হয় নিজের ছেলের হাতেই। তারপর সিংহবাহু নিজের বোন সিংহসিবলীকে বিয়ে করেন। সিংহবাহুর ৩২ জন সন্তান জন্মায় তার মধ্যে সবচেয়ে বড় ছিলেন বিজয় সিংহ। বিজয় সিংহ ছিলেন বেশ বদমেজাজী চরিত্রের তিনি নিজের সঙ্গীসাথিদের নিয়ে সাধারণ মানুষকে অত্যাচার করতেন ফলে বিরক্ত হয়ে সিংহবাহু বিজয় সিংহ ও বিজয় সিংহের অনুগামীদের রাজ্য ছাড়া করেন।
তখন বিজয় সিংহ তিনটি জাহাজ নিয়ে মেদিনীপুরের তাম্রলিপ্ত বন্দর থেকে সমুদ্র যাত্রা করেন। প্রথম জাহাজে ছিলেন সব পুরুষগণ, দ্বিতীয় জাহাজে ছিলেন সেই পুরুষদের পত্নীগণ এবং তৃতীয় জাহাজে ছিলেন তাদের সন্তানরা। সমুদ্রে ঝড় ওঠায় তিনটি জাহাজেরই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ফলে তিনটি জাহাজ তিনটি আলাদা আলাদা জায়গায় নোঙর করে। বিজয় সিংহের জাহাজ নোঙর করে সুপুরা বা সুপ্পুরকা দ্বীপে। ঐ দ্বীপের মানুষেরা অতিথি পরায়ণ থাকায় ওনাদের ওখানে থাকতে কোনো সমস্যাই হয়নি। যদিও এখানেও এরা সাধারণ মানুষদের অত্যাচার শুরু করে, কথায় আছে না ‘স্বভাব দূরতিক্রম’ ফলে এখান থেকেও তাদের বিতাড়িত হতে হয়। তারপর ওনারা আবার জাহাজে দক্ষিণ দিকে যাত্রা করেন এবং ওনারা তাম্রপর্নী বা লঙ্কাদ্বীপে ওঠেন। সেখানে তখন রাজত্ব করছেন যক্ষরাজ মহাকালসেনা। বিজয় সিংহের এই দ্বীপে আগমণই কাল হল যক্ষরাজের জন্য। যক্ষরাজ প্রথম থেকেই বিজয় সিংহের আগমণকে সমস্যা রূপেই মনে করেছিলেন।
যক্ষরাজের মেয়ে কুবেণী বিজয় সিংহের প্রেমে পড়ে যান এবং এটাকেই সুযোগ হিসেবে নেন বিজয় সিংহ। কুবেণীর সাহায্য নিয়ে যক্ষরাজকে হত্যা করে বিজয় সিংহ লঙ্কাদ্বীপের রাজা হন। বিজয় সিংহ লঙ্কাদ্বীপের নাম পরিবর্তন করে নিজেদের বংশের নামে সিংহল করে দেন। এভাবেই শ্রীলঙ্কার রাজা হন বঙ্গসন্তান বিজয় সিংহ। উনি প্রায় ৪০ বছর রাজত্ব করেন এবং ওনার বংশধররা আরো ছশো বছর রাজত্ব করেন।
তথ্যসূত্র- বৃহৎ বঙ্গ, দীনেশচন্দ্র সেন; বঙ্গদর্শন; প্রাচীন বাংলার গৌরব, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী; গেট বেঙ্গল।
Post a Comment