শান্তিপুরের বীর বাঙালি লাঠিয়াল লাঠি না পেয়ে ঢেঁকি নিয়ে তাড়া করেছিলেন ডাকাতদের
বাঙালিদের বীরত্বের কাহিনী ছড়িয়ে আছে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরেও। এক কালে লাঠিখেলা, দড়ি টানাটানি, কুস্তির আসর এসব বসতো সারা বাংলা জুড়ে। স্বাধীনতা যুদ্ধে অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর দল, বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স এসব গুপ্ত সমিতি গুলিতে এই ধরণের লাঠিখেলা, কুস্তির রেওয়াজ হত প্রতিদিন। এই সমিতিগুলো ও বাংলার ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী ডাকাত দলগুলো ইংরেজদের ভয় ধরিয়ে দিত। গোবর গুহ, পরেশলাল রায় এ ধরণের বহু মানুষ বাঙালির কুস্তিখেলাকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিয়েছিলেন।
তখনের সারা বাংলায় এরকম বলবাণ লোকের অভাব ছিলনা। শান্তিপুরের বীর আশানন্দ মুখোপাধ্যায় ছিলেন এরকমই একজন বিখ্যাত লাঠিয়াল। আশানন্দ মুখোপাধ্যায় জন্মগ্রহণ করেন ১৭৪৫ খ্রিস্টাব্দে শান্তিপুরে। দুর্গাচরণ রায় তাঁর 'দেবগণের মর্ত্তে আগমণ' গ্রন্থে লিখেছেন- 'আশানন্দ কি বলবান পুরুষই ছিল! আমার বোধ হয়, সে রীতিমত যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষা করিতে পারিলে কলির ভীম হইতে পারিত'।
আশানন্দ মুখোপাধ্যায়ের বহু বীরত্বের কাহিনী এখনও জীবিত আছে নদীয়ার কিছু জায়গায়। ওনার বীরত্বের কাহিনীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত জনশ্রুতি হল ঢেঁকির কাহিনী। আশানন্দ মুখোপাধ্যায় একদিন একজন ধনী মানুষের বাড়িতে রাত্রিযাপন করেছিলেন। সেই রাত্রে এই বাড়িতে ডাকাতরা আক্রমণ করেন তখন ডাকাতদের সাথে লড়াই করেন আশানন্দ। তিনি তখন হাতের কাছে কিছু না পেয়ে ঢেঁকিশালের ঢেঁকিটিকে ওনার শক্তিশালী দু’হাতে করে উঠিয়ে ডাকাতদের দিকে তেড়ে যান এবং ডাকাত আক্রমণ প্রতিহত করেন। সেই ঘটনার পর থেকেই তিনি আশানন্দ ঢেঁকি নামে পরিচিত হয়ে পড়েন।
শান্তিপুর স্টেশনের অনতিদূরেই পটেশ্বরী পাড়ার কাছেই আশানন্দের বাড়ি এখনও বর্তমান। ১৩৩৯ সালে আশানন্দের বাড়ির কাছে একটি আশানন্দ স্মৃতি স্তম্ভ নির্মিত হয়। আশানন্দের পূর্বপুরুষরা প্রায় পাঁচশত বছর আগে ওনার বাসভবনের পাশেই শ্রীশ্রী রাধাবল্লভ জিউ মন্দির স্থাপন করেন। আশানন্দের পরিবারের কেউ জীবিত না থাকায় গ্রামবাসীরা নিজেদের উদ্যোগে ১৯৩৩ সাল থেকে একটি ট্রাস্টি বোর্ড গঠনের মাধ্যমে মন্দির পরিচালনার ভার নিজেদের হাতে তুলে নেন। প্রতি বছর রাসপূর্ণিমায় এখানে জাঁকজমক ভাবে রাস উৎসব পালিত হয়। রাস উপলক্ষে এখনও আশানন্দ পল্লীর শোভাযাত্রা বের হয় তাতে বড় আকারের পটচিত্রে আশানন্দকে তুলে ধরা হয়।
একবার ত্রিবেণী ৩৭৩ থেকে বৃন্দাবণ চন্দ্রের কয়েক শত টাকা নিয়ে তিনি গুপ্তিপাড়ায় ফিরছিলেন। ফেরার পথে তিনি একটি দিঘির পাশে বসে আহার করছিলেন তখন দুজন লাঠিয়ালকে তিনি দেখেন তার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। ঐ দুজন লাঠিয়ালকে তিনি জানতে চাইলেন ওনারা কেন তাঁর পাশে দাড়িয়ে। তখন ওনারা বলেন "ডুমুরদহে কিসের ভয়, তাহ কি তুমি জান না ?"
যা শুনে কোনোরকম বিড়ম্বনা ছাড়াই তিনি বলেন "জানি, দাড়া—এই কয়টা খেয়ে নিই।"
আহার শেষে যখন তিনি দিঘির জলে হাত ধুঁয়ে নিয়ে ঐ দুই লাঠিয়ালকে কূপকাত করলেন। তিনি দুজনকে দুই হাতে করে টিপে ধরে দুই হাতের বগলের মধ্যে নিয়ে ওনাদের দুজনকে নিয়েই গুপ্তিপাড়ায় ওনার শ্বশুরের কাছে পৌঁছান এবং বলেন "কি দুটা জন্তু ধরিয়া আনিয়াছি—প্রদীপ আনিয়া দেখুন।"
তখন ঐ দুই লাঠিয়াল প্রায় আধমরা হয়ে গেছে। তারপর চোখে মুখে জল দিয়ে ওনাদের জ্ঞান ফিরলে আশানন্দ তাদের ছেড়ে দেয়।
বাংলার প্রান্তে প্রান্তেই এরকম বীরদের খোঁজ মেলে। যেমন পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতার কান্তোড় গ্রামেও এরকম একজন বীর ছিলেন গোরাচাঁদ হাতি নামে। উনি খড়গপুরের ইংরেজদের সার্কাস দেখে হেঁসে ফেলেছিলেন এবং বলেছিলেন এগুলো খেলা দেখানো হচ্ছে! তারপর সবাই ভাবছিল কোথাকার একটা পাগলা। তারপরই তিনি স্টেজে গিয়ে খেলা দেখান যা দেখে সবাই বিস্মৃত হন। গোরাচাঁদ হাতির এরকম বহু ঘটনা ঘটিয়েছিলেন কিন্তু এই ইতিহাস বিস্মৃতির আড়ালে রয়ে গেছে। আমরা লিটারেসি প্যারাডাইসে এই তথ্য প্রথমবার মানুষের কাছে তুলে ধরলাম। ওনার ঘটনাগুলো মানুষের কাছ থেকে সংগ্রহ করে আমাদের পোর্টালেই তুলে ধরে সংরক্ষণের চেষ্টা করবো।
তথ্যসূত্র- দেবগণের মর্ত্ত্যে আগমন, দুর্গাচরণ রায়; টেম্পেলস অফ বেঙ্গল ব্লগ, অস্ত্রচর্চা: পুলিন বিহারী দাশ রচনা সংগ্রহ (প্রথম সংস্করণ)
Post a Comment