শতবর্ষ পেরিয়ে বাঙালি জীবনে আজও বিদ্যমান বাংলার নস্টালজিক স্বদেশী 'ডাকব্যাক'
'ডাকব্যাক' নামটা বড়োই নস্টালজিক। কেননা, একটা সময়ও তো বটেই এমনকি এখনও আমরা ওয়াটারপ্রুফ বলতে 'ডাকব্যাক'-কেই বুঝি। নস্টালজিক হওয়ার এই একটা কারণ বোধহয় নয়। এই ডাকব্যাক মার্কা ওয়াটারপ্রুফ ওয়ার্কস-এর প্রতিষ্ঠাতা একজন বাঙালি যে! যাঁর নাম সুরেন্দ্রমোহন বসু। পরাধীন ভারতে তাঁর হাত ধরেই জন্ম নিয়েছিল বিশ্ববিখ্যাত সংস্থা বেঙ্গল ওয়াটার প্রুফ লিমিটেড। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের বেঙ্গল কেমিক্যালস এণ্ড ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড এবং গৌড়মোহন দত্তের প্রতিষ্ঠিত জি ডি ফার্মাসিউটিক্যালস প্রাইভেট লিমিটেড ইত্যাদি স্বনামধন্য সংস্থার মতো এই প্রতিষ্ঠানও বাঙালি তথা দেশের মানুষকে স্বনির্ভরতার পাঠ শিখিয়ে গেছে। এবার আমরা জেনে নেব সুরেন্দ্রমোহন বসুর সম্পর্কে।
সুরেন্দ্রমোহন বসু বর্তমান বাংলাদেশের ঢাকা জেলার বামনতিতা গ্রামে এই সেপ্টেম্বর মাসের ২ তারিখে ১৮৮২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মহিনীমোহন বসু, যিনি একজন প্রধান শিক্ষক ছিলেন। সুরেন্দ্রমোহন স্বদেশী যুগের চিন্তাধারায় বিশেষ ভাবে অনুপ্রাণিত ছিলেন। তখনকার দিনে বিহারও ছিল বৃহৎ বাংলার অংশ। তাঁর স্কুলজীবন কেটেছে গয়া ও ভাগলপুরে। বর্তমান বিহারের গয়া জেলা স্কুল থেকে সুরেন্দ্রমোহন প্রবেশিকা পাশ করেন তারপর ভাগলপুর টি.এন. জুবিলি কলেজ থেকে এফ.এ. পাশ করেন। এফ.এ. পাশ করে তিনি ঢাকা কলেজে বি.এস.সি. ক্লাসে ভর্তি হন। বি.এস.সি. পড়ার সময় বিদেশ থেকে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানলাভ করে তা স্বদেশসেবার কাজে লাগানো ছিল তাঁর অন্যতম বৈপ্লবিক কার্যক্রম। আর এই উদ্দেশ্যেই ১৯০৫ সালে যোগীন্দ্রচন্দ্র ঘোষ স্কলারশিপ পাওয়া মাত্রই জাপানে যান বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান আহরণ করার জন্য। জাপানে তিনি দেড় বছর হাতে-কলমে রঞ্জন শিল্প ও কাপড় ছাপানোর কাজ শিখলেন। জাপানের পর তিনি গিয়েছিলেন আমেরিকায়। সেখানে তিনি স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিল্প রসায়ন বা ইন্ডাস্ট্রিয়াল কেমিস্ট্রি বিষয়ে বি.এ. ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফলিত রসায়নে এম.এস.সি. ডিগ্রি লাভ করেন।
যখন তিনি আমেরিকায় পাঠরত, তখন ১৯১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত 'হিন্দুস্তান স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন'- এর প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন। সেই অ্যাসোসিয়েশনে তিনি ভারতের স্বাধীনতা বিষয়ক বক্তৃতা দিতেন। এর ফলে তিনি স্বদেশে ফিরে আসার পর ইংরেজ সরকার তাঁকে গ্রেপ্তার করতে উঠে পড়ে লাগে। যখন তিনি করদ রাজ্যে রেওয়া স্টেটের শিল্পোন্নয়নের কাজে নিযুক্ত ছিলেন তখন ইংরেজ সরকার তাঁকে ডিফেন্স অফ ইন্ডিয়া অ্যাক্টে গ্রেপ্তার করে যুক্ত প্রদেশ (বর্তমান উত্তর প্রদেশ ও উত্তরাখণ্ড)-এর হামিরপুরে বন্দী করে নিয়ে আনে। বন্দী অবস্থাতেই তিনি জানতে পেরেছিলেন দুর্গম অঞ্চলে কিভাবে ভারতীয় সৈন্যদের উপযুক্ত গামবুট, বর্ষাতি ও গ্রাউন্ডশিট ছাড়াই লড়াই করতে হয়। তাই, সেই অন্তরীণ অবস্থায় তিনি নিজের প্রচেষ্টায় ছোটখাটো একটি ল্যাবরেটরির মতো সমস্ত সরঞ্জাম জোগাড় করেন। তিনি তাঁর ফলিত রসায়নের সমস্ত জ্ঞান কাজে লাগিয়ে ওয়াটারপ্রুফ কাপড় ও ক্যানভাস তৈরির গবেষণার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার কিছু পরে তিনি জেল থেকে ছাড়া পান এবং ছাড়া পেয়ে বাংলায় ফিরে আসেন। ১৯২০ সালে তিনি তাঁর ভাই- অজিতমোহন, যোগেন্দ্রমোহন ও বিষ্ণুপদ বসুর সহায়তায় প্রথমে কলকাতার নজর আলি লেনের বাসভবনেই প্রতিষ্ঠা করেন 'বেঙ্গল ওয়াটারপ্রুফ ওয়ার্কস'–যা এদেশের প্রথম ওয়াটারপ্রুফ কারখানা। ব্রিটিশ আমলে, অন্যান্য পণ্যের মতো টেক্সটাইল ও ওয়াটারপ্রুফ আমদানি করতে হত। স্বভাবতই, এইসব জিনিসপত্রের দাম অনেক বেশি ছিল। যার ফলে সাধারণ মানুষ তেমন কিনতে পেত না। আর সেই কারণেই সুরেন্দ্রমোহন বসুর হাত ধরে আসে 'ডাকব্যাক'। এই 'ডাকব্যাক' কথাটা আসে 'Like water off a duck's back' ইংরেজি বাগধারা থেকে। এই বাগধারাটির অর্থ 'কারুর উপর প্রভাবহীন'। স্থায়িত্বের জন্যে এই কারখানার চিরাচরিত ইউএসপি ছিল 'ডাকব্যাক'–যা আজও মানুষের মনে স্থান করে রয়েছে।
আর এভাবেই সহজলভ্য অথচ উচ্চমানের ওয়াটার প্রুফ ডাকব্যাকের যাত্রা শুরু হল। আর তাই প্রথম থেকেই ডাকব্যাক বাজারে বেশ খ্যাতিলাভ করে। ১৯৪০ সালে ডাকব্যাকের এই কারখানার নতুন নামকরণ হয় 'বেঙ্গল ওয়াটার প্রুফ লিমিটেড'।
ওয়াটারপ্রুফ স্কুলব্যাগ, আইস ব্যাগ, গামবুট, এয়ার পিলো – সবই এই কারখানা তৈরি করে এসেছে। সেনাদের প্রতি দরদ সুরেন্দ্রমোহনের ছিল আর তাই তাঁদের জন্য ওয়াটারপ্রুফ হিসেবে স্নো অ্যানকেল বুট, লাইফ জ্যাকেট এমনকি সাব মেরিন এস্কেপ স্যুটও এই কারখানা তৈরি করে এসেছে। এইসব ওয়াটারপ্রুফ জিনিসের জন্য এই কারখানা বিখ্যাত।
এই বছর এই করোনাকালে শত বৎসর পার করল এই কারখানা। ডাকব্যাক ওয়াটারপ্রুফের যে চারাটি সুরেন্দ্রমোহন তাঁর কলকাতার বাড়িতে তা আজ ফলে-ফুলে পল্লবীত হয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তার শাখা-বিস্তার লাভ করেছে। আজও ওয়াটারপ্রুফ মানেই যে 'ডাকব্যাক'!
Post a Comment