বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে পৃথিবী থেকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক পরিবর্তনশীল নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করেছেন এক বাঙালি বিজ্ঞানী
বাঙালি বিজ্ঞান চর্চায় কোনোদিন-ই পিছিয়ে থাকেনি। বাঙালির নিজের সম্পর্কে না জানার আগ্রহের কারণে বাঙালিদের হাজার সংখ্যক বিজ্ঞানী থাকা সত্বেও কেউ কেউ দাবী করছেন যে বাংলায় নাকি বিজ্ঞান চর্চা হয়না। মাকড়সা বিজ্ঞানী বিনয় কৃষ্ণ টিকাদার, ডাইনোসর বিজ্ঞানী শঙ্কর চ্যাটার্জী, পক্ষী বিজ্ঞানী বিশ্বময় বিশ্বাস, মহাকাশ বিজ্ঞানী রাধাগোবিন্দ চন্দ্র, জগদানন্দ রায়, পরিসংখ্যানবিদ চঞ্চল কুমার মজুমদার, পরমাণু বিজ্ঞানী চৈতন্যময় গাঙ্গুলি, শেখর বসু, চিকিৎসা বিজ্ঞানী সহায় রাম বসু এরকম কয়েকশো বিজ্ঞানীকে আমরা জানিনা। এ নিয়ে আমাদের প্রজন্মকে দায়িত্ব নিতে হবে যাতে এই কাজ গুলো তুলে ধরা যায়। বাংলায় বিজ্ঞান চর্চা হচ্ছেনা এই ভ্রান্ত ধারণাটা যাতে কাটানো যায় তার জন্যই ধারাবাহিক ভাবে লেখা নিয়ে আসছি আমরা।
আজ যার কথা বলবো তিনি হলেন বিশ্ববিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী রাধাগোবিন্দ চন্দ্র। পৃথিবীতে মোট ২৫ জন বিজ্ঞানী রয়েছেন যারা ১০,০০০ এর বেশি পরিবর্তনশীল নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করেছেন, বিজ্ঞানী রাধাগোবিন্দ চন্দ্র হলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। তিনি যতসংখ্যক নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করেছেন ওনার ধারে পাশেও কেউ পৌঁছাতে পারেননি এখনও পর্যন্ত। তিনি মোট ৪৯৭০০ টি বিভিন্ন ধরণের নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করেন যা এক প্রকার বিস্ময়। ১৯১৯ থেকে ১৯৫৪ পর্যন্ত তিনি মোট ৩৭২০০ টি পরিবর্তনশীল নক্ষত্র বা ভ্যারিয়েবল স্টার পর্যবেক্ষণ করেন এবং এই সব তথ্য তিনি অ্যামেরিকান অ্যাশোসিয়েসন অফ ভ্যারিয়েবল স্টার অবজারভেশনকে (AAVSO) প্রদান করেছেন। AAVSO বিগত ১০০ বছরে ২ কোটি নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করেছে এবং প্রতি বছর সারা বিশ্বের ২০০০ সদস্য ১ লক্ষ পরিবর্তনশীল নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করেন যেখানে তিনি একাই সারা জীবনে প্রায় ৫০,০০০ তারা পর্যবেক্ষণ করেছেন। AAVSO থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ইতালির জিওভানি বি লাসিনি ৫৮০০০ পরিবর্তনশীল তারা পর্যবেক্ষণ করেছেন। অর্থাৎ রাধাগোবিন্দ চন্দ্র দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক পরিবর্তনশীল নক্ষত্র পর্যব্ক্ষণ করেছেন।
১৯১৮ সাল থেকে ১৯৫৪ পর্যন্ত তিনি একের পর এক অসাধ্য সাধন করেছেন। ১৯১৮ সালের ৭ ই জুন তিনি একটি নক্ষত্র আবিষ্কার করেন যা নক্ষত্রের মানচিত্রে যুক্ত ছিলনা। এই পর্যবেক্ষণের ব্যাপারে তিনি জানান হার্ভার্ড মানমন্দিরকে এবং তিনি নোভা অ্যাকুইলা ৩ নক্ষত্রের আবিষ্কারকের সন্মান তিনি পান। এই আবিষ্কারের ফলে তিনি অ্যামেরিকান অ্যাশোসিয়েসন অফ ভ্যারিয়েবল স্টার অবজারভেশনকে (AAVSO) এর সদস্যপদ পান। ১৯২৬ সালে তাঁর পর্যবেক্ষণের সুবিধার্থে হার্ভার্ড মানমন্দির একটি ৬ ইঞ্চি টেলিস্কোপ পান। এই টেলিস্কোপের সাথে হার্ভার্ড মানমন্দিরের পরিচালক হ্যারলি শ্যাপলি একটি চিঠিতে ওনার এই কাজের প্রচুর প্রশংসা করেন। বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডওয়ার্ড পিকারিং রাধাগোবিন্দ চন্দ্রের রিপোর্ট পড়ে চমৎকৃত হন এবং ওনাকে বেশ কিছু জ্যোতির্বিজ্ঞানের বই প্রদান করেন যেগুলো কেনার মতো আর্থিক অবস্থা ছিলনা রাধাগোবিন্দ চন্দ্রের।
তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৮৭৮ সালের ১৬ই জুলাই অবিভক্ত বাংলার যশোরের বকচর গ্রামে। তিনি বকচরের পাঠশালায় পড়ার পর যশোর জেলা স্কুলে ভর্তি হন। তিনি ছোটোবেলা থেকেই পড়াশোনার প্রতি অমনোযোগী ছিলেন যে কারণে তিনবার তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হন। বার বার অনুত্তীর্ণ হওয়ার ফলে তিনি পড়াশোনা ছেড়ে দেন। তিনি ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময় পাঠ্যবইতে বিখ্যাত বাঙালি বিজ্ঞান লেখক অক্ষয়কুমার দত্তের লেখা প্রবন্ধ "ব্রহ্মাণ্ড কি প্রকাণ্ড" পড়েন তারপর থেকেই তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানী হবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। তিনি দশ বছর বয়স থেকে নক্ষত্র দেখতে শুরু করেন এবং ১৪ বছর বয়সেই নক্ষত্র পর্যবেক্ষণের কাজটি রপ্ত করে ফেলেন। যশোরের উকিল কালীনাথ মুখোপাধ্যায় নক্ষত্র চেনার কাজে অনেক সাহায্য করেছিলেন।
পড়াশোনা শেষ করার পর তিনি প্রায় দুই বছর কর্মহীন হয়ে পড়েন। এরপর যশোরের কালেক্টরেটে খাজাঞ্চির কাজ শুরু করেন। স্কুলশিক্ষার পর কোনোরকম পড়াশোনা না থাকা সত্বেও তিনি একের পর এক অসাধ্য সাধন করে সকলকে চমৎকৃত করেন। ১৯১০ সালে তিনি হ্যালির ধূমকেতু পর্যবেক্ষণ করেন এবং তা নথিবদ্ধ করেন। হ্যালির ধূমকেতু সম্পর্কিত তিনি কয়েকটি প্রবন্ধ রচনা করেন যা দ্য হিন্দু পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। বিখ্যাত বিজ্ঞান শিক্ষক জগদানন্দ রায় তাঁকে দূরবীণ কেনার পরামর্শ দেন। তিনি অতি কষ্টের সাথে নিজের বেতনের টাকা জমিয়ে এবং জমি বিক্রি করে একটি তিন ইঞ্চ দূরবীণ কিনতে সমর্থ্য হন। এই সময়ে কালীনাথ মুখোপাধ্যায় এবং জগদানন্দ রায় ওনাকে পরামর্শ ও নক্ষত্র সম্পর্কিত বিজ্ঞান শিখতে সহায়তা করেন। ১৯২৬ সালে ফ্রান্স সরকার ওনার নক্ষত্র সম্পর্কিত কাজের জন্য ওনাকে OARF (Officer d'Academic Republic Francaise) পদক প্রদান করে। ওনার রচিত অন্যতম বই হল ‘ধূমকেতু’। তিনি পরিবর্তনশীল নক্ষত্র পর্যবেক্ষণের প্রায় সবকটি বিখ্যাত সংস্থার ( FAAVSO, FBBA, AFOEV) সদস্যপদ পেয়েছিলেন।
১৯৪৭ এ বাংলা ভাগের পর ১৯৬০ সালে তিনি ভারতে চলে আসেন। তিনি ভারতে আসার সময় বেনাপোল বন্দরে নিজের কেনা দূরবীণ এবং আমেরিকা সরকারের দেওয়া দূরবীণ নিয়ে এসেছিলেন যা কাস্টমস তার দূরবীণ আটকে রেখে দেয়। তখন আমেরিকা ও ফ্রান্স সরকারের সহায়তায় তিনি এই দূরবীণ আবার ফেরত পান। শেষ বয়সে উনি চরম আর্থিক অনটনের মধ্যে পড়েন। ১৯৭৫ সালের ৩রা এপ্রিল তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান।
এক কথায় উনি বাংলার গর্ব কিন্তু দুর্ভাগ্য এতবড় মাপের বিজ্ঞানীকে বাঙালি মনে রাখেনি। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে ৭৬ বছর বয়সে তিনি অবসর নেন এবং নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করা থামিয়ে দেন। তখন তিনি ওনার টেলিস্কোপগুলো বিখ্যাত বিজ্ঞানী ভাইনু বাপ্পুকে দেন যাতে সেটা সঠিক কাজে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় রাধাগোবিন্দ চন্দ্রের নামে কোনো অবজার্ভেটরি বা গবেষণাগার কিছুই নির্মিত করেনি বাঙালি। ওনার কাজগুলো ভুলে গেছে বাঙালি।
তথ্যসূত্র- Aavso অফিসিয়াল ওয়েবসাইট, সায়েন্স ওয়ার্ল্ড - ফেব্রুয়ারি, ২০০৭ সংখ্যা, অমলেন্দু বন্দোপাধ্যায়ের লেখা বিজ্ঞান সাধক রাধাগোবিন্দ।
Post a Comment