বাঙালি কবে বুঝবে নিজস্ব জাতিসত্ত্বা?
বাঙালি এক অদ্ভুত জাতি। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সবচেয়ে বড়ো অবদান রেখেছিল বাঙালিরা। দেশের প্রথম নোবেল আসে বাঙালির হাত ধরে। দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নোবেল পেয়েছে বাঙালিরা৷ ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ পরিচালক সত্যজিৎ রায়ও একজন বাঙালি ছিলেন। ভারতীয় চলচ্চিত্রের জনক হীরালাল সেনও একজন বাঙালি ছিলেন। যে সুভাষকে গোটা দেশের মানুষ দেশনায়ক হিসেবে সম্মান করেন তিনিও একজন বাঙালি। ভারতের মধ্যে লাইফটাইম অস্কারও কেবল একজন বাঙালিই পেয়েছেন। ক্রিকেটে যাকে সবাই দাদা বলে সম্মান করেন সেই সৌরভ গাঙ্গুলীও বাঙালি। ফুটবলে যাকে চিনের প্রাচীর বলা হয় সেই গোষ্ঠ পালও একজন বাঙালি। ব্রিটিশকে হারিয়ে প্রথম শিল্ড জয়ের স্বপ্ন বাঙালিই দেখিয়েছিল৷ এতোকিছুর পরও আমরা কী নিজের জাতিসত্ত্বাকে বুঝতে পেরেছি? একেবারেই পারিনি।
বাঙালির এক বড়ো নেশা হলো আজ এ পার্ট কাল ও পার্টি করে রাজনৈতিক দলের মধ্যে থেকেই নিজের জাতিকে দুর্বল করে দেওয়া। কিন্তু একটা জাতির জাতিসত্ত্বা তখনই বেঁচে থাকে যখন সেই জাতি রাজনীতির বাইরে বেরিয়ে এসে নিজের জাতির জন্য কাজ করে। তার উদাহরণ তামিলনাড়ু, কেরালা, কর্ণাটক। কেরালা ও কর্ণাটকে সেই চেনা পার্টিই রাজত্ব করে কিন্তু সেখানকার মানুষ নিজের জাতিসত্ত্বার বিষয়ে সচেতন বলেই সেই রাজ্যগুলো সমস্ত দিক দিয়ে একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে। তারা অর্থনীতি থেকে বাণিজ্য, শিক্ষা-দীক্ষা, চলচ্চিত্র শিল্প সবেতেই ভাষাকে গুরুত্ব দেয়। ফলে তাদের রাজ্যের মানও যেমন বাড়ছে তেমনই তাদের ভাষার প্রসারও ঘটছে।
দক্ষিণ ভারত শূন্য থেকে শুরু করে যদি নিজের জাতিসত্ত্বাকে কাজে লাগিয়ে উন্নতি করতে পারে তাহলে বাঙালি সংস্কৃতিমনস্ক হয়ে কেন নিজের উন্নতি ঘটাতে পারে না? প্রশ্নটা এখানেই। বাঙালির কাছে আজকে জাতিসত্ত্বার কোনো মূল্য নেই। বাঙালি যেন দিন দিন এক দুর্বল জাতি হওয়ার দিকে এগোচ্ছে।
বেচারা ঋত্বিক ঘটক বাঙালিকে দুই ভাগে ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য যন্ত্রণায় পাগল হয়ে গেলেন। লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় শেষ জীবনে এসে বুঝতে পারলেন বাঙালির কাছে তার জাতিসত্ত্বা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আজকে আপনি রাস্তায় বাঙালি জাতিসত্ত্বা নিয়ে গলা ফাটান যতখুশি, কেউ শুনবে না আপনার কথা। কেউ আপনার গায়ে হাত তুলবে। কেউ আপনাকে দেখে হাসাহাসি করবে। কেউ আপনাকে পাগল বলবে৷ ধরুন ভিন রাজ্যের কোনো লোক এসে আপনার মা-বোনেদের নিয়ে কটূক্তি করলো আপনি কী ছেড়ে দেবেন? কখনোই ছাড়বেন না। এবার আপনি যখনই তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবেন লোকে আপনাকে বলবে 'দেশের মানুষ হয়ে দেশের মানুষের বিরুদ্ধে লড়ছেন আপনার লজ্জা করে না'। অথচ ভিন রাজ্যের সেই মানুষটা যে অন্যায় করলো সেই অন্যায়ের কথা বাঙালি সহজেই ভুলে যায়।
কোনো এক জনৈক নেতা যখন সুভাষচন্দ্র বসুকে 'সন্ত্রাসবাদী' আখ্যা দিলেন তখন কোনো তথাকথিত বাঙালি বুদ্ধিজীবী যাদের আরেক নাম বিশ্বমানব তারা কোনো প্রতিবাদ করলো না। এই তো কদিন আগে কোনো এক হিন্দি ওয়েব সিরিজে যখন ক্ষুদিরাম বসুকে অপরাধীর ওয়ান্টেড তালিকায় দেখানো হলো সেখানেও বিশ্বমানবের দল নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে। বাঙালিকে কেউ খচ্চর বা বদমায়েশ বললেও বিশ্বমানবদের গায়ে লাগে না।
সত্য কথা বলার জন্য কোনো এক প্রতিবাদী বাঙালিকে যখন ধরার জন্য ভিন রাজ্যের মানুষ পুলিশ পাঠায়। সেখানে বাঙালি নিরব হয়ে থেকে যায়। ফলে সেই ব্যক্তি বাঁচার সঠিক উপায় খুঁজে পাননা। বাধ্য হয়ে ভিন রাজ্যের মানুষের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিতে বাধ্য হন। এখানেই বাঙালির শিক্ষা নেওয়া উচিৎ যে সেই ভিনরাজ্যের জাতিসত্ত্বা ঠিক কতটা শক্তিশালী। অতএব ক্ষমা চাওয়াটা ঐ ব্যক্তিটির দোষ নয়, দোষটা আমাদের। আমরা সকল বাঙালি তার পাশে দাঁড়াতে পারিনি। তাই তিনি বাধ্য হয়ে ক্ষমা চেয়ে নিলেন। এটা তার ব্যর্থতা নয়, এটা বাঙালির ব্যর্থতা। কারণ বাঙালি স্বাধীনতার ৭৪ বছর পরও ঐক্যবদ্ধ হতে পারলো না।
গত দুই বছরে অনেক ছোটো-বড় বাঙালি জাতীয়তাবাদী সংগঠন তৈরি হয়েছে। কেউ প্রকৃত জাতীয়তাবাদী সংগঠন, কেউ নামমাত্র জাতীয়তাবাদী সংগঠন, আবার কেউ তথাকথিত জাতীয়তাবাদী সংগঠন। কোনো একটা জাতীয়তাবাদী সংগঠন যখন বাঙালির মধ্যে জাতিসত্ত্বা জাগাতে উঠে পড়ে লাগলো তখন সেই দলকে ভাঙাতে বাঙালি যেন প্রস্তুত। পদ পাওয়ার আকাঙ্খা ও অর্থের লোভের জন্য সোশ্যাল মিডিয়াতে অমানবিকতা প্রদর্শন করে অনেক বাঙালি জাতীয়তাবাদী দল ছাড়ছেন। যাদের মোটেও জাতীয়তাবাদী বলা যায়না, তারা সহজ অর্থে বাঙালির বাঙালির কলঙ্ক। এই ধরণের বাঙালিরা এতোটাই অমানবিক যে বাঙালিকে কাঁকড়ার জাত বলতেও এদের বুক কাঁপেনা।
জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বাঙালির জন্য যথেষ্ট প্রয়োজন। যারা আজকে প্রকৃত বাঙালির জন্য কাজ করতে চান তাদের পিছনে কাঠি করার লোক আজকে অগাধ। সহজেই বিচ্ছিন্নতাবাদীর তকমা লাগিয়ে দেওয়া হয় তাদের৷ এটা কী আদৌ ঠিক? তাহলে আমরা কী আমাদের মাতৃভাষার জন্য কিছুই করতে পারবো না? অবশ্যই পারবো যদি আমরা একটু মানুষ হই৷
যারা এখনো প্রকৃত মানুষ না হয়ে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন করছেন তারা একটু মানবিক হোন৷ তারপর না হয় আন্দোলনটা করবেন৷ যারা জাতীয়তাবাদকে সঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে চায় তাদের অন্তত একটু ভালো ভাবে কাজ করতে দিন। একটা বড়ো জাতীয়তাবাদী দলকে ভাঙ্গিয়ে নামমাত্র যতই দশটা জাতীয়তাবাদী সংগঠন গড়ে উঠুক না কেন, সংগঠনের বাইরের বাঙালি ঐক্যবদ্ধ না হলে বাঙালির ধ্বংস নিশ্চিত। এরপরও কী বাঙালির জাতিসত্ত্বা জাগবে? এই প্রশ্নটা আপামর বাঙালির কাছেই তোলা রইলো।
প্রতিবেদন- সুমিত দে
নীরদ চন্দ্র চৌধুরী লিখেছিলেন,'আত্মঘাতী বাঙালি'। সত্যই বুঝি আমরাই আমাদের অধোগতির কারণ।
ReplyDelete